বিজ্ঞাপন

করোনায় মৃতদের দেহ সৎকার, সঠিক নিয়ম কী?

April 4, 2020 | 2:15 pm

সুমিত বড়ুয়া

কোভিড-১৯ বা নভেল করোনা নামের যে ভাইরাসটি ডিসেম্বরের মধ্যভাগে চীন থেকে তাণ্ডব চালাতে শুরু করেছিল তার চূড়ান্ত ভয়াবহতা এখন দেখতে পাচ্ছে বিশ্ববাসী। তবে এই ভয়াবহতাই যে চূড়ান্ত তা বলার সময় কিন্তু এখনও আসেনি। বর্তমানে বিশ্বে করোনায় আক্রান্ত এগারো লাখ আর মারা গেছেন প্রায় ৫৮ হাজার। সংক্রমণ শুরু হওয়া চীন তাদের আক্রান্তের সংখ্যা শূন্যের ঘরে নিয়ে আসতে পারলেও প্রতিদিন সারাবিশ্বে এই আক্রান্তের সংখ্যা হু হু করে বাড়ছে। এর এই বাড়ার একমাত্র কারণ করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ক্ষমতা অন্য যে কোনো ভাইরাসের তুলনায় অনেক বেশী হওয়ায়। এখন বিশ্বের সকল রাষ্ট্র চেষ্টা করছে তাদের জনগণকে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে ঘরে অবস্থান করা নিশ্চিত করার জন্য। কিন্তু কিছু গুজব বিভ্রান্তির রসদ হয়ে এই মহৎ কাজে বাধা দিচ্ছে। ফলে জনগণের মাঝে সামাজিক দুরত্ব বজায় রাখা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ছে।

বিজ্ঞাপন

সম্প্রতি বাংলাদেশের সামাজিকযোগাযোগের মাধ্যম হয়ে জনগণের মাঝে ছড়িয়ে পড়েছে এক ভিন্ন ধরনের বিভ্রান্তিকর খবর। বলা হচ্ছে কোভিড-১৯ ভাইরাসে আক্রান্ত কেউ মারা গেলে তার মৃতদেহ থেকে ভাইরাস ছড়াতে পারে না এবং সেই মৃতদেহ সৎকারেও কোন সমস্যা হয় না। সাধারণ ধর্মীয় রীতি মেনেই করোনায় মৃতদের দেহ সৎকার সম্ভব। এমনকি সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে এও ভেসে বেড়াচ্ছে আমাদের পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা কিভাবে স্বাভাবিক উপায়ে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণকারীদের দেহ সৎকার করছেন!

না বুঝে, না জেনে এই গুজবগুলোর বহুল প্রচারের ফলে জনমনে বাড়ছে বিভ্রান্তি। জনগণও নিজের অজান্তেই নিজেদেরকে ঠেলে দিচ্ছেন অজানা এই ভাইরাসের কাছে। স্বাভাবিক মৃত্যুতে দেহ সৎকার আর মহামারি বা কোনো সংক্রামক ব্যাধিতে মৃতব্যক্তির দেহ সৎকারের নিয়ম কখনোই এক নয়। এই বিষয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও),খাদ্য ও পরিবেশ সুরক্ষা অধিদপ্তরের একটি সুনির্দিষ্ট নিয়মাবলী আছে যা বিশ্বের সকল দেশকেই মৃতদেহ সৎকারে মেনে চলতে হয়।

সংক্রামক ব্যাধিগুলোর সংক্রমণের ধারা, গতি ও ক্ষতির মাত্রার উপর নির্ভর করে সকল মৃতব্যক্তির দেহকে সাধারণত তিনভাগে ভাগ করা হয়। আর এই নিয়মেই সকল মৃতদেহ সৎকার করতে হয়। প্রথম ক্যাটাগরিতে আছে সংক্রমণ করতে পারে এমন রোগ ছাড়া অন্য কোনো কারণে মৃত ব্যক্তির দেহ। এক্ষেত্রে মৃত ব্যক্তির দেহ শবব্যাগে ভরে তাতে নীল রং এর চিহ্ন লাগিয়ে দেয়া হয়।

বিজ্ঞাপন

ক্যাটাগরি দুইয়ে আছে সংক্রমণ করতে পারে এমন রোগে মৃত ব্যক্তির দেহ। এইডস, হেপাটাইটিস সি, সার্স, মার্স, এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জাসহ হালের কোভিড-১৯ এর সংক্রমণের কারণে যাদের মৃত্যু হয়েছে বলে চিকিৎকরা সনাক্ত করেছেন তাদের মৃতদেহকে এই ভাগে রাখা হয়েছে। এইভাগে মৃত ব্যক্তির শবব্যাগে বিশেষ চিহ্ন বা লেভেল লাগান হয়। আর মৃতদেহ ব্যবস্থাপনা ও সৎকারে সর্বোচ্চ সতর্কতা নেয়া হয়।

ক্যাটাগরি তিনে আছে উচ্চমাত্রায় সংক্রমণের আশংকায় থাকা রোগে মৃতব্যক্তির দেহ। এদের মৃত্যুর কারণ হিসাবে চিকিৎসকরা এনথ্রাক্স, প্লেগ, র‍্যাবিস, ভাইরাল হেমোরেজিক ফিভার ইত্যাদি উচ্চমাত্রার সংক্রমণের ঝুঁকি আছে এমন রোগ উল্লেখ করেন। এদের শবব্যাগে লাল রং এর চিহ্ন থাকে। ক্যাটাগরি তিন নম্বরে থাকা রোগে মৃতব্যক্তির দেহ ব্যবস্থাপনা ও সৎকারেও সর্বোচ্চ সতর্কতা নেয়া হয়।

ওপরের এই তিন ক্যাটাগরির ওপর ভিত্তি করে মৃতব্যক্তির দেহসৎকার কার্যক্রম পরিচালনায় সৎকারকারীর জন্যও রয়েছে সুনির্দিষ্ট নিয়মাবলী। তিন ক্যাটাগরির ক্ষেত্রেই সৎকার পরিচালনায় অংশগ্রহণকারীর অবশ্যই ‘হেপাটাইটিস-বি’ এর ভ্যাকসিন দেওয়া থাকতে হবে। সকল ব্যক্তিকে নিজের সুরক্ষা ও সংক্রামক ব্যাধি সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান থাকতে হবে, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হতে হবে। সংকার পরিচালনাকারীদের সকল নিয়মাবলী মানার প্রতি শ্রদ্ধাশীল করে তৈরি করার কথাও বলা রয়েছে নিয়মাবলীতে। মৃতদেহ সৎকার এবং আনুষঙ্গিক কার্যক্রম পরিচালনায় জড়িত লাশঘরের কর্মী এবং স্বাস্থ্যকর্মীর ক্ষেত্রেও একই নিয়ম প্রযোজ্য।

বিজ্ঞাপন

সংক্রামক রোগে মৃত্যুর পরে দেহবহনের ক্ষেত্রেও রয়েছে নির্দিষ্ট নিয়মাবলী। ক্যাটাগরি এক-এ দেহ বহনের ক্ষেত্রে কোন শবব্যাগের দরকার হয় না। তবে ক্যাটাগরি দুই ও তিনের ক্ষেত্রে অবশ্যই নির্দিষ্ট শবব্যাগ ব্যবহার করতে হবে। ক্যাটাগরির একের ক্ষেত্রে মৃতদেহ স্বাভাবিকভাবে দেখার অনুমতি থাকলেও ক্যাটাগরি দুইয়ের ক্ষেত্রে তা দেখতে হয় দূর থেকে। আর তিন নম্বর ক্যাটাগরির মৃতদেহ দেখা এবং কোনো প্রকার সংস্পর্শ সম্পূর্ন নিষেধ। ক্যাটাগরি দুই ও তিনে ফুল বা কিছু দিয়ে সম্মাননা জানানো সম্পূর্ন নিষেধ। ক্যাটাগরি দুইয়ে সৎকারের ক্ষেত্রে মৃতদেহ পুড়িয়ে ফেলার পরামর্শ দিলেও তা দাফন করা যায় কিন্তু ক্যাটাগরি তিনে মৃতদেহ অবশ্যই পুড়িয়ে ফেলতে হবে। কোভিড-১৯ যেহেতু ক্যাটাগরি দুইয়ে পড়ে তাই এইক্ষেত্রে সৎকার পরিচালনাকারীকে অবশ্যই পিপিই ব্যবহার করতে হবে।

প্রথম ক্যাটাগরির মৃতদেহের সৎকার পরিচালনাকারীকে অবশ্যই ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম (পিপিই), গ্লাভস, পানি পড়লে সরে যায় এমন কাপড়ে তৈরি গাউন এবং সার্জিক্যাল মাস্ক ব্যবহার করতে হবে। আর দেহ থেকে কোন তরল পদার্থ ছিটকে আসার সম্ভাবনা থাকলে গগলস বা ফেইস শিল্ড পরতে হবে। ক্যাটাগরি দুই এর ক্ষেত্রে ক্যাটাগরি এক- এ উল্লেখ থাকা সব সরঞ্জাম ব্যবহার করতে হবে। তবে এক্ষেত্রে কেবল পানি পড়ে সরে যায় এমন কাপড়ের গাউন বা কাভারঅল ব্যাবহার করলেই হবে না বরং এমন কাপড়ের কাভারল ব্যবহার করতে হবে যা পানিনিরোধী। অর্থাৎ এই কাপড় ভেদ করে পানি ঢুকতে পারবে না। ক্যাটাগরি দুইয়ের ক্ষেত্রে কাভারঅল অবশ্যই জৈবসুরক্ষিত হতে হবে। যাতে জীবানু এতে লেগে থাকতে বা প্রবেশ করতে না পারে। ক্যাটাগরি তিনের ক্ষেত্রে বাড়তি সতর্কতা হিসাবে ডাবল গ্লাভস, জুতার কাভার ও বুট ব্যবহার করতে হবে। ক্ষেত্র বিশেষে বিশেষ কিছু ব্যবস্থা নেয়া জরুরী যেমন- দ্বিস্তরের শবব্যাগ ব্যবহার করে প্রথম ও দ্বিতীয় ব্যাগের মাঝে উচ্চশোষন ক্ষমতা সম্পন্ন দ্রব্য রাখতে হবে। এবং ব্যাগের উপরে ব্লিচিং পাউডার বা জীবাণুনাশক দিয়ে পরিষ্কার করে তাতে উচ্চ সংক্রমনযোগ্য লিখে চিহ্নিত করতে হবে।

সংক্রামক রোগে মৃতদের সৎকার কার্যক্রম পরিচালনাকারীর অবশ্যই খেয়াল রাখে হবে যাথে তিনি কোনভাবেই মৃতদেহের সরাসরি সংস্পর্শে না আসেন। যদি সৎকার পরিচালনাকারীর দেহে কোনো ক্ষত, কাটাছেঁড়া থাকে তাহলে তা এমনভাবে ব্যান্ডেজ করতে হবে যাথে তাতে পানি ঢুকতে না পারে। সৎকার কার্যক্রম পরিচালনার সময়ে খাদ্যদ্রব্য গ্রহণ, ধূমপান বা পান করা সম্পূর্ন নিষিদ্ধ। চোখ-মুখ বা নাকে হাত দেওয়া যাবে না। অবশ্যই বারবার সাবান ও পানি দিয়ে হাত পরিষ্কার করতে হবে। সৎকারের সময়ে মৃতদেহ যাতে ধারালো কিছুতে আঘাতপ্রাপ্ত না হয় সে দিকে নজর রাখতে হবে। সৎকার কার্যক্রম শেষ হওয়ার পরে নিয়মানুযায়ী পিপিই খুলে তা বিনষ্ট করতে হবে। সৎকার কার্যক্রম পরিচালনার সময়ে অসাবধানতাবশত যদি কেউ মৃতদেহের সংস্পর্শে আসেন বা আঘাত পান তাহলে আঘাতের স্থান পানি ও সাবান দিয়ে ভালো করে পরিষ্কার করতে হবে। যে কোনো ক্ষত বা আঘাতের কথা উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষকে জানাতে হবে এবং চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।

করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের এই সময়ে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার মধ্য দিয়ে দিন পার করছেন বিশ্ববাসী। এর মধ্যে আবার নানা রকমের গুজব ও অসত্যকে মোকাবেলা করতে হচ্ছে। করোনা ভাইরাসের সংক্রমণে মৃতদের দেহ স্বাভাবিক নিয়মে সৎকার করা যায় এও একটি গুজব। অনেকে হয়তো না জেনেই এ গুজবটি ছড়াচ্ছেন। কোভিড-১৯ বা করোনা ভাইরাসের সব তথ্য এখনও পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা উন্মোচন করতে পারেননি। তবে যদ্দূর জানা যায়, এই ভাইরাস মানুষের মাঝে পারস্পরিক সংস্পর্শ ও ড্রপলেটের মাধ্যমে ছড়ায়। এমনকি মলমূত্রের মাধ্যমেও এই রোগ ছড়াতে পারে। তবে কোভিড-১৯ যেহেতু ইনফ্লুয়েঞ্জার মতো রোগ তাই এতে মৃতদেহ থেকে রোগ সংক্রমণের আশংকা কম। তারপরও যেহেতু এটি একটি নতুন ভাইরাসজনিত বৈশ্বিক মহামারীতে পরিণত হয়েছে তাই ভাইরাস সংক্রান্ত সব বিষয়ে যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করা বাঞ্ছনীয়। ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যাক্তি মারা গেলে যখন সেই মৃতদেহ একটি জৈবসংক্রমণমুক্ত শবব্যাগে ঢুকিয়ে দেয়া হয় তখন সেই মৃতদেহ থেকে ভাইরাস ছড়ানোর সম্ভাবনা কমে যায়। মৃতদেহটি নিয়ম মেনে অন্তত ছড় ফুট মাটির নিচে দাফন করলে ভাইরাস ছড়ানোর আর কোনো ঝুঁকি থাকে না। আর পুড়ে ফেললেতো কথাই নেই।

বিজ্ঞাপন

এই সব কথার শেষ কথাটি হলো, শংকার এই সময়ে কোভিডের পাশাপাশি গুজবের আতংকের মতো অদৃশ্য দানবকে আমাদের রুখে দিতে হবে। আর এই এই রুখে দেওয়া সম্ভব করতে আমাদের বেশী কিছুই করতে হবে না। শুধু সরকারী নির্দেশ মত নিজের ঘরে নিজেকে আড়াল করে রাখলেই হবে। তাহলে আমাদের আর মৃত্যু বা মৃতদেহ নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। তাই নিজে ঘরে থাকুন, অন্তর্জালের হাজারো লক্ষ গুজবে কান না দিয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা ডাক্তারের পরামর্শ নিন। আর এটাও সম্ভব না হলে সবকিছু সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বাস না করে নিদেনপক্ষে গুগলে বিশ্বাসযোগ্য ওয়েবসাইটে বা তথ্যসূত্রে খোঁজ করে দেখে নিশ্চিত হোন।

ঘরে থাকুন। নিরাপদ থাকুন।

তথ্যসূত্র:

১। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)।

২। ফোড সেফটি কন্ট্রোল অ্যান্ড এনভায়োরনমেন্টাল হাইজিন ইন দ্য ইউএস অ্যান্ড ইউকে।

আরও পড়ুন- কোভিড-১৯ এর উৎপত্তি ও বাহক

কোভিড-১৯ ও তার নির্ণয় পদ্ধতি

সারাবাংলা/এসবিডিই/আইই

Tags: , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন