বিজ্ঞাপন

কোভিড-১৯ ডট ব্লোট’র গবেষণা প্রটোকলই জমা দেয়নি গণস্বাস্থ্য!

April 28, 2020 | 1:21 am

সৈকত ভৌমিক, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র উদ্ভাবিত করোনাভাইরাস শনাক্তের কিট (জি আর কোভিড-১৯ ডট ব্লোট ) অনুমোদনের জন্য প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে বাংলাদেশ চিকিৎসা গবেষণা পরিষদে (বিএমআরসি) কোনো প্রকার প্রটোকল জমা দেওয়া হয়নি। এমনকি এ বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে অফিসিয়াল কোনো চিঠি বা অন্য কোনো মাধ্যমেও যোগাযোগ করা হয়নি বলে জানিয়েছেন বিএমআরসি’র পরিচালক ডা. মাহমুদ-উজ-জামান। তবে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ বলেছেন, খুব দ্রুতই আমরা প্রটোকল জমা দেবো।

বিজ্ঞাপন

সোমবার (২৭ এপ্রিল) এই বিষয়গুলো নিয়ে বাংলাদেশ চিকিৎসা গবেষণা পরিষদের পরিচালকের সঙ্গে আলাপকালে এ তথ্য উঠে আসে। পরে বিষয়টি নিয়ে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহকে প্রশ্ন করা হলে সারাবাংলার এই প্রতিবেদক তিনি জানান, শিগগিরই তারা প্রটোকল জমা দেবেন।

এদিকে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, যেকোনো নতুন গবেষণা বা আবিষ্কারের ক্ষেত্রে মানুষের উপকারে কতটুকু আসবে তা নিশ্চিত করার জন্য সবসময় কিছু সাবধানতামূলক প্রক্রিয়া অবলম্বন করতে হয়। এক্ষেত্রে অন্যতম হলো উদ্ভাবক প্রতিষ্ঠানকে গবেষণা বিষয়ে একটি প্রটোকল (Protocol) প্রস্তুত করে বাংলাদেশ মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিল (BMRC)-এর ন্যাশনাল রিসার্চ এথিক্স কমিটিতে পাঠাতে হবে। সেখানে অনুমোদনের পরেই প্রটোকলটি ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরের ন্যাশনাল ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালস অ্যাডভাইসারি কমিটিতে যাবে। সেখান থেকে অনুমোদনের পরে ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল করতে হবে, যা আইন অনুযায়ী হতে হবে একটি থার্ড পার্টি বা কন্ট্র্যাক্ট রিসার্চ অর্গানাইজেশনের (সিআরও) মাধ্যমে। এই ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের সব ধাপ সম্পন্ন হলেই কেবল চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দিতে হবে ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরে। সেই ট্রায়ালের সফলতা সাপেক্ষে চূড়ান্ত অনুমোদন আসে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন ড্রাগ কন্ট্রোল কমিটি থেকে। এইগুলো আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত প্রক্রিয়া। এইক্ষেত্রে প্রটোকল তৈরি করে তা জমা দেওয়াই হচ্ছে প্রথম কাজ।

আরও পড়ুন: ‘গণস্বাস্থ্যের কিটে শতভাগ নির্ভুল টেস্ট, সময় লাগবে ৫ মিনিট’

বিজ্ঞাপন

বাংলাদেশ চিকিৎসা গবেষণা পরিষদের (বিএমআরসি) পরিচালক ডা. মাহমুদ-উজ-জামান সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের কাছে অফিসিয়ালি গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের পক্ষ থেকে কোনো চিঠি বা কোনো অ্যাপ্রোচ করা হয়নি। যদি সেই অ্যাপ্রোচ করা হয় তবে আমরা খুব দ্রুততার সঙ্গে তা নিয়ে কাজ করব। আমাদের ওয়েবসাইটেই এই বিষয়ে বিস্তারিত আছে। আমরা অনলাইনেও এই ধরণের গবেষণার পেপার নিচ্ছি এখন।’

তিনি বলেন, ‘যেভাবে এ বিষয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে কথা বলা হচ্ছে তাতে জনগণের কাছে একটা ভুল তথ্য যাচ্ছে। আমরা চাই সত্য ও সঠিক বিষয় সবার সামনে যাক। বিজ্ঞান একটি জটিল প্রক্রিয়া। যেহেতু এটা সরাসরি মানুষের জীবনের সঙ্গে জড়িত তাই টেস্ট কিট গবেষণা বিষয়েও একটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়।’

তিনি আরও বলেন, ‘এটা শুধু বাংলাদেশের জন্য নয়, বিশ্বব্যাপী প্রচলিত একটি নিয়ম আছে এক্ষেত্রে। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র যেটা উদ্ভাবন করেছেন সেটি হলো একটি ডায়াগনস্টিক কিট। এটিকে বলতে পারেন একটি টেস্টিং কিট বা ডিভাইস। আবার ধরুন কোনো নতুন ওষুধ বা ড্রাগ। এগুলো তৈরি করার জন্য যখন গবেষণা করবেন কোনো ল্যাবে তখন এটা প্রক্রিয়াজাতকরণের জন্য ভ্যালিডেশন করতে হয়। এক্ষেত্রে সেটিকে সাকসেসফুল ঘোষণা দেওয়ার আগে পরীক্ষা করতে হয়। সেটার জন্য প্রথম যে বিষয় প্রয়োজন তা হলো একটা প্রটোকল তৈরি করে তার ইথিক্যাল অ্যাপ্রুভাল নেওয়া।’

বিজ্ঞাপন

আরও পড়ুন: জাফরুল্লাহর অভিযোগ অস্বীকার ড. বিজনের

ডা. মাহমুদ-উজ-জামান বলেন, ‘উনারা খুবই ভালো কাজ করছেন। আমরা এটাকে উৎসাহিত করি। আমাদের দেশে এমন ধরণের নতুন কিছু আসুক সেটা আমরাও চাই। কিন্তু কিছু নিয়ম তো মানতে হবে। উনারা এই ধরণের কোনো কিছুই মানেননি বা সেজন্য কোনো আবেদনও করেননি। জনগণের সামনে এই ধরণের গবেষণা নিয়ে যেকোনো বিষয়ে বলার আগে কীভাবে সেটি প্রকাশ করব তার কিছু প্রক্রিয়া থাকে। জনগণকে তো দেখাতে হবে যে, আমার এই গবেষণা এত শতাংশ সফল হয়েছে, মানে এটা কাজ করছে। এই বিষয়টি যিনি গবেষণা বা আবিষ্কার করবেন তাকেই করতে হবে। আর এক্ষেত্রে কিছু প্রক্রিয়া আছে তার মধ্য দিয়েই করতে হয়। সেই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার জন্য একটা ইথিক্যাল অনুমোদন নিতে হয়।’

তিনি জানান, অনুমোদন দেওয়ার জন্য বাংলাদেশে জাতীয় পর্যায়ের একটি কমিটি আছে, যাকে ন্যাশনাল রিসার্চ ইথিকস কমিটি বলে। সেটা বিএমআরসির অধীনে একটি স্বাধীন কমিটি। সেই কমিটির অনুমোদন নিতে হয়। এটা সব কিছুর ক্ষেত্রেই। সেটা হোক ড্রাগ বা কোনো ডিভাইস। এটা বিশ্বব্যাপী সব দেশেরই স্বীকৃত প্রক্রিয়া।

তিনি বলেন, ‘বিশ্বব্যাপী বর্তমানে কোভিড-১৯ পরিস্থিতির কারণে সবদেশেই প্রায় তিন সপ্তাহ আগে থেকে অনলাইনে এই ধরণের গবেষণা বা ডিভাইসের প্রটোকল বিষয়ে জানাতে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার উদ্যোগে জেনেভা থেকে একটি কনফারেন্সের আয়োজন করা হয়েছিল। সেখানে প্রায় ১১৩টি দেশের ইথিকস কমিটির সদস্য, সেক্রেটারি ও চেয়ারম্যানদের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। আমিও ছিলাম সেই আলোচনা। সেখানে কোভিড-১৯ বিষয়ক যেকোনো গবেষণাকে উৎসাহিত করার জন্য একটা ফাস্ট ট্র্যাকিং সিস্টেম করা হয়েছে। আমরা সেই সিস্টেমগুলোই ফলো করছি।’

বিজ্ঞাপন

আরও পড়ুন: গণস্বাস্থ্যের কিট পরীক্ষার খরচ দেবে সুচিন্তা ফাউন্ডেশন

তিনি আরও বলেন, ‘যেকোনো বিষয়ের কিছু প্রটোকল থাকে। সেই প্রটোকলও আমাদের ওয়েবসাইটে দেওয়া আছে। সেখানে কীভাবে প্রটোকল সাবমিট করতে হবে তাও দেওয়া আছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে ড. বিজন কুমার শীলকে চিনি। তিনি সিঙ্গাপুরে ছিলেন এক সময়। উনার সঙ্গে যারা আছেন তাদেরকেও আমি চিনি। উনারা সবাই এই প্রক্রিয়াগুলো সম্পর্কে জানেন। যারা বিদেশে কাজ করে এসেছেন তারা আরও ভালো করে জানেন যে, এই সিস্টেমের মধ্য দিয়েই যেতে হয়।’

ডা. মাহমুদ-উজ-জামান বলেন, ‘ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী একজন সম্মানিত ব্যক্তি। তিনি দীর্ঘদিন এই ড্রাগ নিয়ে কাজ করছেন। উনারও এ বিষয়ে জানার কথা যে, প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে গিয়েই পৃথিবীব্যাপী কাজ করতে হয়। এটা যে খুব জটিল প্রক্রিয়া তাও না। এটা খুবই স্বাভাবিক একটা প্রক্রিয়া।

ক্লিনিক্যাল ভ্যালিডেশন ছাড়া কি কোনো গবেষণাকে আবিষ্কার বলা যায়?- এমন প্রশ্নের জবাবে ডা. মাহমুদ-উজ-জামান বলেন, ‘সেটা আসলে কোথাও হয় না। শুধুমাত্র আমাদের দেশেই নয়, বিশ্বের কোনো দেশেই এমনটা হয় না। একটা কিট আবিষ্কার করলাম। এটা অবশ্যই ভালো জিনিস। আমাদের জন্য এটা একটি ভালো খবর। কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না যে, কোভিড-১৯ একটা বৈশ্বিক মহামারি। যেখানে সবাই দেখছে সবকিছু। এক্ষেত্রে একটা কিট আবিষ্কার কিন্তু সম্মানেরও বিষয়। কিন্তু সেখানে এমন কিছু করা যাবে না যেখানে নিয়মের বাইরে গিয়ে হাস্যকর একটা অবস্থায় পড়তে হয়। এক্ষেত্রে দেখতে হবে সেই কিটের একসেপটিবিলিটি কতটুকু, তার কতটুকু অ্যাকুরেসি আছে।’

বিএমআরসিতে অনলাইনেই প্রটোকল সাবমিট করা যায়। কিন্তু তাও কেন করা হয়নি এমন প্রশ্নের জবাবে ডা. জাফরুল্লাহ সারাবাংলাকে বলেন, ‘অনলাইনে আমরা দিতে চাই। কিন্তু সেখানে কতগুলো বিষয় আছে যেগুলো না হলে তারা একসেপ্ট করে না। সেটা আমরা তাদেরকে আগেই জানিয়েছি, এখনই দিয়ে দেবো। বিএমআরসিকে অবশ্যই দেবো। আমাদের কোনো অসুবিধা নেই। আমাদের শুধু একটাই আপত্তি যে, দীর্ঘসূত্রিতা কমাতে হবে। সাতদিনের মধ্যে এটার উত্তর হওয়া উচিত।’

বিএমআরসিতে খুব দ্রুতই আমরা প্রটোকল জমা দেওয়ার কথা জানিয়ে ডা. জাফরুল্লাহ বলেন, ‘আমাদের তো সবকিছুই রেডি। আমাদের তো আগে জিনিসটা তৈরি করা দরকার। বিএমআরসি তো দেখবে এথিক্যাল। ওরা যেদিন চাইবে সেদিনই জমা দিতে পারি আমরা।’

গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের এই ট্রাস্টি বলেন, ‘আমরা তো তাদের অনুমোদন চাই। পাঠিয়ে দেবো। আজকেই আমরা সব পাঠিয়ে দেবো। আমাদের সব তৈরি আছে।’

সারাবাংলা/এসবি/পিটিএম

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন