বিজ্ঞাপন

করোনাকালেও প্রতিদিন ২৪ হাজার মানুষকে খাবার দিচ্ছে বিদ্যানন্দ

May 6, 2020 | 10:09 am

রাজনীন ফারজানা

ক্ষুদ্র এক ভাইরাস যখন দাবড়ে বেড়াচ্ছে দুনিয়াময়, তখনো কিছু মানুষকে ক্ষুধা পেটে নিয়ে ঘুমাতে যেতে হচ্ছে। ভাইরাস নয়! তাদের একটাই চিন্তা আগামীকাল কী খাবে? এইসব মানুষদের যাতে ক্ষুধা পেটে ঘুমাতে না হয়—তাই নিজেদের ঘুম, খাওয়া, বিশ্রাম ভুলে ত্রাণ নিয়ে ছুটছেন কিছু তরুণ। নিরন্ন মানুষগুলোকে খুঁজে খুঁজে পৌঁছে দিচ্ছেন খাবার, শহরময় ছেটাচ্ছেন জীবাণুনাশক।

বিজ্ঞাপন

দেশের অন্যতম বৃহৎ স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন-এর শিক্ষার্থীরাই হলেন সেই তরুণরা। যারা একই সঙ্গে লড়ে চলেছেন ভাইরাস আর ক্ষুধার বিরুদ্ধে।

আনন্দের সঙ্গে বিদ্যার্জনের নীতিতে যাত্রা শুরু করেছিল বিদ্যানন্দ। মূলত সুবিধাবঞ্চিত পথশিশু বা বস্তির শিশুদের জন্য কাজ করতো তারা। ছিন্নমূল শিশুদের লেখাপড়া শেখানো, খাবারের বন্দোবস্ত করাই ছিল সংগঠনটির মূল কাজ। কিন্তু যে শিশুদের লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করতে চান, তারা যেন মাথা উঁচু করে বাঁচে তাই শুরু হল ‘এক টাকায় আহার’ নামের অভিনব এক উদ্যোগ। শিশুরা এক টাকার বিনিময়ে খাবার কিনে খেত পেটভরে।

পাশাপাশি তারা শুরু করেছিল পাঁচ টাকায় বাসন্তি স্যানিটারি প্যাড নামের আরও এক উদ্যোগ। বিদ্যানন্দের কার্যালয়েই সুবিধাবঞ্চিত নারীরা নিজস্ব গার্মেন্টসে এই প্যাড বানায়। তাদের সবশেষ উদ্যোগ ছিল, শুধুই মেয়েদের জন্য ‘বাসন্তী নিবাস’ নামের ক্যাপস্যুল হোটেল।

বিজ্ঞাপন

দেশে করোনা শুরু হতেই মানুষের জন্য ত্রাণ ও সাহায্য নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন। তখনই টার্গেট নিয়েছিল, ২ লাখ পরিবারকে ত্রাণ সহায়তা দেবে। এখন পর্যন্ত ১ লাখ ৮০ হাজার পরিবারের কাছে ত্রাণ পৌঁছে দিতে পেরেছেন বলে জানালেন বিদ্যানন্দের ঢাকা বিভাগীয় প্রধান সালমান খান ইয়াসিন।

এসব ত্রাণ বিতরণে প্রশাসনের পূর্ণাঙ্গ সহযোগিতা পাচ্ছেন তারা। পুলিশ বাহিনী তো বটেই, সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, কোস্ট গার্ড, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ ও র‍্যাবের মাধ্যমে দেশব্যাপী মানুষের দোর গোড়ায় পৌঁছে দিচ্ছেন ত্রাণ সামগ্রী। প্রশাসন ছাড়াও বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন তাদের ত্রাণ বিতরণে সাহায্য করছে।

বিজ্ঞাপন

সালমান জানালেন, এই মুহূর্তে ত্রাণের চাহিদা প্রচুর। তারা হয়তো দুই শতাংশ ত্রাণের চাহিদা পূরণের চেষ্টা করছেন। অনেকেই এগিয়ে আসলেও তা যথেষ্ট নয়। দিনে হয়ত একশটা ভিন্ন ভিন্ন জায়গা থেকে ত্রাণের জন্য কল আসে কিন্তু সবাইকে দিতে পারেন না। তবে যে এলাকায় একসঙ্গে অনেকগুলো চাহিদা আসে, সেখানেই যান তারা। তবে যাদের কাছে পৌছাতে পারেন না, তাদের জন্য কষ্ট ঠিকই হয়। এক্ষেত্রে মন খারাও হলেও কিছুই করতে পারেন না। এমন অবস্থায় আরও মানুষ সাহায্য নিয়ে এগিয়ে আসলে ভালো হত বলে মনে করেন সালমান।

এভাবে প্রতিদিন ৮ হাজার পরিবারের কাছে ত্রাণ পৌঁছে দিচ্ছে বিদ্যানন্দ। প্রতি পরিবারের জন্য তাদের খরচ ১০১ টাকা। সেক্ষেত্রে ৮ লাখ ৮ হাজার টাকা।

এই বিপুল অংকের টাকার পুরোটাই আসে মানুষের ডোনেশন থেকে। দেশ এবং বিদেশের বাংলাদেশিদের দেওয়া টাকা থেকেই চলে এই বিপুল কর্মযজ্ঞ। ব্যক্তি পর্যায়ে ছাড়াও দেশীয় শিল্প প্রতিষ্ঠান, বেসরকারি ব্যাংক, এনজিও থেকেও আসে বড় অংকের অনুদান। এই করোনাকালে সেই প্রাতিষ্ঠানিক অনুদানের পরিমাণ দাঁড়াচ্ছে ১০ লাখ থেকে কোটি টাকা।

কথায় কথায় জানতে চাইলাম, সর্বনিম্ন অনুদানের পরিমাণ কেমন হতে পারে। সালমান জানালেন এক টাকা! অবাক হলাম। তখন তিনি ভেঙে বললেন ব্যাপারটা। বিকাশ অ্যাপে বিদ্যানন্দকে ডোনেশনের একটা অপশন আছে। সেখানে এক টাকা, দুই টাকা বা পাঁচ টাকাও পাঠান অনেকে। আর এভাবেই সংখ্যাটা দাঁড়ায় লক্ষাধিক। আবার স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা টাকা তুলে পাঠান তাদের কাছে। এছাড়া তাদের বিকাশ নাম্বারে ব্যক্তিগত অনুদান তো পৌঁছাচ্ছেই।

বিজ্ঞাপন

মানুষের এইসব ভালোবাসা আর ভরসার প্রতিদান দেওয়ার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেন বিদ্যানন্দের এই তরুণ স্বেচ্ছাসেবকরা। নিজেদের সুখ, সুবিধা, আরাম আয়েশ তো বটেই, পরিবারের নিরাপত্তার জন্য দিনের পর দিন ঘরেও ফিরছেন অনেকে।
এই রোজার মাসে রাতভর ত্রাণ ও খাবার বিলি করে নিজেরা হয়তো রাস্তার ধারে ধারে বসেই খেয়ে নিচ্ছেন এক প্যাকেট ত্রাণের খাবার।

শুধুই ত্রাণ নয়, মার্চের শুরু থেকেই তারা শহরময় জীবাণুনাশক ছিটাচ্ছেন নিজ উদ্যোগে। এ বিষয়ে সালমান জানালেন, জীবাণুনাশক দিচ্ছে দেশের নামকরা একটি কেমিক্যাল ফ্যাক্টরি। তাদের সাহায্যেই বিদ্যানন্দের স্বেচ্ছাসেবকরা প্রতিদিন ঢাকা ও চট্টগ্রামে ৬ হাজার লিটার জীবাণুনাশক ছিটাচ্ছেন। বিশেষত হাসপাতালগুলোর আশেপাশে।

ত্রাণ ছাড়াও তারা ঢাকা ও চটগ্রামে প্রতিদিন ২৪ হাজার মানুষের কাছে রান্না করা খাবার পৌঁছে দিচ্ছেন বিদ্যানন্দের কর্মীরা। ঢাকার খিলগাঁওয়ের শাহাজাহানপুরে রান্না হয় এই বিপুল পরিমাণের খাবার। বিশ জন পেশাদার বাবুর্চির সঙ্গে হাত লাগিয়েছেন প্রতিষ্ঠানের স্বেচ্ছাসেবীরা।

এসব বাজার মূলত ঢাকা থেকেই কেনা হয়। এছাড়া ঢাকার বাইরে থেকে কৃষকের কাছ থেকে সবজি কিনে আনা হচ্ছে যা দিয়ে তারা বিভিন্ন জায়গায় ওপেন বাজার ব্যবস্থা চালু করেছেন। ওপেন বাজার মানে সেখানে কোনো কেনাবেচা নাই। পিকআপ ভর্তি সবজি বা ফলমূল ঢেলে রাখা হয়। সুবিধাবঞ্চিত মানুষ ইচ্ছামত নিয়ে যান।

রান্না করা খাবারের সঙ্গে দেওয়া হয় ডিম ও মুরগির মাংস। এতদিন দিনে ৬ শ কেজি মুরগির মাংস কিনতেন বলে জানালেন সালমান। তবে এখন থেকে একটা প্রতিষ্ঠান বিনামূল্যে মুরগির মাংস দেবেন বলে জানিয়েছেন। আর বিদ্যানন্দের ‘এক টাকায় আহার’ প্রকল্পের সময় থেকেই প্রতিদিন ডিমের চাহিদা পূরণ করে দেশের একটি নামকরা অ্যাগ্রো ফার্ম লিমিটেড। এখন এই করোনার সময়ে তারা প্রতিদিন ১৮ থেকে ২০ হাজার পিস ডিম সাপ্লাই দিচ্ছেন।
এছাড়া কেউ এসে দিয়ে যান সবজি, কেউ চাল, কেউ ডাল আবার কেউ বা কয়েকটা মুরগি। যার যতটুকু সামর্থ্য তাই নিয়ে দাঁড়িয়েছেন মানুষের পাশে।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখে থাকবেন অনেকে, তারা সারারাত ত্রাণ ও খাবার পৌঁছে দিচ্ছেন মানুষের দ্বারে দ্বারে। তাহলে এই ছেলেগুলো খায় কী? ঘুমায় বা কোথায়?

বিদ্যানন্দের কার্যালয় এখন লকডাউন। নারী ভলান্টিয়াররা সেখানে অবস্থান করছেন। যোগাযোগ থেকে শুরু করে ব্যাক এন্ডের সমস্ত কাজ তারাই সামলাচ্ছে। আর পথে পথে ছুটে বেড়াচ্ছে যে ছেলেগুলো, তারা থাকছে খিলগাঁওয়ের শাহাজাহানপুরের এক মাদরাসায়। যেখানে তাদের খাবার রান্না হয়। করোনার সাধারণ ছুটির কারণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় এই মসজিদ সংলগ্ন মাদ্রাসাটিও বন্ধ। ছাত্র না থাকায় মাদরাসার অধ্যক্ষ তাদের জন্য কিছু ঘরে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। ছেলেগুলো সেখানেই মেঝেতে ঘুমায় ঢালাও বিছানায়। এদের সবাই যে ঢাকার বাসিন্দা তা কিন্তু না। ঢাকার বাইরে থেকে তাদের সেরা সব স্বেচ্ছাসেবকদের ঢাকায় আনা হয়েছে এই করোনা পরিস্থিতি সামাল দিতে। প্রত্যেকেই ছাত্র। বয়সও কম। এই তরুণরাই যেন কাঁধ যেন তুলে নিয়েছে মানবতার ভার। এভাবেই এগিয়ে যাবে, এই প্রত্যাশায়।

সারাবাংলা/আরএফ/পিটিএম

Tags: , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন