বিজ্ঞাপন

করোনায় প্রণোদনা পায়নি তথ্যপ্রযুক্তি খাত, ঋণ জটিলতাও কাটেনি

May 15, 2020 | 10:20 am

এমদাদুল হক তুহিন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) মহামারির সময়েও সরকারের কাছ থেকে কোনো প্রণোদনা বা ঋণ পাননি দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের উদ্যোক্তারা। ঋণপ্রাপ্তিতে উদ্যোক্তাদের সমস্যাটি বেশ পুরোনো। দেশের ব্যাংকগুলোর পক্ষে তথ্যপ্রযুক্তি খাতের এসব কোম্পানিগুলোর মেধাস্বত্ব বা আর্থিক মূল্য পরিমাপের সুযোগ না থাকায় উদ্যোক্তারা প্রচলিত কোম্পানির মতো ঋণপ্রাপ্তিতে বঞ্চিত হচ্ছেন। তবে সরকার প্রায় কমবেশি সব খাতকে প্রণোদনা দিলেও দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাত এখনো এর উপকারভোগী হয়নি।

বিজ্ঞাপন

এদিকে, সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের উদ্যোক্তারা অনুদান চেয়েছিল। সরকার কাউকে অনুদান দেয়নি। তথ্যপ্রযুক্তি খাতের চাওয়া পাওয়াকে আরও যৌক্তিকভাবে সরকারের কাছে উপস্থানপ করা উচিত বলে মনে করেন খোদ ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার।

জানতে চাইলে দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) সভাপতি আলমাস কবীর সারাবাংলাকে বলেন, সরকারি প্রণোদনা থেকে দেশের আইটি খাত তথা সফটওয়্যার ব্যবসায়ীরা এখনো উপকৃত হয়নি। প্রণোদনা কাদের দেওয়া হবে, সেটা নিয়েও কনফিউশন ছিল। বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের একাধিক প্রজ্ঞাপনে সেটি পরিষ্কার করছে। আমরা ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল পেতে অনেকগুলো ব্যাংকের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছি।

তিনি বলেন, সরকারি প্রণোদনার বাইরে আমরা জামানতবিহীন একটি ঋণের ব্যবস্থা করছি। বেসিসের সুপারিশ সাপেক্ষে ব্যাংকগুলো ওই ঋণ দেবে। এক্ষেত্রে সুদের হার হবে ৯ শতাংশ। ঋণের পরিমাণ ব্যাংক-টু-ব্যাংক বা কোম্পানি-টু-কোম্পানি নির্ভর করবে। আমরা এরই মধ্যে প্রাইম ব্যাংকের সঙ্গে আলোচনা চূড়ান্ত করেছি। ওই ব্যাংকে বেশ কয়েকটি কোম্পানি আবেদনও করেছে। এছাড়া ইউসিবি, ব্র্যাক ও ইবিএলের সঙ্গে আলোচনা চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। এতদিন ব্যাংকগুলো আইটি কোম্পানিকে ঋণ দিত না। বেসিসের সঙ্গে চুক্তির ফলে এখন থেকে সফটওয়্যার ও আইটি কোম্পানিগুলো নির্দিষ্ট কিছু ব্যাংক থেকে ঋণ পাবে।

বিজ্ঞাপন

সংগঠনের সিনিয়র সহসভাপতি ফারহানা এ রহমান এ প্রসঙ্গে সারাবাংলাকে বলেন, প্রণোদনার অর্থ পেতে আমরা এখনো কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। সহজে যেন ব্যাংক ঋণ পাওয়া যায়, সে বিষয়ে আমাদের কাজ চলছে। আর বেসরকারি উদ্যোগে আমরা কয়েকটি প্রাইভেট ব্যাংক থেকে ঋণের ব্যবস্থা করছি। প্রক্রিয়াটি এখনো চলমান।

ফারহানা আরও বলেন, আমরা শুধু প্রণোদনা বা ব্যাংক ঋণের ওপর নির্ভর করে বসে থাকতে চাই না। আমরা দেশের ভেতরে সরকারি কিছু কাজ চাই। মুজিববর্ষ উপলক্ষে অনেক কাজ ছিল। সেগুলোর অর্থ ছাড় কিংবা কাজগুলো দেশের সফটওয়্যার খাতের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া যায়। দেশ কিন্তু ডিজিটাইজড হয়েছে, সবার মধ্যে ডিজিটাল লিটারেসি গড়ে উঠেছে। এখন সবাই ঘরে বসে জুমেই মিটিং করছে। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে অনেক কাজ রয়েছে আইসিটি নিয়ে। দেশ এতেটা ডিজিটাইজড না হলে করোনা মোকাবিলা এত সহজ হতো না। বর্তমানে লোকাল ইন্ডাস্ট্রি বন্ধ, বাইরের ৮৫ শতাংশ কাজ বন্ধ হয়ে রয়েছে। আমরা শুধু প্রণোদনা নয়, এসব কাজের সুযোগ তৈরি হোক— সেটিও চাচ্ছি।

জানা গেছে, তথ্যপ্রযুক্তি খাতের ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে সরকারের কাছে প্রণোদনা চেয়ে চিঠি দেয় বেসিস। অর্থমন্ত্রীকে লেখা ওই চিঠিতে বলা হয়, করোনাভাইরাসের প্রভাবে প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ রয়েছে। অনেকে বাসায় বসে অফিস করছেন। কিন্তু দেশের অভ্যন্তরে ও বিশ্ববাজারে সফটওয়্যার ও আইটি খাতের কাজ আশঙ্কাজনকভাবে কমে গেছে। রফতানি অর্ডার কমে গেছে প্রায় ৫০ শতাংশ। করোনা পরিস্থিতিতে ব্যবসার মন্দা কমপক্ষে আরও ৬ মাস থাকার আশঙ্কা রয়েছে। ফলে আগামী ৬ মাসে স্থানীয় বাজারে ৫০০ মিলিয়ন ও রফতানিতে ৮০০ মিলিয়নসহ মোট ১৩শ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ক্ষতি হতে পারে, যা টাকার অঙ্কে ১১ হাজার ৫০ কোটি টাকা। এই ক্ষতি বিবেচনায় নিয়ে বেসিস সরকারের কাছে প্রণোদনা চেয়েছে।

বিজ্ঞাপন

জানতে চাইলে বেসিসের বর্তমান সভাপতি আলমাস কবীর বলেন, সরকার যে প্রণোদনা ঘোষণা করেছে, আমরা এটার সুযোগ নিতে পারছি না। কারণ কারণ সরকারই বলেছে, ব্যাংকের সঙ্গে গ্রাহকের সম্পর্কের ওপর ভিত্তি করে তারা ঋণ দেবে। ফলে ৮০ হাজার কোটি টাকার ওই প্রণোদনা থেকে ঋণ নিতে হলে ব্যাংকের সঙ্গে ক্রেডিট হিস্ট্রি থাকতে হবে। এটা ছাড়া তারা ঋণ দিচ্ছে না। আমরা বলেছি, আমাদের জন্য একটা বিশেষ তহবিল গঠন করা হোক, যেখান থেকে শুধু আইটি কোম্পানিগুলো সহজ শর্তে ২ শতাংশ সরল সুদে ঋণ নিতে পারবে। আমরা এ ব্যাপারেও আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছি।

তথ্যপ্রযুক্তি খাতকে প্রাধান্য দেওয়ার দাবি জানান বেসিসের সাবেক সভাপতি শামীম আহসানও। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, তথ্যপ্রযুক্তি খাতের জন্য অনুদান ও প্রণোদনা— দু’টির জন্যই অর্থ মন্ত্রণালয়ে আবেদন করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে প্রণোদনার আবেদনও বেসিসের পক্ষ থেকে করা হয়েছে দুই ধরনের। তথ্যপ্রযুক্তি খাতের জন্যও আলাদা আলাদাভাবে আবেদন রয়েছে।

তিনি বলেন, করোনার সময়ে তথ্যপ্রযুক্তি খাত ফ্রন্টলাইনে থেকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছে, সেবা দিচ্ছে। বাসাবাড়িতে চাল-ডাল, মুদি মালামাল ও ওষুধ পৌঁছে দিচ্ছে। যদি এই খাত ঠিকভাবে কাজ না করে, তাহলে আরও বেশি মানুষ আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে পড়বে। তাই এই খাতকে প্রাধান্য দিতে হবে।

এক প্রশ্নের উত্তরে শামীম আহসান বলেন, সবাইকে আরও প্রো-অ্যাকটিভ হতে হবে। আর ঋণ পেতে আমরা ভোগান্তিতে পড়ি। আমরা জামানত দেখাতে পারি না। কারণ আমাদের ব্যবসা অনলাইনে। আমাদের কাজ মেধাস্বত্বের। ব্যাংকগুলোতে সেই অর্থে এক্সপার্ট লোক না থাকায় তারা কোম্পানির ভ্যালু মূল্যায়ন করতে পারে না। তাদের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের গুরুত্ব আরও বেশি করে বোঝা উচিত।

বিজ্ঞাপন

বেসরকারি ব্যাংকগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে বেসিস যে ঋণের ব্যবস্থা করছে, সেই ঋণের আবেদন করার জন্যও কোম্পানিগুলোর সহায়তা প্রয়োজন বলে মনে করেন এসএসএল ওয়ারলেস ও ই-ক্যাবের পরিচালক আশীষ চক্রবর্তী। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, বেসিস বেশকিছু মিটিং করেছে। ৯ শতাংশ সুদে ঋণ দিতে চাচ্ছে কিছু বেসরকারি ব্যাংক। কিন্তু ঋণ পাওয়ার জন্য যে ধরনের পেপার রেডি করা দরকার, যে ধরনের এডুকেশন দরকার, এসব বিষয়ে কোম্পানিগুলো এখনো পোক্ত নয়। আবেদন করতে হলে যথাযথভাবে করতে হবে। করতে হবে তো প্রপারলি। অন্যদিকে ব্যাংকগুলোও কিন্তু আইটি কোম্পানিগুলোকে এখন অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মতোই বিবেচনা করে। এজন্য বেসিস থেকে লিগ্যাল অ্যাডভাইজর পেলে আমরা উপকৃত হতাম।

আশীষ চক্রবর্তী আরও বলেন, বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের ক্ষেত্রে তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোর ভূমিকা কিন্তু অনেক। আর এখন যে ক্রাইসিস চলছে, সেটা কিন্তু দ্রুত শেষ হবে না। এজন্য আমাদের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা দরকার। সরকার এখনো অনেক ক্ষেত্রে বিদেশি সল্যুশনের ওপর নির্ভর করছে। আমরা চাই বিদেশি কোম্পানিকে বাদ দিয়ে দেশি কোম্পানিগুলোকে কাজ দেওয়া হোক। তাহলে দেশেও কিছু ভালো প্রোডাক্ট তৈরি হবে।

তথ্যপ্রযুক্তি খাতের প্রণোদনা বা ঋণ— কোনোটিই না পাওয়ার ক্ষেত্রে কোম্পানিগুলোকেই দায়ী করছেন ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, সব খাতেই করোনার প্রভাব পড়েছে। কিন্তু আমরা ৬০০ কোটি টাকার অনুদান চেয়ে বসে আছি। সরকার তো প্রণোদনা দিচ্ছে। ব্যাংক ঋণ পাবে, ব্যাংকের সঙ্গে গ্রাহকের যে সম্পর্ক, তার ওপর নির্ভর করে ঋণ পাবে। ব্যাংক যদি সেই সম্পর্ক খুঁজে না পায়, তাহলে লোন দেবে কিভাবে? আর ঋণ নিয়ে এই খাতে ব্যবসা বড় করার মতো কোম্পানি খুঁজে পেতে হবে আগে।

তিনি বলেন, যারা এই ব্যবসায় আছেন, তাদের বিষয়গুলো সঠিকভাবে উপস্থাপন করতে হবে। অর্থমন্ত্রীর কাছে উপস্থাপন করতে হবে, প্রধানমন্ত্রীর কাছে তুলে ধরতে হবে। যৌক্তিক দাবি থাকতে হবে, যৌক্তকভাবে উপস্থাপন করতে হবে। নিতে পারার যোগ্যতা যদি না থাকে, প্রণোদনা দিলেও তা তারা গ্রহণ করতে পারবে না।

তথ্যপ্রযুক্তি খাতের সংশ্লিষ্টদের দাবিগুলোকে যৌক্তিক করে তোলার আহ্বান জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, তারা যে দাবিগুলো করেছে তা যৌক্তিক ফরম্যাটে ফেলা উচিত। তারা অনুদান চেয়ে বসে আছে। সরকার তো অনুদান দেয়নি। সরকার যা দিয়েছে, তা হলো স্বল্প সুদে ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা। সরকার তথ্যপ্রযুক্তি খাতকে সব সময় অগ্রাধিকার দিয়ে আসছে। তারা নীতি সহায়তা নিতে পারে, ট্যাক্স-ভ্যাটের সহায়তা নিতে পারে। অনুদান তো সরকার দেবে না।

সারাবাংলা/ইএইচটি/টিআর

Tags: , , , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন