বিজ্ঞাপন

কোভিড-১৯ এর উৎপত্তি ও বাহক

March 26, 2020 | 6:20 pm

সুমিত বড়ুয়া, দক্ষিণ কোরিয়া থেকে

২০১৯ সালের শেষ দিকে চীনের হুবেই প্রদেশের রাজধানী উহান শহর থেকে নতুন যে নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হয়, এরই মধ্যে তা সারাবিশ্বে মহামারি আকার ধারণ করেছে। গত বছরের ১৭ নভেম্বর প্রথম এই ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী নিবন্ধিত হলেও এর প্রাদুর্ভাব, সংক্রমণ ও ভয়াবহতার চিত্র বুঝতেই এক মাসেরও বেশি সময় লেগে যায় চীনের স্বাস্থ্য অধিদফতরের। যার ফলে অজানা এই নতুন ভাইরাসের সংক্রমণ বেড়েই চলে সবার অজান্তে।

বিজ্ঞাপন

শুরুর দিকে এ ভাইরাসের সংক্রমণ ছিল খুব ধীর গতির। ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর যখন চীন কর্তৃপক্ষ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে (ডব্লুউএইচও) নতুন এই অজানা ভাইরাস বিষয়ে অবহিত করে, তখন এই ভাইরাসে আক্রান্তের লক্ষণযুক্ত রোগীর সংখ্যা ছিল মাত্র ৪১ জন। ধারণা করা হয়, এই রোগের উৎপত্তিস্থল উহানের হুয়ানানের সামুদ্রিক মাছের আড়ত। আরও ধারণা করা হয়, বাদুড়ের স্যুপ থেকেই এই ভাইরাস মানুষের মাঝে ছড়ায়। এই ধারণাটি এতই দ্রুত গতিতে ছড়িয়ে পড়তে থাকে যে এশীয় বংশোদ্ভূতরাও জাতিগতভাবে বিদ্বেষের শিকার হতে থাকেন।

তবে করোনাভাইরাস সংক্রমণে ‘বাদুড়ের স্যুপ তত্ত্ব’ কিছুদিনের মধ্যেই ভুল প্রমাণিত হয়। কারণ এই ভাইরাসে আক্রান্ত প্রথম নিবন্ধিত ব্যক্তির সঙ্গে হুয়ানানের মাছের আড়তের কোনো সম্পর্ক ছিল না। চীনের বিজ্ঞানীরা এই ভাইরাসের জিনোমিক সিকোয়েন্স (জিন ক্রম) করার পর এর মলিকিউলার ডেটিং (জীববিজ্ঞানে ব্যবহৃত জিনের বিবর্তনের সময় নির্ধারণের পদ্ধতি) করেন। তারা জানতে পারেন, বর্তমান ভাইরাসটির জিন বৈশিষ্ট্যের উৎপত্তি হয় ২০১৯ সালের নভেম্বরে। মানুষের শরীর থেকে সংগ্রহ করা SARS-CoV-2 ভাইরাসের ‘সর্বোচ্চ নিকটতম বাহক নির্ণয়’ পদ্ধতিতে বিজ্ঞানীরা ধারণা করেন, মানব শরীরের SARS-CoV-2 ভাইরাসের উৎপত্তি ২০১৯ সালের ২৪ নভেম্বর।

চীনের বিজ্ঞানীরা জিন বিশ্লেষণ করে এর বৈশিষ্ট্যের ওপর ভিত্তি করে এ বছরের ৭ জানুয়ারি নতুন এই করোনাভাইরাসের নাম দেন নভেল করোনাভাইরাস বা nCoV-2019, যা ১১ ফেব্রুয়ারি International Committee on Taxonomy of Viruses (ICTV) পরিবর্তন করে বর্তমানের বহুল প্রচলিত severe acute respiratory syndrome coronavirus 2 বা সংক্ষেপে SARS-CoV-2 নামকরণ করেন। একই তারিখে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই শ্বাসকষ্টজনিত রোগের নাম দেয় কোভিড-১৯ (Covid-19)।

বিজ্ঞাপন

জিন বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা এই ভাইরাসের সঙ্গে ২০০২ সালের নভেম্বরে চীনে SARS-CoV-এর ৭৯ দশমিক ৬ শতাংশ বৈশিষ্ট্যের মিল পান, যা বেটাকরোনাভাইরাস (Betacoronaviruses) গ্রুপের অংশ। প্রায় এক বছর ধরে চলা SARS-CoV দ্বারা সৃষ্ট মহামারিতে সারাবিশ্বের ২৯টি দেশের আট হাজার ৯৮ জন আক্রান্ত হন, মারা যান ৭৭৪ জন। SARS-CoV সংক্রমণের প্রায় ১৫ বছর পরে ২০১৭ সালে চীনের বিজ্ঞানীরা এই ভাইরাসের প্রধান বাহক হিসেবে গুহায় বসবাসকৃত ‘হর্স শু’ বাদুড় ও মধ্যবর্তী বাহক হিসাবে গন্ধগোকূলকে শনাক্ত করতে সক্ষম হন।

সাধারণত সব করোনাভাইরাসের বাহক হিসেবে স্তন্যপায়ী প্রাণী ও পাখি বলেই ধারণা করা হয়। এর ওপর ভিত্তি করে বর্তমানের SARS-CoV-2-এর উৎপত্তিও বাদুড় থেকে হয়েছে বলে বিজ্ঞানীরা মতামত দেন। চীনের গুয়াংযউ-তে অবস্থিতি সাউথ চায়না এগ্রিকালচার ইউনিভার্সিটির বিজ্ঞানীরা মানুষ ও পাংগোলিন থেকে সংগ্রহ করা SARS-CoV-2-এর জিন বৈশিষ্টের মধ্যে ৯৯ শতাংশ মিল খুঁজে পান। অন্যদিকে আরেক দল বিজ্ঞানী মালয়েশিয়ান প্যাংগোলিন থেকে সংগ্রহ করা ভাইরাসের সঙ্গে মানুষের দেহ থেকে ভাইরাসের জিন বৈশিষ্ট্যের মিল পান ৯০ শতাংশ। তাই তারা SARS-CoV-2-কে প্যাংগোলিন থেকে সংক্রমিত হওয়ার ধারণায় সন্দেহ পোষণ করেন। কিন্তু প্যাংগোলিনের SARS-CoV-2 জিন বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা দেখতে পান, তাদের S protein এর সঙ্গে মানব কোষের ACE (Angiotensin Converting Enzyme 2) রিসেপ্টর (সাধারণ ভাষার প্রোটিন দ্বারা তৈরি প্রাণী কোষের দ্বার) এর মিল প্রায় শতকরা ৯৯ ভাগ।

কিন্তু বাদুড় থেকে সংগ্রহকৃত RaTG13 ভাইরাস (যার সঙ্গে SARS-CoV-2 জিনগত মিল রয়েছে) জিনের একই অংশের মিল মাত্র শতকরা ৭৭ ভাগ। এই তথ্যের ওপর ভিত্তি করে নিশ্চিত হওয়া যায়, প্যাংগোলিনের SARS-CoV-2 ভাইরাস মানুষের দেহে প্রবেশ করতে পারলেও বাদুড় থেকে এই ভাইরাস মানুষের দেহে প্রবেশ করতে পারে না। এছাড়া, মানব SARS-CoV-2 এর সঙ্গে প্যাংগোলিনের SARS-CoV-2 ও বাদুড়ের RaTG13 উভয় ভাইরাসের জিনগত মিল খুব কাছাকাছি। ফলে বাদুড় ও প্যাংগোলিনের ভাইরাসের সমন্বয়ের মাধ্যমে মানব SARS-CoV-2-এর উৎপত্তি বলে মত দেন। দু’টি ভিন্ন বাহকের থেকে আগত ভাইরাসের জিন কাঠামো পরিবর্তনের মাধ্যমে সৃষ্ট নতুন ভাইরাস নতুন বাহককে আক্রান্ত করার মতো বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হয়ে থাকে। এরপরও SARS-CoV-2 বাহকের ক্রম অনুসারে বিজ্ঞানীরা বাদুড়কে প্রাথমিক বাহক ও পরে প্যাংগোলিনকে মধ্যবর্তী বাহক ধরে জিন বৈশিষ্ট্যের সমন্বয়ের মাধ্যমে নতুন SARS-CoV-2 হিসেবে মানবদেহে প্রবেশ করেছে বলে একটি প্রাথমিক রূপরেখা দেন। তাই এখনো সময় আসেনি কোভিড-১৯-এর সৃষ্টিকারী SARS-CoV-2 প্রাথমিক বাহক হিসেবে বাদুড় বা প্যাংগোলিনকে নিশ্চিতভাবে দায়ী করার।

বিজ্ঞাপন

বাহক

বর্তমান সময়ের কোভিড-১৯-এর প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ার পরে সাধারণ মানুষের মধ্যে SARS-CoV-2 ভাইরাসের বাহক সম্পর্কিত সবচেয়ে বড় প্রশ্ন ছিল— এই ভাইরাস গৃহপালিত কুকুর-বেড়ালের মাধ্যমে ছড়াতে পারে কি না। এই প্রশ্নের স্পষ্ট উত্তর— ‘না’, করোনাভাইরাস কুকুর-বেড়ালের মাধ্যমে ছড়ায় না। এ ব্যাপারটি ভালোভাবে বুঝতে হলে আমাদের আগে বুঝতে হবে ভাইরাসের বাহক সম্পর্কে।

কোনো ভাইরাসের বাহককে সাধারণত ‘Host’ বা ‘Reservoir’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। বাহক দুই ধরনের হতে পারে— প্রাথমিক ও মধ্যবর্তী বাহক। এই ব্যাপারটি বোঝার জন্য আমরা যদি ২০০২ সালের উদ্ভূত SARS-CoV ভাইরাসকে ধরি, তাহলে এই প্রাথমিক বাহক হলো গুহায় বাস করা হর্স শু বাদুড়, আর তাদের মধ্যবর্তী বাহক ছিল গন্ধগোকূল। অর্থাৎ প্রাথমিকভাবে বাদুড় তাদের দেহে SARS-CoV বহন করত, যা জিনগত পরিবর্তনের মাধ্যমে গন্ধগোকূলের শরীরে প্রবেশ করে এবং তা আবার পরিবর্তিত হয়ে মানুষের দেহে সংক্রমণ ঘটায়।

পোষা কুকুর-বিড়াল কি নিরাপদ?

বিজ্ঞাপন

এখন প্রশ্ন হতে পারে— এই ভাইরাসগুলো প্রাথমিক ও মধ্যবর্তী বাহকের দেহে থাকার পরও কেন তাদের মাঝে রোগের লক্ষণ দেখা যায় না। এর উত্তর হলো— ভাইরাসকে তার বাহকের দেহ আক্রান্ত করতে হলে তার সংখ্যা বাড়াতে হবে। কারণ ভাইরাস যেহেতু যেকোনো বাহকের দেহের জন্য বহিরাগত জীবাণু, তাই তারা কোনো বাহকের দেহে প্রবেশ করে তার ক্ষতি সাধন করতে চাইলে বাহকের দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ভাইরাসকে বাধা দেয় ও মেরে ফেলে। তাই ভাইরাসকে জিততে হলে প্রাণীদেহে প্রবেশ করে তার সংখ্যা বাড়াতে হবে এবং তাদের সংখ্যা বেড়ে গেলে তারা প্রাণীর দেহ আক্রমণ করে।

প্রাথমিক ও মধ্যবর্তী বাহকের দেহে ভাইরাসের আক্রমণ ক্ষমতা থাকে কম। এর সঙ্গে বাহকের দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি থাকায় ভাইরাস তাদের সংখ্যা বাড়াতে বা বংশ বৃদ্ধি করতে পারে না। ফলে বাহকের দেহ আক্রান্ত করতে পারে না। তাই কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত বয়োজ্যেষ্ঠ যাদের ডায়াবেটিক, কিডনি রোগ ইত্যাদি থাকে, তারা বেশি অসুস্থ হয়ে যান। কারণ তাদের দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকে।

SARS-CoV-2 ভাইরাসের সন্দেহজনক বাহক হিসেবে এখন পর্যন্ত শুধু বাদুড়, প্যাংগোলিন ও মানুষকে শনাক্ত করা হয়েছে। বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে দেখেছেন গৃহপালিত বেড়াল ও কুকুরের মধ্যে এই ভাইরাস ছড়াতে পারে না। অর্থাৎ SARS-CoV-2 কুকুর বেড়ালের মাধ্যমে ছড়াতে পারে না। তাই কুকুর-বেড়ালসহ সব গৃহপালিত পশুই নিরাপদ। কিন্তু একজন আক্রান্ত মানুষের সংস্পর্শে আসা মোটেও নিরাপদ নয়।

তাই সামাজিক দূরত্ব মেনে চলুন।

ঘরে থাকুন নিরাপদ থাকুন।

লেখক: চিকিৎসক

তথ্যসূত্র:

১. WHO: https://www.who.int/emergencies/diseases/novel-coronavirus-2019/technical-guidance/naming-the-coronavirus-disease-(covid-2019)-and-the-virus-that-causes-it
২. Journal of medical virology
৩.  https://www.nature.com/

[মত-দ্বিমত বিভাগে প্রকাশিত লেখা লেখকের নিজস্ব মতামত]

করোনাভাইরাসের সবশেষ তথ্য দেখুন- করোনা: লাইভ আপডেট

সারাবাংলা/আইই

Tags: , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন