বিজ্ঞাপন

বন্ধ স্কুল-কলেজে টিউশন ফি দিতে চাপ

May 6, 2020 | 8:57 pm

তুহিন সাইফুল, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: নভেল করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) মহামারিতে পুরো পৃথিবীই থমকে গেছে। বাংলাদেশও এর বাইরে নেই। সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে ভাইরাসটির বিস্তার রোধের চেষ্টা করছে সরকার। করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি কমাতে গত ১৮ মার্চ থেকে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ঈদুল ফিতরের আগে এসব প্রতিষ্ঠান খোলার কোনো সম্ভাবনাও নেই। এদিকে বন্ধের সময়ও অনেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান টিউশন ফি আদায়ে শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকদের নানাভাবে চাপ প্রয়োগ করছে বলে অভিযোগ উঠেছে। যদিও ঢাকা মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড সম্প্রতি এক জরুরি নির্দেশনায় টিউশন ফি ও বেতন আদায়ে শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের চাপ না দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে।

বিজ্ঞাপন

করোনাকালে সরকারি নির্দেশনা অমান্য করে টিউশন ফি আদায়ে অভিভাবকদের কাছে বিকাশ নম্বরও পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। অনেক প্রতিষ্ঠান আবার বেতন আদায়ে ফোন করে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের চাপ প্রয়োগ করছে। আবার এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই নিজেদের শিক্ষক-কর্মচারীদের বাকেয়া বেতন দিতে টালবাহানা করছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন অভিভাবক সারাবাংলাকে বলেন, আমার সন্তান সাউথ-পয়েন্ট স্কুলের মালিবাগ শাখার শিক্ষার্থী করেন। গত কয়েকদিন ধরেই স্কুল থেকে টিউশন ফি দেওয়ার জন্য তার মোবাইল ফোনে মেসেজ পাঠানো হচ্ছে। এমনকি ফোন করেও টাকা চাওয়া হচ্ছে।’ এই স্কুলটি নিয়ে একই অভিযোগ করেছেন আরও কয়েকজন অভিভাবক।

কেবল সাউথ-পয়েন্ট নয়, রাজধানীর প্রায় সবগুলো বেসরকারি বাংলা ও ইংরেজি মাধ্যম স্কুল নিয়ে একই অভিযোগ করছেন অভিভাবকরা। লকডাউনের সময় কোনো ধরনের শিক্ষা কার্যক্রম না থাকলেও বেতন আদায় করতে নিয়মিত ‘বিরক্ত’ করা হচ্ছে। কখনো কখনো ‘হুমকি’ও দেওয়া হচ্ছে বলে জানান তারা। একজন অভিভাবক অভিযোগ করে জানান, তার সন্তানকে লকডাউন শেষে স্কুল থেকে বহিষ্কার করা হবে বলে হুমকি দেওয়া হয়েছে। কারণ তিনি দুইমাস ধরে বেতন পরিশোধ করতে পারছেন না।

বিজ্ঞাপন

অভিভাবক ঐক্য ফোরামের সভাপতি জিয়াউল কবির দুলু সারাবাংলাকে বলেন, ‘এমন পরিস্থিতিতে অভিভাবকদের কাছে টিউশন ফি চাওয়া অমানবিক। কারণ অনেকেই লকডাউনের কারণে বেকার হয়ে ঘরে বসে আছেন। দোকান-পাট বন্ধ হয়ে গেছে। অফিস বন্ধ, আয় বন্ধ। এই অবস্থায় স্কুলের বেতন দেবে কিভাবে? স্কুলগুলো ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মতো কোনো ঔপনিবেশিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান নয় যে, শিক্ষার্থীদের ভোক্তা গণ্য করবে। এমন মানসিকতা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। তারা দীর্ঘদিন ব্যবসা করেছে। এই দুঃসময়ে কাবুলিওয়ালা মানসিকতা ত্যাগ করতে হবে।’

বিষয়টি নিয়ে শেলের টেক ইংলিশ ভার্সন স্কুলের অধ্যক্ষ আঞ্জুমান লায়লার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘বেসরকারি স্কুলগুলো শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি’র ওপর নির্ভর করে পরিচালিত হয়। এ ছাড়া আমাদের আর কোনো আয়ও নেই। আমাদের এত এত শিক্ষক-কর্মকর্তা, তাদের বেতন দিতে হবে না? তারা সংসার চালাবেন কীভাবে? অভিভাবকরা শিক্ষার্থীদের বেতন দিতে চাচ্ছেন না; কিন্তু শিক্ষকরা যে অনাহারে থাকবেন, সেটা ভাবছেন না।’

তিনি বলেন, ‘অভিভাবকদের মধ্যে যাদের সামর্থ্য নেই তাদের বিষয়টি বিবেচনা করা হবে কিন্তু যাদের সামর্থ্য আছে তারা কেন বেতন দেবেন না?’

বিজ্ঞাপন

নাম প্রকাশ না করার শর্তে আরেকজন অধ্যক্ষ বলেন, ‘শিক্ষক কর্মকর্তাদের বেতন বাদই দিলাম, আমাদেরকে এই লক ডাউনেও নিয়মিত ভবন ভাড়া দিতে হচ্ছে। এই টাকাটা তো শিক্ষার্থীদের বেতন থেকে নিয়েই পরিশোধ করি, এখন সেটাও যদি বন্ধ হয়ে যায় তাহলে আমাদের পথে বসতে হবে। মার্চ-এপ্রিল গিয়েছে, মে মাসে কী করব? এরপর জুন-জুলাই রয়েছে। এই পরিস্থিতি যদি না বদলায় তাহলে তো আমাদের জন্য বড় বিপদ অপেক্ষা করছে।’ করোনাকালে তিনি অভিভাবকদের ‘মানবিক আচরণ’ করার আহ্বান জানান।

তবে টিউশন ফি আদায়ে প্রতিষ্ঠানগুলোকে ‘ভালো ব্যবহার’র পরামর্শ দিয়েছেন বাংলাদেশ ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক জি এম নিজাম উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘এই সময়ে অভিভাবকরা টিউশন ফি দিতে অপারগতা প্রকাশ করলে তাকে চাপ দেওয়া যাবে না। আমাদের সময় বুঝতে হবে। সময়ের দায়িত্ব বুঝতে হবে। আবার অভিভাবদের মধ্যে যাদের সামর্থ্য আছে তাদেরও স্কুলগুলোর পাশে দাঁড়াতে হবে। কারণ এই স্কুলগুলো না বাঁচলে তাদের সন্তানেরা পড়বে কোথায়?’

এ ব্যাপারে ঢাকা মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান মু. জিয়াউল হক বলেন, ‘টিউশন ফি আদায়ে কোনো প্রকারের জোর, জবর-দস্তি করা যাবে না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কোনো ব্যবসার জায়গা নয়, এটা মনে রেখে প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করতে হবে। ফি আদায়ে অভিভাবকদের হেনস্থা করা হলে আমরা পরিচালনা পর্ষদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেব।’

এদিকে করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে সারাদেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের মাসিক বেতন মওকুফ চেয়ে সরকারের কাছে আবেদন করেছেন সুপ্রিম কোর্টের দুই আইনজীবী। সোমবার (৪ মে) ল অ্যান্ড লাইফ ফাউন্ডেশনের পক্ষে ব্যারিস্টার মো. হুমায়ন কবির পল্লব ও ব্যারিস্টার মোহাম্মদ কাউসার শিক্ষা সচিব বরাবর এ আবেদন করেন। আবেদনে সব সরকারি বেসরকারি স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আদায়যোগ্য মাসিক বেতনের অর্ধেক পরিমাণ মওকুফ করার জন্য অনুরোধ করা হয়। এছাড়া বিষয়টি বিবেচনা করে আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে আবেদনকারীকে জানানোর জন্যও এতে অনুরোধ করা হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

এর আগে করোনাভাইরাসের সংকটময় পরিস্থিতিতে দেশের সব ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের ৫০ শতাংশ টিউশন ফি মওকুফের জন্য স্কুল কর্তৃপক্ষের কাছে দাবি জানিয়েছিলেন উত্তরার দিল্লি পাবলিক স্কুলের (ডিপিএসএসএসটি) অভিভাবক ফোরামের সভাপতি ব্যারিস্টার ওমর ফারুকও।

এদিকে টিউশন ফি মওকুফে অভিভাবকদের দৌড়ঝাঁপের বিপরীতে বসে নেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মালিকেরাও। এরই মধ্যে কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষক-কর্মচারীদের জন্য ৫০ কোটি টাকার প্রণোদনা চেয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে প্রস্তাব পাঠিয়েছেন বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন অ্যাসোসিয়েশন। সংগঠনের চেয়ারম্যান মনোয়ারা ভূঁইয়া ও মহাসচিব মো. মিজানুর রহমানের সই করা ওই প্রস্তাবে বলা হয়েছে, সম্পূর্ণ শিক্ষার্থীদের বেতনের ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় কিন্ডারগার্টেনের ছয় লাখেরও বেশি শিক্ষক-কর্মচারী মানবেতর দিন কাটাচ্ছেন। কিন্ডারগার্টেন যদি না থাকত, তাহলে সরকারকে আরও ২৫ থেকে ৩০ হাজার বিদ্যালয় স্থাপন করে প্রতি মাসে শিক্ষকদের বেতন বাবদ কোটি কোটি টাকা ব্যয় করতে হতো। বর্তমান প্রেক্ষাপটে এ প্রতিষ্ঠানগুলো টিকিয়ে রাখার স্বার্থে প্রধানমন্ত্রীর প্রায় লাখ কোটি টাকার প্রণোদনা থেকে আমাদের জন্য ৫০ কোটি টাকা বরাদ্দের দাবি জানাচ্ছি।

উল্লেখ্য, গত ২৩ এপ্রিল এক জরুরি নির্দেশনায় চাপ দিয়ে টিউশন ফি আদায় না করার আহ্বান জানায় ঢাকা মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড। এতে বলা হয়, দেশে করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতি বিরাজমান থাকায় এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের মাসিক বেতন এবং অন্যান্য খাতে গৃহীত ফি আদায়ে এই মুহূর্তে চাপ প্রয়োগ না করার জন্য অনুরোধ করা হলো। পরবর্তী সময়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিলে বা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরলে বকেয়াসহ মাসিক বেতন ও অন্যান্য ফি আদায়ে নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো।

এই নির্দেশনা পাঠদান ও স্বীকৃতিপ্রাপ্ত সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধানদের জন্য প্রযোজ্য হবে বলেও উল্লেখ করা হয়।

সারাবাংলা/টিএস/পিটিএম

Tags: , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন