বিজ্ঞাপন

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বক্তব্যে একমত নন বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞরা

May 10, 2020 | 9:39 am

সৈকত ভৌমিক, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে বাংলাদেশে এখনও সম্পূর্ণ মাত্রায় কমিউনিটি ট্রান্সমিশন হয়েছে এটি বলা যাবে না। আর তাই প্রতিষ্ঠানটি বিশ্ব পরিস্থিতি তালিকায় বাংলাদেশের পরিস্থিতিকে তারা বর্ণনা করেছে ‘ক্লাস্টার অব কেইসেস’ বা গুচ্ছ সংক্রমণ বলে। কিন্তু বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এই বক্তব্যের সঙ্গে একমত নয় বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞরা।

বিজ্ঞাপন

৯ মে সারাবাংলায় সংবাদ প্রকাশিত হয়, কমিউনিটি ট্রান্সমিশন হয়নি বাংলাদেশে: বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই শিরোনামে।

এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. শামীম রিজওয়ান সারাবাংলাকে বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এ বক্তব্যের সঙ্গে পুরোপুরি একমত না। কারণ কন্টাক্ট ট্রেসিং এর উদ্দেশ্য হলো কমিউনিটি কন্টেইনমেন্ট। যখন পুরো সমাজে এটা ছড়িয়ে যায় তখন কন্টাক্ট ট্রেসিং এর প্রয়োজন বা প্রয়োগ খুব সীমিত। এক থেকে দেড় মাস আগে আইইডিসিআর কেস আইডেন্টিফিকেশনের পরপরই বহুখাতভিত্তিক সমন্বয় এর মাধ্যমে কন্টাক্ট ট্রেস করতে পারতো। কারন তখন স্টেজ ওয়ান বা টু তে ছিলাম আমরা। কিন্তু এখন সেই ধাপ অনেক এলাকাতেই নেই।

তিনি বলেন, বর্তমান সময়ে ঢাকা নারায়ণগঞ্জে স্টেজ ফোরে আছি। সেখানে কিছু প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষেত্র বাদে অধিকাংশ ক্ষেত্রে আসলে কন্টাক্ট ট্রেসিং যুক্তিসঙ্গত নয়। প্রযোজ্য ক্ষেত্রেই সেটা করে যেতে হয় যেমন হাসপাতালের বা কোনো প্রতিষ্ঠানের কেউ আক্রান্ত হলে সেক্ষেত্রে কন্টাক্ট ট্রেসিং করা সম্ভব হতে পারে। কিন্তু যদি গার্মেন্টসে কারো মধ্যে সংক্রমণ পাওয়া যায় তবে সেখানে কন্টাক্ট ট্রেসিং যুক্তিসঙ্গত না। আবার দেখা যায় আমরা এখনও অনেক জেলা ও উপজেলায় স্টেজ টু অথবা থ্রি তে আছি। এসব এলাকায় এখনো সম্ভব হচ্ছে কন্টাক্ট ট্রেসিং করা কিছু ক্ষেত্রে। কিন্তু সেক্ষেত্রে সেখানে যদি বাইরে থেকে কেউ যায় তবে সেক্ষেত্রে সংক্রমণের মাত্রা বাড়লে সেটি সম্ভব নাও হতে পারে। তবে হ্যাঁ আমাদের এখানে এখনো নিয়ম মেনে যেসব স্থানে সম্ভব সেখানে কন্টাক্ট ট্রেসিং এর কাজ চলছে।

বিজ্ঞাপন

স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, বাংলাদেশে সংক্রমণের মাত্রা কোনোভাবেই আর ‘ক্লাস্টার অব কেইসেস’ বা গুচ্ছ সংক্রমণ বলা যাবে না। হ্যাঁ, প্রথমদিকে আমাদের এখানে যতদিন কন্টাক্ট ট্রেসিং করা যাচ্ছিল ততদিন আমরা একে ক্লাস্টার অব কেইসেস বলছিলাম। এরপরে সীমিত আকারের কমিউনিটি ট্রান্সমিশন বলেছি। কিন্তু এখন যখন সারা দেশে কোভিড-১৯ ছড়িয়ে পড়েছে তখন আসলে এটাকে কোনো ভাবেই আর ক্লাস্টার অব কেইসেস বলা যায় না।

তিনি বলেন, এ বিষয়ে অবশ্যই কথা বলা হবে তাদের সঙ্গে। কারণ বাংলাদেশে আসলে এখন সকল ক্ষেত্রে কন্টাক্ট ট্রেসিং সম্ভব না। সীমিত আকারে যেসব স্থানে অল্প মাত্রার সংক্রমণ পাওয়া যাচ্ছে সেখানেও আসলে কতদিন করা যাবে তা নিয়ে সন্দেহ আছে। আর তাই এটিকে আমরা কমিউনিটি ট্রান্সমিশন বলব।

বিজ্ঞাপন

কোভিড-১৯ মোকাবিলায় গঠিত জাতীয় পরামর্শক কমিটির সদস্য ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপাচার্য ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘এক্ষেত্রে আমাদের মনে রাখতে হবে কিছু বিষয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন অনুযায়ী যখন দেশের বাইরে থেকে আসার পরে কোনো ব্যক্তি আক্রান্ত হয়ে থাকে তখন সেটাকে আমরা লোকাল ট্রান্সমিশন বলেছি। কিন্তু আমাদের ভেতরে যখন ছড়িয়ে পড়লো তারপর থেকে কিন্তু আর সেটা সেই মাত্রাতে নেই। প্রথম আক্রান্ত ব্যক্তির মাধ্যমে যখন তার পরিবারে ছড়ায় আর তার পরে ধীরে ধীরে অন্যস্থানে ছড়ায় তখন সেটার মাত্রাও এক রকম আর থাকে না। এক্ষেত্রে আসলে কন্টাক্ট ট্রেসিং করা গেলেও একটা বিষয় মাথায় রাখতে হবে যে এরা কিন্তু বাইরে থেকে আসা না। সুতরাং এটাকে বলতে হবে আমাদের কমিউনিটির মধ্যেই সংক্রমণ হয়েছে। এক্ষেত্রে আমরা এটিকে কমিউনিটি ট্রান্সমিশন বলতে পারি।’

যেহেতু আপনারা জাতীয় পরামর্শক কমিটিতে আছেন তাই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে কী তাদের বর্তমান অবস্থান পরিবর্তনের আবেদন জানাবেন বা যোগাযোগ কী করবেন?

এমন প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের কমিটি মূলত ল্যাবরেটরি বেইস কমিটি যেখানে দেশে ল্যাবরেটরি সংক্রান্ত বিষয়ে কীভাবে উন্নতি করা যায় সেই বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করা হয়। কিন্তু যেহেতু এই বিষয়টি সারাবাংলা ডট নেট প্রশ্ন আকারে তুলেছে সেটা আমি আলোচনা করতে পারি কমিটির বৈঠকে।’

বিজ্ঞাপন

তিনি বলেন, কমিউনিটি ট্রান্সমিশন মানে হলো আমাদের ইন্টার্নাল ট্রান্সমিশন। একজন লোক যে কোনোদিন বিদেশে যায়নি সে যখন সংক্রমিত হয়ে আরেকজনের মাঝে সংক্রমণ ঘটায় তখন সেখানেই কমিউনিটি ট্রান্সমিশন হয়ে গেছে বলা যায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যেহেতু এখনো আপডেট করেনি তাই এটি আসলে কমিউনিটি ট্রান্সমিশন হয় নি তা বলা যাবে না। দেশের ভেতর থেকে যদি কোনো নতুন এলাকায় সংক্রমণ ঘটে তবে সেক্ষেত্রে কমিউনিটি ট্রান্সমিশন বলা না গেলেও যদি সেখান থেকে অন্যদের মাঝে ছড়াতে থাকে তবে তাকে কিন্তু আমলে নিতে হবে সামাজিক সংক্রমণ হিসেবে। আর তাই এটা পরিবর্তন করা নিয়ে কথাবার্তা হতে পারে।

তিনি আরও বলেন, আমাদের ট্রান্সমিশন দুই ধরনের। একটা হলো বিদেশ থেকে কেউ আসার পরে কারো মাঝে সংক্রমণ পাওয়া গেছে। অপরটি হলো দেশের লোকের মাধ্যমে ছড়ালে যাকে আমরা কমিউনিটি ট্রান্সমিশন বলি। এক্ষেত্রে সরকারের পক্ষ থেকে যদি জানাতে হয় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে তবে সেটা করা যেতেই পারে। কিন্তু সেজন্য কমিউনিটি ট্রান্সমিশনের সংজ্ঞায় ফেলা যাবে না। সরকার কী বললো আর বললো না সেটা ভিন্ন বিষয়।

সারাদেশে এখনো অনেক স্থানে লেভেল ২ বা লেভেল ৩ স্টেজের সংক্রমণ পাওয়া যাওয়ায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এখনো সামাজিক সংক্রমণের ঘোষণা দিচ্ছে না। এমন বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, এগুলো নিয়ে আলোচনা করাই যায়। সাম্প্রতিক সময়ে অবশ্য কিছু লোক বিদেশ থেকে আসছে। যদি তাদের মাধ্যমে সংক্রমণ ছড়ায় সেক্ষেত্রে অবশ্য কমিউনিটি ট্রান্সমিশন বলা যাবে না। এগুলো নিয়ে আসলে আলোচনা করাই ভালো।

এর আগে ৮ মে ঢাকায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বাংলাদেশ বিষয়ক কম্যুনিকেশন ম্যানেজার কেটলিন কনস্ট্যানিন সারাবাংলাকে বলেন, বাংলাদেশে ইতোমধ্যেই সব বিভাগেই কোভিড-১৯ সংক্রমণ হয়েছে। দেশের সকল জেলাতেই এখন কোভিড-১৯ সংক্রমণ পাওয়া গেছে। কিন্তু তাও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এটাকে কমিউনিটি ট্রান্সমিশন বলছে না কারণ বাংলাদেশ সরকার এখনো কন্টাক্ট ট্রেসিং করে যাচ্ছে। আমরা সরকারের স্বাস্থ্য অধিদফতরের সঙ্গে কাজ করি। তারা আমাদের এই কন্টাক্ট ট্রেসিংয়ের কাজ করা হচ্ছে বলে জানিয়েছে। যখন কোনো দেশ কন্টাক্ট ট্রেসিং আর করতে পারবে না বলে জানায় তখন আমরা সেই দেশে কমিউনিটি ট্রান্সমিশন হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করি।

তিনি বলেন, ‘যে কোনো ট্রান্সমিশন ঘোষণা করার আগে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কিছু ক্রাইটেরিয়া থাকে। প্রথমত হলো যখন কোনো দেশে সংক্রমণ একদমই পাওয়া যায় না। সেটাকে আমরা ফেইজ ১ বলে থাকি। যখন সেই দেশে ১ থেকে দুইটা বা কিছু কেইস পাওয়া যায় যার মাঝে কেউ হয়তোবা দেশের বাইরে থেকে এসেছে ও তার সংস্পর্শে এসেছে তখন তাকে আমরা বলি ফেইজ-২। এই ফেইজকে বিক্ষিপ্ত ট্রান্সমিশন বলা যেতে পারে। সচরাচর এই ফেইজেও কোভিড-১৯ সংক্রমণের মাত্রা সীমিত থাকে।’

তিনি আরও বলেন, ‘এরপরেই থাকছে ফেইজ ৩ যেখানে বাংলাদেশ বর্তমান অবস্থান করছে আমাদের প্রতিবেদন অনুযায়ী। এই ফেইজে বা লেভেলে দেশে সংক্রমণের মাত্রা বাড়বে। এই সময়ে দেশের বিভিন্ন এলাকা বা লোকালয়ে সংক্রমণের মাত্রা বৃদ্ধি পাবে ও এপি সেন্টার হিসেবে গন্য হবে। বর্তমানে বাংলাদেশে যেমন ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে রোগীর সংখ্যা বেশি আর তাই এই দুই এলাকায় কমিউনিটি ট্রান্সমিশন হয়েছে এটা বলা যায়। এই দুই স্থানে কন্টাক্ট ট্রেসিং করেও বিশেষ কোনো লাভ হবে না। কিন্তু এই দুই এলাকার সঙ্গে আবার দেশে নতুভাবে যেখানে আক্রান্ত হচ্ছে তাকে মেলানো যাবে না।’

তিনি বলেন, ‘যখন সারা দেশে ছড়িয়ে পড়বে কোভিড-১৯ সংক্রমণ ও কন্টাক্ট ট্রেসিং সরকারের পক্ষ থেকে বন্ধ করে দেওয়া হবে তখনই আমরা একে কমিউনিটি ট্রান্সমিশন বলব। অর্থাৎ সকল এলাকায় কন্টাক্ট ট্রেসিং বন্ধ আর এলাকাভিত্তিক ভাবে সংক্রমণ ছড়াচ্ছে এমন তথ্য স্বাস্থ্য অধিদফতর যদি আমাদের দেয় তবে আমরা সেটাকে পরিবর্তন করে কমিউনিটি ট্রান্সমিশন বলব।’

তিনি বলেন, ‘মূল কথা আমাদের একটাই। আমরা সরকারের স্বাস্থ্য অধিদফতরের সঙ্গে কাজ করি যৌথভাবে। এক্ষেত্রে যদি সরকারের পক্ষ থেকে আমাদেরকে তথ্য দিয়ে বলা হয় কমিউনিটি ট্রান্সমিশন হয়েছে তবে আমরা সেটা প্রকাশ করব। আমাদেরকে যে তথ্য দেওয়া হয়েছে তাতে বাংলাদেশের অনেক এলাকাতে এখনো লেভেল ২ ও লেভেল ৩ ফেইজের সংক্রমণ চলছে।’ আর তাই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদনে ক্লাস্টার অফ কেইসেস উল্লেখ করা হয়েছে।

এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা সারাবাংলাকে বলেন, আমাদের এখনো কন্টাক্ট ট্রেসিং করা হচ্ছে এটা সত্য। কিন্তু ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের অধিকাংশ ক্ষেত্রে কন্টাক্ট ট্রেসিং করা যাচ্ছে না। তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদন বিষয়ে আসলে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলতে হবে।

এ বিষয়ে আইইডিসিআর’র পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদি সেব্রিনা ফ্লোরা ও স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তাদের ফোনে পাওয়া যায়নি। খুদে বার্তা পাঠিয়ে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তারা কোনো উত্তর দেননি।

এর আগে ২৫ মার্চ ও ২ এপ্রিল দেশে মৃদু আকারে কমিউনিটি ট্রান্সমিশন হয়েছে বলে জানানো হয়েছিল স্বাস্থ্য অধিদফতরের পক্ষ থেকে।

উল্লেখ্য, ১৩ এপ্রিল বাংলাদেশে স্বাস্থ্য অধিদফতর আয়োজিত কোভিড-১৯ পরিস্থিতি নিয়ে করা স্বাস্থ্য বুলেটিনে অংশ নিয়ে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছিলেন, করোনার কমিউনিটি ট্রান্সমিশন শুরু হয়েছে। সেটি যেন ব্যাপকভাবে না ছড়ায় সে ব্যাপারে আমাদের সচেতন হতে হবে।

সারাবাংলা/এসবি/একে

Tags: , , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন