বিজ্ঞাপন

পূর্ব ঘৌটার ঘরের খবর…

March 2, 2018 | 11:23 am

খবরে প্রকাশ, সিরিয়ার পূর্ব ঘৌটায় নির্বাচারে বোমা হামলা চালাচ্ছে রাশিয়া ও ইরানী সমর্থনপুষ্ট সিরিয়ান বাশার আল আসাদের বাহিনী। রয়টার্স, বিবিসির মতো পশ্চিমা গণমাধ্যমে উঠে আসছে সেখানকার সাধারন মানুষের উপর রাসায়নিক হামলার খবর। আমাদের দেশীয় গণমাধ্যমগুলোর নিউজ হান্টিংয়ের মূল উৎসও মূলত এ ঘরানার আন্তর্জাতিক প্রচার মাধ্যম। সমানতালে পাল্লা দিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের পাতা খুললেই ঘৌটার রক্ত মাখা শিশুদের মুখ ভেসে আসছে। ঘৌটা যেন আজ বৈশ্বিক বিপন্ন মানবতার জ্বলন্ত প্রমাণ। নিঃসন্দেহে তাই। কিন্তু দোষী তাহলে কারা? খোলা চোখে দেখলে তো সিরিয়া, রাশিয়া, ইরান হিজবুল্লাহ জোটকেই মনে হয়। ব্যাপারটা কি আসলেই এত সরল? চলুন ঘটনাক্রম গুলোকে একটু মিলিয়ে দেখি।

বিজ্ঞাপন

সেই যে আরব বসন্ত। বদলের কথা বলেছিলো ঝড় তুলেছিলো আরব মরুর পূণ্য ভূমে। সত্যিই বদলে দিয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের ভূ- রাজনৈতিক মানচিত্র। তারও আগে সাদ্দাম হোসেনের পতন ঘটলো।  তার বিরুদ্ধে অভিযোগ মানব বিদ্ধংষী পরমাণু এবং রাসায়নিক অস্ত্রের মজুদ। কিন্তু আজ প্রমানিত সে অভিযোগ ছিলো মূলত আমেরিকা ব্রিটেনের অজুহাত। এ ধরনের কোন কিছুই খুঁজে পাওয়া যায় নি ইরাকে। প্রথমে রাজনৈতিক বিক্ষোভ, পরে সশস্ত্র বিদ্রোহ। পতন ঘটলো মুয়াম্মার আল গাদ্দাফীর। এরপর বাশার আল আসাদের সিরিয়া। পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে চালাচ্ছিলেন ভালোই। কিন্তু সেখানেও শুরু হলো বিক্ষোভ।

উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হচ্ছে প্রথমে এ বিক্ষোভ শুরু হয়েছিলো রাজনৈতিক প্রক্রিয়াতেই। পরে তা রূপ নিলো সশন্ত্র বিদ্রোহে। এর সাথে ধর্মীয় জঙ্গীবাদের সম্পর্ক আছে এটি মনে হয়নি বা সামনে আনা হয় নি। তারা কিন্তু মধ্যপন্থী হিসেবেই পরিচিত ছিলেন। কিন্তু এমন সুবর্ন সুযোগ আমেরিকা কিংবা ইসরাইলই-বা ছাড়বে কেন। সিরিয়ান সরকার যে কখনোই মার্কিন বা ইসরাইলী ব্লকে ছিলো না। বরং তাদের ঘনিষ্টতা ইরান আর রাশিয়ার সাথেই। আমেরিকা কর্তৃক শসস্ত্র বিদ্রোহীদের সামরিক প্রশিক্ষণ এবং অস্ত্র সরবরাহের বিষয়টি ঘটেছে প্রকাশ্যেই। একে একে এই যুদ্ধে যোগ দেয় নানা পক্ষ। একদিকে সিরিয়া সরকারের পক্ষে রাশিয়ান যুদ্ধ বিমান নিয়ে সে দেশের সামরিক পরামর্শকরা, ইরানের অস্ত্র আসে আসে মিলিশিয়া, যুদ্ধে যোগ দেয় হিজবুল্লাহ। অন্যদিকে সেই মধ্যপন্থী সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠীর গুলোর হাতেও থাকেনি বাশার বিরোধী যুদ্ধের রাশ। ইসলামীক স্টেট ছাড়াও বিভিন্ন জঙ্গী গোষ্ঠী এসে যোগ দেয়। অবশ্য এক পর্যায়ে রাশিয়ান বিমান হামলার মুখে সিরিয়া থেকে এসব উগ্রপন্থী ধর্মীয় জঙ্গীগোষ্ঠী পালাতে শুরু করে। সিরিয়া যুদ্ধের নাটকীয় মোড় নেয়। বাশার আল আসাদের সেনাবাহিনী পুনদর্খল করতে সক্ষম হয় জঙ্গী উপদ্রুত সিরিয়ার অধিকাংশ এলাকা। ব্যর্থ হয়ে যায় মার্কিন এবং ইসরাইলের আসাদ সরকারকে পতনের ব্লু প্রিন্ট। এই ছিলো সিরিয়ার যুদ্ধের মোটামুটি একটি পূর্বাপর।

কিন্তু চলতি বছরের ফেব্রুয়ারির মধ্যভাগ থেকেই বিশ্বজুড়ে আলোচনার কেন্দ্রে রাজধানী দামেস্ক থেকে মাত্র ১০ কিলোমিটার দুরের পূর্ব ঘৌটা। সেখানকার চারপাশজুড়ে ২০১৩ সাল থেকেই অবস্থান নিয়েছিলো সিরিয়ার সরকারী বাহিনী। ২০১৭ সালে ১০৪ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এ অঞ্চলটিকে ডি এসকেলশন জোনও ঘোষণা করা হয়। এর ফলশ্রুতিতে রাশিয়া এবং সিরিয় জঙ্গি বিমান সে এলাকার আকাশে উড়েনি। এখন ঘৌটা পরিণত হয়েছে মার খেয়ে পর্যদুস্ত সিরিয়ার বাশার আল আসাদ বিরোধী সব জঙ্গী এবং বিদ্রোহী গোষ্ঠীর ঘাঁটিতে। একটু দেখে নেই ঘৌটাতে কারা আশ্রয় নিয়েছে। প্রথমেই আসবে জয়শ ই ইসলাম বা মোহাম্মদের নাম।  নৃশংশতায় এদের জুড়ি মেলা ভার। ইসলামিক স্টেটের যত রকম নৃশংসতার প্রমাণ পাওয়া যায় সব আছে এদের মাঝে। হরকাত নূর আদ্দিন। নৃশংসতায় এরা সবচেয়ে ভয়াবহ। জবাই করা এদের কাছে ছেলেখেলা মাত্র। শিশুদের পর্যন্ত জবাই করে ভিডিও করার সুষ্পষ্ট প্রমাণ আছে হরকাত নূর আদ্দিনের বিরুদ্ধে। আছে হায়াত তাহরির আল শাম। এরা আল কায়েদার সিরিয় ভার্সন। সৌদি আরবের অর্থ সাহায্যে পরিপুষ্ট। আছে জঙ্গিগোষ্ঠী হরকত আল আহরার ও আল শাম। এসব জঙ্গি গোষ্ঠীর সাথে একই সাথে পূর্ব ঘৌটায় আটকে পড়েছে ফাইলাক আল রহমান নামে একটি দল । বাশার বিরোধী ফ্রি সিরিয়ান আর্মির অন্তর্ভুক্ত ছিলো এরা। এ এলাকার সাড়ে চার লাখ সাধারণ মানুষের মাঝে মিশে গেছে এসব জঙ্গি। তাদের সমূলে উৎপাটন করতেই পূর্ব ঘৌঠায় প্রাণপন বোমা হামলা চালাচ্ছে সিরিয়ার বাহিনী। ১৮ ফেব্রুয়ারি থেকে এই হামলায় কত জন মারা গিয়েছে তার নির্ভুল হিসেব হয়তো দেওয়া সম্ভব না। কিন্তু আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোর খবরকে আমলে নিলে এ হিসেব মানবতার বিপন্নতাকে চোখে আঙুল তুলে দেখিয়ে দিচ্ছে। এখন প্রশ্ন আসছে কয়েকটি। সিরীয় সেনাবাহিনীর এ ধরনের অভিযানের যৌক্তিকতা কতটুকু? নৃশংসতার যে ছবিগুলো আসছে তা কি নিজকই মাঠের পরিস্থিতি নাকি মার খেতে থাকা জঙ্গিদের পক্ষে তাদের পৃষ্ঠপোষকদের স্রেফ প্রপাগান্ডা?

বিজ্ঞাপন

সিরিয় যুদ্ধের সামরিক স্ট্র্যাটেজি দেখলে এটি পরিস্কার সিরিয়া রাশিয়া কোয়ালিশন বাহিনীর এ ছাড়া আর কোন উপায় নেই। রাজধানী দামেস্কের মাত্র দশ কিলোমিটারের মধ্যে থাকা পূর্ব ঘৌটাই হচ্ছে সিরিয়ার শেষ জঙ্গি বিদ্রোহী উপদ্রত অঞ্চল যাকে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরাইলি যে কোন পদক্ষেপ নেওয়ার আগেই মুক্ত করতে হবে। বলা ভালো বাশার আল আসাদের শেষ গলার কাটা হচ্ছে পূর্ব ঘৌটা। এ অঞ্চল থেকে জঙ্গিদের হটিয়ে দিতে পারলেই সিরিয়ায় আমেরিকা এবং ইসরাইলি অক্ষ শক্তির পরাজয় ঘটবে। ইরাকের মসুলও ঠিক এ পদ্ধতিই দখল করেছিলো মার্কিন সমর্থনপুষ্ট ইরাকী সহ কুর্দী এবং শিয়া মিলিশিয়া বাহিনী। সেখানেও জঙ্গিরা সাধারণ মানুষকে মানব ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছিল। এ ধরনের ঘন বসতিপূর্ণ শহুরে অঞ্চলের যুদ্ধে সাধারণ মানুষকে কোন পক্ষ মানবঢাল হিসেবে ব্যবহার করলে আসলে অপর পক্ষের কিছুই করার থাকে না। একে নিছকই একটি যুদ্ধ ভেবে আঘাত করতে হয়। মসুলেও এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে, পূর্ব ঘৌটাতেও ঘটছে। অন্যদিকে পূর্ব ঘৌটায় রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের অভিযোগ নিয়েও আছে বিতর্ক। মূলত পশ্চিমা গণমাধ্যমে উঠে এসেছে এ অভিযোগ। আমেরিকা ইতিমধ্যেই জাতিসংঘে এ অভিযোগ জানিয়েছে। অথচ এখন পর্যন্ত সিরীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে ব্যপক ভিত্তিক রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের কোন নিশ্চিত প্রমাণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দিতে পারে নি। বরং মার্কিন সমর্থিত বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া গেছে অতীতে। মূলত হোয়াইট হেলমেটস নামে পরিচিত আশার আল আসাদ বিরোধী একটি সংস্থাই এই মুহুর্তে পূর্ব ঘৌটার পরিস্থিতি জানাচ্ছে। তাদের বরাত দিয়েই আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো বিভিন্ন খবর তুলে ধরছে। তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়েও আছে প্রশ্ন। ইতিমধ্যেই রাশিয়া এবং সিরিয়ার তরফে রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের কথা অস্বীকার করা হয়েছে। সিরিয়াকে কেন্দ্র করে পশ্চিমা বিভিন্ন শক্তির বক্তব্য এবং মূল ধারার গণমাধ্যম গুলোর সংবাদ একটু পর্যালোচনা করলেই বোঝা যায় ঘৌটাকে দাবার ঘুটি বানিয়ে মানবতা বিরোধী অভিযোগে সিরীয় সরকারের বিরুদ্ধে পাল্টা পদক্ষেপের পরিকল্পনা আটা হচ্ছে। কিন্তু আইএসকে মদদের অভিযোগ যাদের বিরুদ্ধে, অসংখ্য মানবতা বিরোধী অপরাধের তকমা গায়ে আঁটা এসব পক্ষের পূর্ব ঘৌটার জন্য কান্না অনেকেরই হাসির উদ্রেক করেছে।

[এই কলামে উপস্থাপিত সকল মত লেখকের নিজের, সম্পাদক দায়ী নন]

সারাবাংলা/এমএম

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন