বিজ্ঞাপন

দক্ষিণের সুখ-অসুখ: খাবার পানি নিয়ে বাড়ছে কলহ-বিভেদ!

March 1, 2018 | 10:51 am

মেসবাহ শিমুল, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট

বিজ্ঞাপন

পিরোজপুর ও বাগেরহাট থেকে ফিরে: বাগেরহাটের চিতলমারির প্রত্যন্ত গ্রাম চরবানিয়ারির উত্তরপাড়ায় তখন সন্ধ্যা নেমেছে। আলো আঁধারিতে পাড়ার একটি টঙ দোকানের সামনে লোকজনের জটলা চোখে পড়লো। একটু শোরগোলও হচ্ছে। এগিয়ে গিয়ে জানা গেলো, পানি নিয়ে বিবাদের জের ধরেই এই হৈচৈ। আর বিস্তারিত জানতে গিয়ে বোঝা গেলো, সে বিবাদ পাড়ার প্রতিবেশিদের মধ্যে নয়। বচসার একপক্ষ খুলনা বিভাগের, অন্যপক্ষ বরিশালের। আর সে বচসা পানি নিয়ে। স্রেফ খাবার পানি।

বরিশালের কয়েকজন নারী এসেছিলেন এখান থেকে খাবার পানি নিতে। তা কেড়ে রাখা হয়েছে। পানি রেখে দিয়েছেন দোকানি ভবতোষ নিজেই। হম্বি-তম্বিটা তার গলায়ই বেশি শোনা যাচ্ছিলো। অন্য গ্রাম থেকে পানি নিয়ে যাবে, এমনটা হতে পারে না। তাদের নিজেদেরও পানির স্বল্পতা। তাতে কেউ ভাগ বসাক সেটা চান না ভবতোষ। শুধু ওই নারীদের পানিই নয়, ভবতোষ সেদিন আটকে দিয়েছেন ভ্যান বোঝাই করে কলসি-ড্রাম ভরে পানি নিতে যাওয়া টাকেরহাট বাজারের একদল ব্যবসায়ীদেরও। এতবড় কাজ তিনি করেছেন গ্রামের জন্য তাই তার গলাও বেশ চড়া। অন্যরা কেউ বাহবা দিচ্ছেন, কেউ আবার বলছেন, আহা! কেনই আটকে দিলে? শতহোক পানি তো! তাও আবার খাবার পানি।

তবে প্রত্যন্ত অঞ্চলে গ্রীষ্ম আসার আগেই খাবার পানির এমন সঙ্কট নিয়ে সকলেই চিন্তিত।

বিজ্ঞাপন

দক্ষিণের অন্যতম নদ বলেশ্বর ভাগ করেছে খুলনা ও বরিশালকে। তবে সামন্তগাতি নামের একটি গ্রাম বলেশ্বরের পশ্চিম পাড়ে খুলনার সীমান্ত ঘেঁষে। ফলে এই গ্রামের মানুষ ভৌগলিকভাবে বরিশাল বিভাগের তথা পিরোজপুর জেলার অংশ হলেও খুলনার মানুষের সাথেই তাদের নিত্য ওঠা-বসা।

বরিশালের সামন্তগাতি ও খুলনার চরবানিয়ারির মধ্যে একটি খাল। সে খালও অনেক আগেই পানিশূন্য। ওদিকে শত কিলোমিটার দীর্ঘ নদ বলেশ্বরও শুকিয়েছে।

বলেশ্বরের মিঠা পানি একসময় এ অববাহিকার কৃষির প্রাণ ভোমরা ছিল। সুপেয় পানির চাহিদাও মেটাতো জনপদবাসীর। কিন্তু প্রকৃতির খামখেয়ালিতে বলেশ্বরের বিশাল একটা অংশ এখন মৃতপ্রায়। কোথাও কোথাও পুরোপুরি মৃত। তাই বিশাল এ অঞ্চলের পানি সরবরাহ ব্যবস্থায় এসেছে বড় পরিবর্তন। সে পরিবর্তনের প্রভাবে দক্ষিণাঞ্চলবাসী ধুঁকছে নানা সমস্যায়।
যার একটি খণ্ডচিত্র দেখা গেলো চরবানিয়ারির ভবতোষের দোকানের সামনে।

আরেকটু খোঁজ নিয়ে জানা গেছে এই পাল্টে যাওয়া পানির কাহিনী, পাল্টে দিয়েছে সে এলাকার কৃষি ব্যবস্থা। প্রভাব পড়েছে জীব-বৈচিত্র্যে। স্বাস্থ্যখাতেও নেমে আসছে বড় সঙ্কট। সবচেয়ে বড় যে প্রভাব তা হচ্ছে সামাজিক জীবনে। অন্য গ্রাম থেকে আসা নারীদের কাছ থেকে খাবার পানি রেখে দেওয়া হয়েছে, এর চেয়ে সামাজিক বিপর্যয় আর কী-ই হতে পারে?

বিজ্ঞাপন

সঙ্কটের দিনে নিজেদের পানি অন্যরা নিয়ে যাক তা এখানকার অনেকেই চান না। বিষয়টা খুব পরিস্কার, খাবার পানি নিয়ে একদল একদিকে যেমন ঐক্যবদ্ধ, আবার সেই পানির কারণেই অন্যদের সাথে বাড়ছে শত্রুতা।

পানির উৎসের খোঁজ নিতে গিয়ে জানা গেলো, এখানকার একটি বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের পুকুরটি সংরক্ষণ করা হয়েছে খাবার পানির জন্য। পুকুরের একটু দূরেই একটি বেসরকারি সংস্থার সহায়তায় স্থাপন করা হয়েছে বড় আকারের ফিল্টার। স্কুল কর্তৃপক্ষ আর এলাকাবাসীই এখন এটির ব্যবস্থাপনায়। তারাই চাঁদা তুলে এটির রক্ষণাবেক্ষণ করে আসছেন।
বলেশ্বর শুকিয়ে গেলে, খালগুলো পানিশূন্য হয়ে পড়লে এটাই হয়ে পড়ে পুরো চরবানিয়ারির খাবার পানির একমাত্র উৎস।
আশপাশের প্রায় এক বর্গ কিলোমিটার জুড়ে কয়েক হাজার পরিবারের বেশিরভাগই এই পুকুরের পানি খেয়ে বেঁচে আছেন। তাই প্রতিদিন সকাল থেকেই ভিড় জমে পানির ফিল্টারকে ঘিরে। বিকেলে সে ভীড় আরও বাড়ে। সন্ধ্যা নামলেও দেখা যায় ড্রাম-কলসি-ক্যান ভরে পানি নিয়ে ফিরছেন অনেকেই।

এরই মধ্যে ফাঁক-ফোঁকড়ে অন্য গ্রাম থেকেও এসে পড়েন কেউ কেউ। ভিড়ের মধ্যে চুপচাপ পানি নিয়ে চলে যান। তবে ওই দিন শেষ রক্ষা হয়নি।

প্রতিদিনই যে আটকে দেওয়া হয় তা নয়। খাবার পানি সবারই প্রয়োজন। এই গ্রামের মানুষও তা বোঝে।

সামন্তগাতি থেকে পানি নিতে এসেছিলেন পুতুল রাণী মন্ডল। তিনি বলেন, ‘ওরা দিতে চায় না। তাও নেই। এখান থেকে পানি না পাওয়া গেলে কি খেয়ে যে বাঁচতাম, জানিনা।’

বিজ্ঞাপন

পুতুল ছাড়াও মনিকা মনি, দিপালী ঘোষ আর কমলা রাণী বালার সাথে কথা হয়। তারা জানান, তাদের নিজেদের বাড়িতে বসানো হয়েছিলো টিউবওয়েল। কিন্তু সে পানিতে আয়রনের মাত্রা এতো বেশি যে মুখে নেওয়া যায় না। কোনো কোনোটিতে আবার আর্সেনিকও ধরা পড়েছে। তাই খাবার পানির জন্য এই পুকুর এখন তাদেরও ভরসা।

খাবার পানি নিয়ে ব্যবসাও জমে গেছে। চরবানিয়ারির পাশের গ্রাম কৃষ্ণনগর। সেখানে রাস্তার পাশের একটি ছোট্ট চায়ের দোকান। সেখানেই চোখে পড়লো পানির রমরমা ব্যবসা। গ্রামে পানি না থাকার সুযোগ নিয়ে দূরের চিতলমারী উপজেলা শহর থেকে খাবার পানি এনে ২০ লিটারের এক জার পানি ৫৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। রাজধানী ঢাকাতেই যে দর জার প্রতি ২৫ টাকার বেশি নয়।

আর খুচরা বিক্রি করলে, গ্লাস ১ টাকা দরে প্রতি জার পানি ৭০ থেকে ৮০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয় এই প্রত্যন্ত গ্রামেও।
কথা হয় দোকানী শিপ্রা বাড়ইয়ের সঙ্গে। জানালেন, গ্রামের বাড়িগুলো থেকেও এসে পানির জার কিনে নিয়ে যাচ্ছে অনেকেই।

শিপ্রা জানালেন, এখান থেকে যতো দক্ষিণে যাওয়া যায় অবস্থা ততোই খারাপ। কোথাও গভীর নলকূপ (ডিপ টিউবওয়েল) নেই। খাবার জন্য পুকুরে ধরে রাখা বৃষ্টির পানি আর এমন জারের পানিতে বেঁচে থাকছেন জনপদবাসী।

চিতলমারীর সবশেষ এলাকা কালিগঞ্জ বাজার। সেখানে কথা হয় আলমাস নামের এক দোকানীর সঙ্গে। যারা এই বাজারে জারের পানির ডিলার। বাগেরহাট থেকে পানি এনে এই বাজার ও আশপাশের গ্রামে বিক্রি করেন তারা। এখানে প্রতি জারের দাম ৩৫ টাকা। তিনি জানান, দুদিন পরপর পানির ট্রাক আসে এই বাজারে। পরিবহনে অপেক্ষাকৃত কম খরচ বলে এখানে একটু কম দামেই মেলে জারের পানি।

তবে, গ্রীষ্ম যত ঘনিয়ে আসছে, প্রতিদিনই বাড়ছে পানির চাহিদা। যারা একটু সচ্ছল তারা প্রতিদিনই পানি কিনে খাচ্ছেন। আর যারা একটু দরিদ্র তারা বিভিন্ন পুকুর থেকে খাবার পানি সংগ্রহ করছেন। কিন্তু সেখানে না পেলে, কিনে খাওয়া ছাড়া উপায় থাকে না এই অঞ্চলবাসীর।

একই অবস্থা উপজেলার খাসেরহাট, পিপড়াডাঙ্গী, উমাজুড়ি, কালসিরা, পিরোজপুরের বানিয়ারী, কচুয়ার গজালিয়া, ধোপাখালি, মাধবকাঠি, ভাসাসহ প্রত্যেকটি গ্রামের। সব মিলে সুপেয় খাবার পানি এসব এলাকায় দিনদিন দুস্প্রাপ্য হয়ে উঠছে।

পানি নিয়ে কথা হয় কালিগঞ্জ বাজারের পল্লী চিকিৎসক জাহাঙ্গীর গাজীর সঙ্গে। তিনি বললেন, ‘বলা হয়ে থাকে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ হবে পানি নিয়ে। কথাটি যে সত্য তা আমরা এখনই টের পাচ্ছি। এতো নদ-নদীর দেশে পানি নিয়ে যে অবস্থা তা রীতিমত উদ্বেগের।’

এই পল্লী চিকিৎসক জানালেন, দিন দিন এ এলাকায় সুপেয় পানির অভাব তীব্রতর হচ্ছে। বলেশ্বর নদের দুইপাড়েই বাড়ছে রোগীর সংখ্যা। যারা নিজেরাও জানেন না খাবার পানির সমস্যায় দিনদিন রোগাক্রান্ত হয়ে পড়ছেন তারা।

প্রধান সমস্যা কী পানিই? এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, প্রথমত সুপেয় পানির অভাবে গ্যাস্ট্রিক বাড়ছে। শরীর কষা এবং কখনো কখনো অনিয়মিত ডায়রিয়া হচ্ছে। যারা টিউবওয়েলের পানির ওপর বেশি নির্ভরশীল তারাই এসব সমস্যায় বেশি ভুগছেন। দীর্ঘদিন এসব রোগ থাকলে শরীরে বড় ধরনের সমস্যা হতে পারে বলে অভিমত এই চিকিৎসকের।

দক্ষিণাঞ্চলের নদ-নদীগুলোর অধিকাংশই উত্তর-দক্ষিণে প্রবাহিত। এই নদীগুলোর উত্তরাংশ ক্রমেই ভরাট হয়ে যাওয়ায় বন্ধ হয়ে গেছে উত্তরের পদ্মা-মধুমতি নদীর মিষ্টি পানির প্রবাহ। এতে করে দক্ষিণের লবনাক্ত পানির স্তর উপরে উঠে যাচ্ছে। পরিবর্তন আসছে নদীপাড়ের মানুষের জীবন-জীবিকায়। মাছ, কাঁকড়াসহ সব জলজ প্রাণি অস্তিত্ব সংকটে পড়ছে। আর এই জলজ প্রাণির উপর নির্ভরশীল পাখিও করছে তার স্থান পরিবর্তন। প্রভাব পড়ছে পরিবেশের ওপর, এমনটাই মত পরিবেশবিদদের।

মাটি, পানি ও পরিবেশ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে আসছেন ড. এসএম ইনামুল হক। বর্তমানে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এই পরিবেশবিদ সারাবাংলাকে বলেন, প্রাকৃতিক কারণেই দক্ষিণাঞ্চলের নদ-নদীগুলোর তলদেশ ভরাট হচ্ছে। সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, পিরোজপুরসহ দক্ষিণের জেলাগুলোর দক্ষিণভাগ দিনদিন খাবার পানির সঙ্কটে পড়বে এটা খুবই স্বাভাবিক। এজন্য নদীগুলো খনন করা না গেলে এ সমস্যা ক্রমেই উত্তরের দিকেও আসবে।

পরিবেশ গবেষণাগুলো আগে থেকেই জানাচ্ছে, দক্ষিণের প্রধান নদী রূপসা, বলেশ্বর, ও ভৈরব নদে লবণাক্ততার পরিমাণ ক্রমেই মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। এর ক্ষতিকর প্রভাবের কবলে পড়ছে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ, জলজ প্রাণী, গাছপালা ও প্রকৃতি ।
পরিবেশবিদ ও বিশেষজ্ঞরা আশংকা করছেন, এ ধারা অব্যাহত থাকলে মাটির তাপমাত্রা বৃদ্ধিসহ মারাত্মক পরিবেশ বিপর্যয়ের মুখে পড়বে দক্ষিণাঞ্চল।

পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী ২০১৭ সালের এপ্রিল মাসে খুলনার ভৈরব নদ ও রূপসা নদীর কয়েকটি পয়েন্টে লবণাক্ততা ছিল ১৪ থেকে ১৬ পিপিটি (পার্টস পার ট্রিলিয়ন) । এ বছরের মাঝামাঝি তা ২০ পিপিটিতে পৌঁছতে পারে। এ কারণে দক্ষিণের নদী সংলগ্ন উপকূলীয় অঞ্চলগুলো পড়েছে ভয়াবহ লবণের আগ্রাসনে।

খুলনা পরিবেশ অধিদপ্তরের কেমিস্ট এস এম শরিফুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, গত বছরের তুলনায় এবছর তিন পিপিটি লবণাক্ততা বেড়েছে। এটা চলতে থাকলে সামনের দিনগুলোতে বড় সমস্যা দেখা দিতে পারে।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের প্রফেসর ড. আব্দুল্লাহ হারুন চৌধুরি বলেন, লবনাক্ত পানি মিঠা পানি থেকে অনেক বেশি তাপমাত্রা ধারণ করতে পারে। তাই যে সব জলজ প্রাণি বেশি তাপমাত্রা সহ্য করতে পারেনা সেগুলো মরে যাচ্ছে।

পরিবেশবিদ ড.এসএম ইনামুল হক খাবার পানির চাহিদা মেটাতে সরকারের পাশাপাশি এলাকাভিত্তিক উদ্যেগ নেওয়ার ওপর জোর দেন।

তিনি বলেন, কিছু কিছু এনজিও এসব এলাকায় খাবার পানির চাহিদা পূরণ করার উদ্যোগ নিচ্ছে। এলাকাবাসীরও উচিত তাদের উদ্যেগের অংশীদার হওয়া। বৃষ্টির পানির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করা।

প্রকৃতির সঙ্গে ভাব করে চলতে না পারলে এ সমস্যা দিন দিন বাড়তেই থাকবে, বলেন অধ্যাপক ইনামুল হক।

সারাবাংলা/এমএস/এমএম

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন