বিজ্ঞাপন

করোনাভাইরাস: ভুয়া খবরের বিপদ কতটা?

April 1, 2020 | 1:10 pm

মানুষ কেনো ভুয়া খবর বিশ্বাস করে, সেগুলো আবার প্রচারও করে। বিশেষ করে কোনো একটি দুর্যোগপূর্ণ সময়ে এ জাতীয় খবরের বিস্তার খুব বেশি লক্ষ্য করা যায়। তা নিয়ে গবেষণা করেছেন ফরাসি ন্যাশনাল সেন্টার ফর সায়েন্টিফিক রিসার্সের কগনিটিভ বিশেষজ্ঞ হুগো মসিয়ে। এ সম্পর্কিত গবেষণার ফলাফল নিয়ে তিনি একটা বইও লিখেছেন, যার নাম ‘নট বর্ন ইয়েসটারডে: দ্য সায়েন্স অব হু উই ট্রাস্ট অ্যান্ড হোয়াট উই বিলিভ ’। এছাড়া সম্প্রতিকালে বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাস মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ার পরিপ্রেক্ষিতে দ্য গার্ডিয়ানের জন্য ‘ফেইক নিউজ ইন দ্য টাইম অব করোনাভাইরাস: হাউ বিগ ইজ দ্য থ্রেট?‘ শিরোনামে একটি প্রবন্ধও লিখেছেন। সেখানে তিনি ভুয়া খবর ও এর পেছনের মনস্তত্বগুলো ব্যাখ্যা করেছে।

বিজ্ঞাপন

প্রবন্ধটিতে তিনি মূলত ফরাসি এবং পশ্চিমা অভিজ্ঞতার আলোকে ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তবে ভুয়া সংবাদ ছড়ানো ও এর পেছনের মনস্তত্ব আমাদের দেশের ক্ষেত্রেও পায় একই ধরনের। ফ্রান্সের জনগণের সঙ্গে শিক্ষা ও সামাজিক পার্থক্য থাকলেও বিপদজনক এই সময়ে একইরকম আচরণ করছি আমরাও। বুঝে না বুঝে দেখছি, শুনছি ও ছড়াচ্ছি নানারকম ভুল তথ্য ও ভুয়া খবর। দ্য গার্ডিয়ান থেকে প্রবন্ধটি সারাবাংলার পাঠকদের জন্য ভাষান্তর করেছেন রাজনীন ফারজানা।

প্রবন্ধটিতে বলা হয়েছে, বিপদের সময় ভুয়া খবর ছড়ায় বেশি। যেমন মাছের চৌবাচ্চা পরিষ্কারক দিয়ে কোভিড-১৯ ভাইরাস ধ্বংস করা যায়। অথবা করোনাভাইরাস চিনের (অথবা আমেরিকা অথবা ফ্রান্স) ল্যাব থেকে ছড়ানো হয়েছে। আবার আজ ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো তো কাল পোপের কোভিড-১৯ আক্রান্ত হওয়ার খবর ছড়াচ্ছে।

এমনসব ভুয়া খবর কেন ছড়ায়? এসব খবর যারা ছড়ায় তারা কী সবাই নিরাশাজনক আর বোকার মত আচরণ করছে? নাকি উদ্বেগজনক পরিস্থিতি তাদের এমন ভয়ঙ্কর বাজে কথা বিশ্বাস করতে বাধ্য করছে?

বিজ্ঞাপন

আদতে এমনটা হওয়ার সম্ভাবনা কম। অনেক ক্ষেত্রে মানুষ শুধু মজা করতেও ভুল খবর ছড়ায়। বাঁদুরের স্যুপ খেয়ে করোনাভাইরাস শুরু হয়েছে বা তারকা ব্যক্তিত্বের করোনা হয়েছে ধরনের গল্প আমাদের মনে সুড়সুড়ি জাগায়। সেই সুড়সুড়ির কারণেই আমরা এগুলোতে সাড়া দেই। এর আগেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এমন অনেক ভুয়া গল্প জনপ্রিয়তা পেয়েছে। যেমন, ২০১৮ সালে এক ব্যক্তি তার প্রাক্তন বসের বাগানে ২ লাখ ডলারের লটারি হারিয়ে ফেলেছে এমন একটি গল্প ছিল জনপ্রিয়তার শীর্ষে। পরের অবস্থানেই ছিল সাবেক আমেরিকান ফার্স্ট লেডি বারবারা বুশের মারা যাওয়ার খবর।

করোনাভাইরাস-ভুয়া খবর

যাই হোক, ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর করোনা হয়েছে বা একটি জীবনবিজ্ঞান বিষয়ক পরীক্ষার ব্যর্থতা থেকে এই ভাইরাস ছড়ানোর খবর মানুষ বিশ্বাস করেছে। একের পর এক ধারাবাহিকভাবে না ছড়ালেও এসব মিথ্যা খবর শুনে মানুষ একইরকম প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। এমনকি যেসব ভক্ত রোনালদোর করোনা হওয়ার খবর বিশ্বাস করেছে তারাও তার দেখা পেলে পরমুহূর্তেই তার সঙ্গে হাত মেলাতে ছুটত। আবার কেউই ভাইরাস বিষয়ক গবেষণাগার অবরোধ করে সত্য জানার চেষ্টা করেনি।

বিজ্ঞাপন

না, এসব কিছুই না। কোভিড-১৯ বিষয়ক সবচেয়ে ভয়ঙ্কর মিথ্যা ছড়িয়েছে এর নানারকম আরোগ্য নিয়ে। কিছুদিন আগে এক ব্যক্তি ক্লোরোকুইন নামক একধরনের রাসায়নিক শরীরে ইনজেকশনের মাধ্যমে পুশ করে মারা যান যা মাছের চৌবাচ্চা পরিষ্কারের জন্য ব্যবহৃত হয়। সম্প্রতি এই রাসায়নিকটি নিয়ে কোভিড-১৯-এর প্রতিষেধক আবিষ্কারের পরীক্ষা হচ্ছে যা এখনো সফলভাবে সমাপ্ত হয়নি। কিন্তু তার আগেই অনেকে একে অলৌকিক আরোগ্য ভাবতে শুরু করেছে। কিন্তু সবাই ইনজেকশন নেওয়ার মতো এমন ভয়ঙ্কর পদক্ষেপ নেয়নি। কয়েক লাখ মানুষ ক্লোরোকুইনের কথা শুনলেও সবাই নিজেই নিজের চিকিৎসা করতে শুরু করেনি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মানুষ এসব উপেক্ষা করে। আসলে যারা এগুলো নিজের ওপর প্রয়োগ করে তারা অন্য কোনো পরিস্থিতিতেও নিজের সঙ্গে এমনই করত। এছাড়াও সর্বরোগের ওষুধ হিসেবে যেগুলোর নাম বারবার আসে তা হল- চা, লাল মাংস, অ্যালকোহল এমনকি কোকেইনও।

যত যাই হোক, ভুল খবর যতই প্রাসঙ্গিক মনে হোক না কেন, এগুলোর সত্য কি না তা দেখার সঙ্গে সঙ্গেই নির্ণয় করতে পারা ভালো। অন্তত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শেয়ার করে নিজেকে ‘ইডিয়ট’ প্রমাণের প্রয়োজন নাই। হোয়াটসঅ্যাপে যেসব ভুয়া খবর ছড়ায় তা শুরুই হয় এভাবে- ‘আমার এক বন্ধু আছে যার চাচা উহানে থাকে’ অথবা ‘আমার এক বন্ধুর বাবা রোগতত্ত্ব বিভাগে কাজ করে’ ইত্যাদি।

এসব গল্প এভাবে নানারকম বিশ্বাসযোগ্য উৎসের মাধ্যমে এতটাই বিশ্বাসযোগ্যভাবে বলা হয় যে তা মানুষ ফেলে দিতে পারে না। অনেসময় অনুমানভিত্তিক অনলাইন গবেষণাকে উপাত্ত ধরে রোগের কারণ, প্রভাব ও প্রতিকার নিয়েও বিভিন্ন খবর শেয়ার করা হয়।

যেকোন সংকটজনক সময়ে প্রধান সমস্যা এটিই না যে, মানুষ যা শোনে সরল মনে তাই বিশ্বাস করে। আসল সমস্যা হচ্ছে, মানুষ সঠিক সতর্কবাণী ধরতে পারে না। দেখা যায় তারা উপকারী সতর্কবাণী শোনে না, ভালো পরামর্শ মেনে নেয় না। কেন? অনেকেই হয়তো ভাবে এসব তথ্য সঠিক নয়, অথবা ধান্দাবাজি। রাজনৈতিক নেতাদের প্রতি অবিশ্বাসের বিষয়টা বোঝা যায় যেহেতু অনেক ক্ষেত্রেই বিভিন্ন দেশের সরকার অতটা স্বচ্ছতা বজায় রাখতে ব্যর্থ। তবুও এটিই যেন রীতি, সরকারি কর্মকর্তাদের ওপর অবিশ্বাসের সংস্কৃতি এতটাই ব্যপক যে, নিউ অর্লিন্সের এক লাখ বাসিন্দা বাড়ি ছাড়ার সতর্কতা শোনেনি। ফলাফল, তাদের উপর পূর্ণবেগে হারিকেন ক্যাটরিনার আছড়ে পড়া।

বিজ্ঞাপন

করোনাভাইরাস-ভুয়া খবর

বর্তমান অবস্থাও অনেকটা তেমনই। যেদিন ফরাসি সরকার সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করে ও জনগণকে একে অন্যের সঙ্গে শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখতে বলে তার পরদিন আমার ৯৬ বছর বয়স্ক ফুপু ক্যাসিনোতে চলে যায়। তিনি একাধারে একজন ধূমপায়ী ও ফুসফুসের রোগী। প্যারিসের দোকানগুলোও ছিল লোকে লোকারণ্য।

আতঙ্কের মুহূর্তে সবচেয়ে গুরুতর প্রতিক্রিয়া হল ‘প্যানিক বায়িং’। পাস্তা এবং টয়লেট পেপার কিনে ঘর ভরে ফেলার উদাহরণ সবাই জানি আমরা। এর কারণ কর্তৃপক্ষের প্রতি যথেষ্ট বিশ্বাস না থাকা। বিপদের দিনে হয়ত তারা প্রয়োজনীয় বস্তুর সরবরাহ ব্যবস্থা ঠিক রাখতে পারবে না, এই আতঙ্কও অনেককে ‘প্যানিক বায়িং’ এ উৎসাহ দেয়।

মানুষ আবার যা মেসেজ পায়, স্বভাবতই সেগুলো বিশ্বাস করে। আমাদের মস্তিষ্ক প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণের সময় নিজের অভিজ্ঞতার সঙ্গে তা মেলায়। অভিজ্ঞতা অর্থাৎ আমাদের ভাবনা, শোনা ও পড়ার মাধ্যমে তৈরি বিশ্বাসের সঙ্গে মেলে কিনা সেটিই সবার আগে যাচাই করি। যদি মিলে যায় তাহলে তা মেনে নিতে আমরা মুহূর্ত মাত্র দ্বিধা করি না। ভুয়া খবর এভাবেই আমাদের ভেতরে থাকা কুসংস্কারকে জাগিয়ে তোলে। যেমন মাদক গ্রহণে যে অভ্যস্ত সে মনে করে এতেই মিলবে আরোগ্য আর যে ব্যক্তি জাতি বৈষম্য করতে অভ্যস্ত, সে অন্য জাতিকে দোষ দিয়ে আনন্দ পায়। অন্যদিকে, আমাদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার সঙ্গে মেলে না এমন কথা শুনলে আমরা সেটি গ্রহণ করি না। বিশেষত, তার জন্য যদি কোন মূল্য (যেমন, ঘরে থাকার বাধ্যবাধকতা) চুকাতে হয়, তাহলে তো কথাই নাই। মানুষ খুব সহজেই সেসব তথ্য বাতিল করে দেয়। এইজন্যই মানুষ প্রাথমিক সতর্কীকরণে গা লাগায় না। প্রাথমিকভাবে ঘরে আবদ্ধ হওয়ার নিষেধাজ্ঞা মেনে না নেওয়ার এটিই কারণ।

ভুয়া খবর পাওয়ার পর প্রাথমিক এই প্রতিক্রিয়া কাটিয়ে ওঠার জন্য প্রয়োজন সচেতনতা। যিনি বলছেন তিনি বিশ্বাসযোগ্য কিনা অথবা আমাদের বিশ্বাস কাজে লাগিয়ে অন্য কোনো উদ্দেশ্য পূরণ করবেন না সেটি বিবেচনা করতে হবে। এইজন্যই বারবার করে তথ্য যাচাই করতে হবে। এভাবেই আমরা খুব অল্প সংখ্যক ভুয়া সংবাদের মুখোমুখি হব এবং ভুল তথ্য এড়াতে পারবো।

  করোনাভাইরাস-ভুয়া খবর

একইভাবে, সঠিক খবর ও সুপরামর্শ বিশ্বাস করার আগেও সত্যতা পরীক্ষা করে নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ। কোভিড-১৯ সংক্রমণ ঠেকাতে বারবার হাত ধোয়া বা একে অন্যের সঙ্গে শারীরিক দূরত্ব মেনে চলতে বলা হচ্ছে সেটিও মানার আগে চেক করে নিতে ভুলবেন না। যেসব দেশ সাফল্য পেয়েছে প্রয়োজনে তাদের বিষয়ে খোঁজ নিন। এসব পরামর্শ একেবারে উড়িয়ে দেওয়া উচিৎ হবে না। আমাদের সবারই নিয়ম ভাঙতে ইচ্ছা করে, কিন্তু এসব ক্ষেত্রে প্রতিবাদী হওয়ার মাধ্যমে যদি কোনো সঠিক তথ্য পান তবেই হন। না হয় ভুয়া খবর বাদ দিয়ে সুপরামর্শ মেনে চলুন।

সারাবাংলা/আরএফ/

Tags: , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন