বিজ্ঞাপন

করোনাকালে সহিংসতার শিকার পুরুষ, হটলাইন স্থাপন ও পুরুষতান্ত্রিকতা

May 8, 2020 | 2:06 pm

শাহনেওয়াজ

সম্প্রতি জার্মানির বাভারিয়া ও নর্থ রাইন অঙ্গরাজ্যে সে দেশের কর্তৃপক্ষ পারিবারিক সহিংসতার শিকার পুরুষের জন্য হটলাইন স্থাপন করেছে। বাভারিয়ার পরিবার কল্যানমন্ত্রী ক্যারোলিনা টার্টনার ও নর্থ রাইন-ওয়েষ্টফালিয়ার সমঅধিকার মন্ত্রনালয়ের মন্ত্রী ইনা স্কারেনবাখ একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে এই দুই অঙ্গরাজ্যে পারিবারিক সহিংসতার শিকার পুরুষের জন্য হটলাইন স্থাপনের তথ্য জানিয়েছেন। এছাড়া জার্মানির অন্যান্য রাজ্য সরকারকে এই ধরণের উদ্যোগ নেওয়ার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন তাঁরা।

বিজ্ঞাপন

কিছু ব্যতিক্রম বাদে সাধারণত নারীরাই সারা বিশ্বজুড়ে পারিবারিক সহিংসতার শিকার হন। করোনাকালেও পরিস্থিতি কিন্তু একেবারেই বদলায়নি। তবে পৃথিবীর সব দেশেই নারীদের পারিবারিক সহিংসতা থেকে রক্ষার জন্য হটলাইন আছে। এই প্রথম কোন দেশে পারিবারিক সহিংসতার শিকার পুরুষদের জন্য হটলাইন স্থাপিত হয়েছে। বাংলাদেশেও ‘বাংলাদেশ ম্যানস রাইটস ফাউন্ডেশন’  নামক একটি সংগঠন পুরুষ নির্যাতনের বিরদ্ধে আইন প্রণয়নের জন্য দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করে আসছে। বাংলাদেশে পুরুষ নির্যাতন প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক সালমা আক্তার বিবিসিতে বলেছেন, পুরুষরা নির্যাতনের শিকার হতে পারেন, তবে কতটা হচ্ছেন তা নিয়ে কোনো গবেষণা হয়নি বা গ্রহণযোগ্য তথ্য উপাত্ত এখনো নেই। লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার এই নতুন ধরণের মাত্রা অপরাধ বিজ্ঞানী এবং সমাজ বিজ্ঞানীদের নিঃসন্দেহে ভাবিত করে তুলবে।

পরিবারের মধ্যে যাদের অবস্থান দুর্বল তারাই পারিবারিক সহিংসতার শিকার হয়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব মতে, বাংলাদেশের অধিকাংশ নারীরাই পারিবারিক সহিংসতার শিকার হয়। পারিবারিক সহিংসতা রোধ করার জন্য সরকার নারী নির্যাতন দমন আইন, যৌতুক প্রথা নিরোধ আইন, পারিবারিক সহিংসতা প্রতিরোধ আইন, বাল্য বিবাহ নিরোধ আইন, নারীবান্ধব নীতিসহ অনেক পদক্ষেপ নিয়েছে। সরকারের এই কাজে সহযোগী হিসেবে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা, আন্তর্জাতিক দাতা গোষ্ঠী, অধিকারকর্মীসহ বিভিন্ন অংশীজন নারীর শিক্ষা, পুষ্টি, কর্ম ইত্যাদি ক্ষেত্রে কাজ করে যাচ্ছে।

দুই হাজার সালকে যদি ভিত্তি বছর ধরে হিসাব করি তাহলে দেখব গত বিশ বছরে শিক্ষায়, কর্মে, সমাজে, রাষ্ট্রে নারীরা আগের তুলনায় অনেক এগিয়ে এসেছে কিন্তু পারিবারিক সহিংসতার হার গত বিশ বছরে তেমন একটা কমেনি। নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের মাধ্যমে পারিবারিক সহিংসতা অনেকাংশে রোধ করা যায়। কিন্তু নারীরা অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হলেই সব সময় নিজেকে সহিংসতার হাত থেকে রক্ষা করতে পারে না। কারণ অর্থনৈতিকভাবে তারা স্বাবলম্বী হলেও সাংস্কৃতিক ও সামাজিক কারণে তারা পরিবার ও সমাজে সামগ্রিকভাবে নিজেকে রক্ষা করতে পারে না। ঢাকা ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সাবেক শিক্ষক রুমানা মঞ্জুর শিক্ষা ও পেশাগত জীবনে সফল হলেও তার নিজের পরিবারের মধ্যেই চরম পারিবারিক সহিংসতার শিকার হয়েছিলেন। এই ধরনের উদাহরণ ভূরি ভূরি দেওয়া যাবে। যেসব নারী অর্থনৈতিক ভাবে স্বাবলম্বী তারা অনেকসময় এমন পরিস্থিতিতে পড়ে যেখানে হয় তাদের নিরবে সহিংসতা সহ্য করে নিতে হয় নতুবা বিবাহ বিচ্ছেদের আশ্রয় নিতে হয়। আর যেসব নারী জীবিকার জন্য তার পরিবারের পুরুষ সদস্যের উপর নির্ভরশীল তাদের নীরবে অত্যাচার সহ্য করা ছাড়া উপায় থাকে না। এটাই আমাদের দেশের এবং উপমহাদেশের বাস্তব চিত্র।

বিজ্ঞাপন

সাধারণত নারীরা পুরুষ দ্বারা লিঙ্গ ভিত্তিক বৈষম্য বা সহিংসতার শিকার হয়। কিন্তু অনেকসময় নারীরাও লিঙ্গ ভিত্তিক বৈষম্য বা সহিংসতা করেন। যেমন কোন নারী যদি বিবাহ বিচ্ছেদ করেন তাহলে সমাজে বা নিজের পরিবারের মধ্যে নারীরাই সবচেয়ে তাদের কটূক্তি করে। যৌতুকের দাবিতে যেসব পারিবারিক সহিংসতা হয় সেখানে দেখা যায় পুরুষের পাশাপাশি পরিবারের নারী সদস্যরাও দায়ী। অনেক পরিবারে দেখা যায় ননদ -শাশুড়ি ছেলের বৌয়ের উপর অত্যাচার করে। আবার ছেলের বৌ অত্যাচার করে বৃদ্ধ শাশুড়িকে ঘর থেকে বের দিয়েছে এমন উদাহরণও অনেক আছে। গত দশ বছরে যেসব গৃহকর্মী বিশেষ করে শিশু গৃহকর্মী অমানুষিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন তাদের অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অভিযুক্ত হলেন নারী। সম্প্রতি নারী অধিকার নিয়ে কাজ করা একজন নারী নেত্রীর বিরুদ্ধে তার বাসার আয়াকে অত্যাচার করার অভিযোগ উঠেছে। করোনা ভাইরাসের মধ্যে দুই মাসের বাচ্চাসহ এক পরিবারকে ভাড়া না দিতে পারায় বাড়ির মালিক বাসা থেকে বের করে দিয়েছে। এই অমানবিক যারা করেছেন তাদের মধ্যে একজন নারীও ছিলেন। পরিসংখ্যানে দেখা যায় নারী ও শিশু পাচার কাজে জড়িত অপরাধীদের মধ্যে ৩০ শতাংশ নারী।

এত কথা বলার উদ্দেশ্য হল কেউ যদি খুব সূক্ষ্মভাবে পারিবারিক সহিংসতা থেকে শুরু করে সমাজ ও রাষ্ট্রের যেকোন অন্যায়, অত্যাচারের শিকার ব্যক্তিদের দেখেন তাহলে দেখবেন তাদের মধ্যে একটা কমন প্যাটার্ন হচ্ছে তারা ক্ষমতাহীন। আর যারা এসব করেন তাদের একটা কমন প্যাটার্ন হচ্ছে তারা ক্ষমতাবান। এই ক্ষমতা কাঠামোয় নারী-পুরুষ যারাই থাকুন না কেন তারা অন্যদের উপর অত্যাচার করেন।

এই ক্ষমতার ধরণ ভিন্ন জায়গায় ভিন্ন রূপে প্রকাশ পায়। যেমন চলমান সমাজব্যবস্থায় পুরুষদের  শারীরিকএবং সাংস্কৃতিকভাবে এবং পরিবারতন্ত্রে ক্ষমতাবান হিসেবে ধরা হয়। যদিও আপাতদৃষ্টিতে পরুষদের নারীদের থেকে শারীরিকভাবে শক্তিশালী মনে হলেও এটা সত্য নয়। কারণ যারা দাবী করে পুরুষরা নারীদের থেকে শারীরিকভাবে বেশি শক্তিশালী তারা নারীর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা, তার সন্তান জন্ম দানের অনন্য ক্ষমতাসহ অনেক কিছুই বিবেচনায় নেন না। তবুও যেসব পরিবারে নারীরা আয় করেন না সেসব পরিবারে অর্থ উপার্জন সক্ষমতাও সেই পরিবারের পুরুষের ক্ষমতার উৎস। এছাড়া অধিকাংশ ধর্মে সমাজ ও পরিবারে পুরুষও নারীর ভূমিকাকে এমনভাবে ব্যাখ্যা দেওয়া হয় যা পুরুষের ক্ষমতাকে নারীর উপর সংহিত করে। এর একটা কারণ হল যারা ধর্মীয় ব্যাখ্যা দেন তারা প্রায় সবাই পরুষ এবং তাদের অধিকাংশই ধর্মের সঙ্কীর্ণ ব্যাখ্যা দেন। অনেকে বিভিন্ন উদাহরণ দিয়ে দাবী করেন তাদের ধর্মে নারীদের অনেক সম্মান ও অধিকার দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কেউ যদি সেগুলো খুব গভীরভাবে বিশ্লেষণ করে তাহলে দেখবে এই সব সম্মান ও অধিকার কিছু নির্দিষ্ট শর্ত নারী পালন করলে তাদের উপহার হিসেবে প্রদত্ত হয়। তারা মানুষ হিসেবে সহজাতভাবে এইসব সম্মান ও অধিকার পায় না।

বিজ্ঞাপন

যারা নারী অধিকার নিয়ে কাজ করেন তারা মোটাদাগে পুরুষতান্ত্রিকতাকেই নারীর অধিকার লঙ্ঘনের জন্য প্রধানত দায়ী করেন। পুরুষতান্ত্রিকতা হল এমন একটা ক্ষমতা ব্যবস্থা যেখানে পুরুষরা নারীদের উপর কর্তৃত্ব করে। এই ব্যবস্থাকে বহাল রেখে নারীর ক্ষমতায়ন সম্ভব নয়। যারা নারী অধিকার নিয়ে কাজ করে তারা আসলে এই ক্ষমতাব্যবস্থা বিলোপে কাজ করেন। পুরুষতান্ত্রিকতার সুবিধাভোগী হিসেবে অনেক পুরুষ এটা পছন্দ করেন না। তারা বিভিন্নভাবে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে থাকেন। তেমনিভাবে অনেক নারী অধিকারকর্মী পুরুষতান্ত্রিকতা ও পুরুষের মধ্যে গুলিয়ে পেলেন। তারা পুরুষতান্ত্রিকতা বিলোপে কাজ না করে পুরুষদের অযাচিতভাবে আক্রমণ করেন। তারা পুরুষতান্ত্রিক ক্ষমতা ব্যবস্থা বহাল রেখে ইহার সুবিধাভোগী হিসেবে পুরুষের যায়গায় নারীদের অধিষ্ঠিত করতে কাজ করেন, যা কাম্য নয়।তা না হলে জার্মানির বাভারিয়া এবং নর্থ রাইন অঙ্গরাজ্যে পারিবারিক সহিংসতার শিকার পুরুষদের জন্য হটলাইন স্থাপনের যে প্রয়োজনীয়তা কর্তৃপক্ষ অনুভব করেছেন তা একসময় সারা পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে পড়বে।

লেখক: গবেষক আইনজীবী

প্রিয় পাঠক, লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই ঠিকানায় -
sarabangla.muktomot@gmail.com

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত মতামত ও লেখার দায় লেখকের একান্তই নিজস্ব, এর সাথে সারাবাংলার সম্পাদকীয় নীতিমালা সম্পর্কিত নয়। সারাবাংলা ডটনেট সকল মতাদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তবে মুক্তমতে প্রকাশিত লেখার দায় সারাবাংলার নয়।

সারাবাংলা/এসবিডিই

Tags: , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন