বিজ্ঞাপন

জীবনরহস্যে লুকানো গতি, তবুও ঘরে বসেই উদযাপন হোক পহেলা বৈশাখ

April 14, 2020 | 1:25 am

রাজনীন ফারজানা

সভ্যতার শুরু থেকেই মানুষের জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে গতি। আজ আমরা সবাই জানি, একের পর জীবনের বিকাশ ঘটেছে এই ধরাধামে, আর একেকটি দুর্ঘটনায় বিলুপ্তিও ঘটেছে। এভাবেই ধ্বংস হয়েছে বিশালাকারের ডাইনোসরদের ১৬ কোটি বছরের রাজত্ব।

বিজ্ঞাপন

বিবর্তনের এক পর্যায়ে পৃথিবীর বুকে আসে প্রাইমেট, যা মানব সৃষ্টির প্রথম পর্যায়। একটা সময়ে পৃথিবীটা যখন ঘাসে ছেঁয়ে যেতে থাকে, তখন ভয় পেয়ে চার পেয়ে প্রাইমেটরা উঠে যায় গাছে। এদিকে ঘাস বিপ্লবের ফলে উধাও হয়ে যেতে শুরু করে বিশাল সব অরণ্য। খাবারের অভাবে বুঝি প্রাইমেটরাও বিলুপ্ত হয়ে যায়! না, তারা বিলুপ হয়নি। তারা সন্তান-সন্ততিসহ গাছ থেকে নেমে আসে পৃথিবীর বুকে। ঘাসের মধ্যে উঁচু হয়ে দেখার সুবিধার্থে একসময় তারা দুই পায়ে দাঁড়াতে শেখে। ধীরে ধীরে তৈরি হয় দুই হাত। আর সেই হাতই গড়ে দিয়েছে আধুনিক পৃথিবীর গতি-প্রকৃতি। মানুষ হাতের সাহায্যে গড়েছে যেমন, তেমনি পায়ের সাহায্যে ছড়িয়েছে পৃথিবীময়। গড়েছে শহর-বন্দর আর আধুনিক সভ্যতা।

অবিরাম ছুটে চলা যেন আমাদের ডিএনএ’র গঠনেই লিখিত। সভ্যতা যত এগিয়েছে, ততই যেন বেড়েছে আমাদের ছুটে চলার প্রবণতা। আমরা যানবাহন, জাহাজ আর হাওয়াই জাহাজ বানিয়েছি পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ছুটে বেড়াতে। সেই মানুষকে আজ কাটাতে হচ্ছে বন্দিদশা। ঠিক যেন ৭০ লাখ বছর আগে প্রাইমেটরা যেমন ঘাস বিপ্লবে গাছে বন্দি হয়ে পড়েছিল, আমরাও তেমনি আজ করোনাভাইরাসের হাতে নাজেহাল হয়ে ঘরে বন্দি হয়ে গেছি।

মায়ের শাড়িতে বৈশাখি সাজে বাহির পানে চেয়ে থাকা কিশোরী (মডেল- জলছবি)

পৃথিবীজুড়ে কোটির কাছাকাছি মানুষ এই ভাইরাস দ্বারা আক্রান্তের শিকার। মারা গেছেন লাখের কিছু বেশি। ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র এই ভাইরাসের হাত থেকে বাঁচার একটাই উপায়। তা হলো সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা। মজার বিষয় হলো— সার্স-কোভ-২, যাকে আমরা করোনাভাইরাস নামে ডাকি, সে কিন্তু বেশ অহংকারী। নিজ থেকে আপনার শরীরে বা বাসায় আসবে না, যদি না তাকে ডেকে নিয়ে আসেন। তাই এই ভাইরাস সংক্রমণের হাত থেকে রক্ষা পেতে নিজেকে গৃহবন্দি করে ফেলাটাই আপাত সমাধান। অন্তত ভাইরাসের প্রতিষেধক আবিষ্কারের আগ পর্যন্ত কিছু সতর্কতা আমাদের মেনে চলতেই হবে।

বিজ্ঞাপন

চারদিকে মৃত্যুর আতঙ্কের মধ্যেই এলো বাঙালির প্রাণের উৎসব, পহেলা বৈশাখ। বঙ্গাব্দের প্রথম দিন। নতুন বছরকে বরণের উৎসব। প্রতিবছর এই উৎসব ঘিরে চলে কত না আয়োজন! নতুন পোশাক, ইলিশের বাজারে চড়া দাম, কত রকম ভর্তা খাওয়া হবে তার পরিকল্পনা, মঙ্গল শোভাযাত্রা, বৈশাখি মেলা, ছায়ানটের সম্মিলিত কণ্ঠে বর্ষবরণসহ কত আয়োজন। আর এই আয়োজনের মূলেই থাকে ‘বাহির’ হয়ে আসার আহ্বান। কালবৈশাখির মুখোমুখি হওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দিয়ে আমরা বের হয়ে যাই দলে দলে। রঙিন পোশাক আর ফুলের গয়নায় সেজে, গান গেয়ে, হেসে-খেলে মাতিয়ে তুলি শহর-বন্দর-জনপদ।

কিশোরী মন কত স্বপ্ন এঁকে চলে। ওদের জন্যই একদিন আসবে সুদিন (মডেল- জলছবি)

এই বৈশাখ উৎসব ঘিরেই জমে ওঠে দেশের বাজার। শুধু খাবার নয়, নববর্ষ যে নতুন পোশাকেরও। হাজার হাজার কোটি টাকার ব্যবসা হয় পহেলা বৈশাখকে কেন্দ্র করে। এ বছর করোনাভাইরাস সংক্রমণ ঠেকানোর জন্য ২৫ মার্চ থেকেই বন্ধ আছে সব শপিং মল। কোনোরকমে চলছে নিত্যপণ্য আর জরুরি জিনিসের কেনাবেচা। এমন অবস্থায় পহেলা বৈশাখের অর্থনৈতিক ক্ষতির মূল্য দাঁড়িয়েছে দুই হাজার কোটি টাকা।

কিন্তু তবুও জীবন বাঁচানোর স্বার্থে জরুরি প্রয়োজন ছাড়া ঘরেই থাকতে বলা হচ্ছে আমাদের। কাটছাঁট এসেছে পহেলা বৈশাখ উদযাপনেও। মঙ্গল শোভাযাত্রা, ছায়ানটের সম্মিলিত কণ্ঠে নতুন বর্ষের আহ্বান তো বটেই, ঘরের বাইরে জনসমাগম হয়— বন্ধ এমন সব আয়োজন। গ্রাম কিংবা শহর— কোথাওই বসবে না মেলা। দুইশ বছরের পুরনো জব্বারের বলি খেলা ও খেলা ঘিরে জমে ওঠা মেলাও বন্ধ। অথচ এইসব মেলা ঘিরেই জমে ওঠে গ্রামীণ অর্থনীতি। কুমোর, কামার, হস্তশিল্পীরা শাণ দেন পুরনো বিদ্যায়। মেলা ঘিরে চলে নানা আয়োজন। কিন্তু এবার থেমে গেল সব।

বিজ্ঞাপন

বাইরের সব আয়োজন বন্ধ বলে থমকে গেছে ব্যক্তিগত আয়োজনও। না আছে পর্যাপ্ত কাঁচাবাজার, না আছে নতুন পোশাক। সবার মনে শঙ্কা। একইসঙ্গে প্রাণের উৎসব পহেলা বৈশাখ পালন করতে না পেরে আমাদের মনে বিষণ্ণতার আবহ। চারদিকে রোগশোক, অশ্রু আর মৃত্যু ওঁৎ পেতে থাকলেও মানব মন চায় মুহূর্তের ফুরসতে দুঃখের হাত থেকে ক্ষণিকের রেহাই। নতুন পোশাক, উৎসব আর প্রিয়জনের সঙ্গই যেন সেইসব উপলক্ষ ডেকে আনে। কিন্তু এবার আমাদের গৃহকোণই হয়ে উঠুক বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রা। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গেই কাটুক এবারের বৈশাখ।

বাড়ির ছাদে সুতি শাড়িতে স্নিগ্ধতা (মডেল- বীথি সপ্তর্ষি)

প্রধানমন্ত্রীও ঘরে বসে মৌসুমি ফলের সঙ্গে ডিজিটাল পদ্ধতিতে পহেলা বৈশাখ পালনের আহ্বান জানিয়েছেন। মৌসুমি ফল, ভর্তা, মাছ-ডাল-ভাতের মতো দেশি খাবারে আয়োজনের পাশাপাশি আমরা সেজে উঠতে পারি বৈশাখের সাজে। শাড়ি কিংবা পাঞ্জাবিতে সেজে ছবি তুলতে পারি। পারি প্রিয়জনদের সঙ্গে ভিডিও কলে আড্ডা জমাতে, শুভেচ্ছা জানাতে। বৃহত্তর জনস্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করে বাইরের সব আয়োজন বন্ধ থাকলেও মুজিববর্ষ ও স্বাধীনতা দিবসের মতো নববর্ষকে ঘিরেও টেলিভিশনের পর্দার আয়োজনেই মেতে উঠি বর্ষবরণে। চলুন, যতটুকু পারি আয়োজনে ক্ষণিকের জন্য হলেও ভুলে যাই এই দুঃসহ বন্দিদশা।

বাঙালির জীবনে ধর্মান্ধতা আর মৌলবাদিতার বিরুদ্ধে যুদ্ধের হাতিয়ার হয়ে উঠেছিল পহেলা বৈশাখ। দিনে দিনে তা হয়ে উঠেছে বাংলাদেশের অসাম্পদায়িক উৎসবের অন্যতম নজির। সাম্প্রতিক অতীতে শুরু হলেও বৈশাখের অন্যতম অনুষঙ্গ মঙ্গল শোভাযাত্রা। স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের ঐক্য এবং একইসঙ্গে শান্তির বিজয় ও অপশক্তির অবসান কামনায় ১৯৮৯ সালে শুরু হয়েছিল এই আয়োজন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের আয়োজনে এই মঙ্গলশোভাযাত্রা বাতিল হলেও থমকে যায়নি চারুকলা অনুষদ। পোস্টার প্রকাশ করেছে তারা যার স্লোগান, ‘মুক্ত কর ভয়, আপনা মাঝে শক্তি ধরো, নিজেরে করো জয়।’ এই পোস্টারটি ডিজিটাল থেকে বাস্তব দেয়ালে দেয়ালে ঘুরবে সারাদেশে।

বৈশাখের বর্ষবরণের সেই চেতনাকে সামনে রেখে চলুন এবার ঘরে থেকেই সফল করি নববর্ষ উদযাপন। আমাদের জিনের গঠনে গতি থাকলেও, ছুটে বেড়ানোর আহ্বান থাকলেও চলুন জয় করি নিজেকে। বাইরে বের হওয়ার ও একে অন্যের সঙ্গে দেখা করার তীব্র বাসনাকে দমন করি। আর এভাবেই নিজের শক্তিতে নিজেকে জয় করি চলুন। ঘরে থাকি করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয় পেতে। ঘরে বসেই উদযাপন করি আমাদের প্রাণের এই উৎসব।

বিজ্ঞাপন

রবি ঠাকুর যেমন বৈশাখকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, ‘ছাড়ো ডাক হে রুদ্র বৈশাখ!/ভাঙিয়া মধ্যাহ্নতন্দ্রা জাগি উঠি বাহিরিব দ্বারে।’ আমরাও বৈশাখকে আহ্বান জানাই আমাদের জীবনে, কিন্তু কিছুতেই ‘দ্বার’ খুলে ‘বাহিরিব’ না। ঘরে বসেই পালন করব নববর্ষ। সেজেগুজে না হয় ঘরের জানালা কিংবা বাড়ির ছাদে উঠেই আমরা ‘চেয়ে রব প্রাণীশূন্য দগ্ধতৃণ দিগন্তের পারে/নিস্তব্ধ নির্বাক…/ হে ভৈরব, হে রুদ্র বৈশাখ!’

শাড়ি গয়না আর টিপে বাঙালি মেয়ের সাজ, সঙ্গে বিকেলের ছাদ (মডেল- বীথি সপ্তর্ষি)

বলছিলাম লক্ষ কোটি বছর আগের প্রাইমেটদের কথা। গাছের ডালে আটকে থাকতে থাকতে একসময় অতীষ্ঠ হয়ে তারা নেমে আসে নিচে, আর মানব বিবর্তনের ইতিহাসে সূচনা করে নতুন অধ্যায়। কিন্তু এখন আমাদের ঘর থেকে বেরিয়ে আসার সময় হয়নি। যতদিন না কোভিড-১৯-এর ভ্যাকসিন বের হয়, সংক্রমণের হার শূন্যের কোটায় নামিয়ে না আনা পর্যন্ত আমাদের আটকে থাকতেই হবে। আমরা যেন নিরাপদ পৃথিবীতে সুস্থতার সঙ্গে পা ফেলতে পারি, তার জন্য প্রাণপন দিয়ে খেটে চলেছে বিজ্ঞানীরা। কোভিড-১৯ এর ভ্যাকসিন বা চিকিৎসা আবিষ্কারে অকাতরে অর্থ ঢালছে ধনাঢ্য দেশগুলো। আমাদের তাই ধৈর্য ধরতে হবে আরও কিছুদিন।

জানেন তো, চীনে যখন প্রথমবারের মতো করোনাভাইরাস ধরা পড়ে, সেখানে চীনা নববর্ষের ছুটি চলছিল। বাড়তে বাড়তে হুবেই প্রদেশে সেই ছুটি পেরিয়ে যায় তিন মাস। কিছুদিন আগে যখন তারা ‍মুক্তির স্বাদ পেয়েছে, আর একজনও করোনা রোগী ধরা পড়েনি। আসুন আমরাও ঘরে থাকি। একদিন মুক্তির দেখা পাব আমরাও। আজকের পহেলা বৈশাখে নতুন বছরের কাছে তাই প্রতিবছরের মতো আহ্বান জানাই—

যাক পুরাতন স্মৃতি, যাক ভুলে-যাওয়া গীতি,
অশ্রুবাষ্প সুদূরে মিলাক॥
মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা,
অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা।
এসো হে বৈশাখ।
এসো এসো।

 

ছবি- বীথি সপ্তর্ষি  ও জলছবি

সারাবাংলা/আরএফ/টিআর

Tags: , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন