বিজ্ঞাপন

বেতন হয়নি ১২শর বেশি কারখানায়, বোনাসও অর্ধেক!

May 19, 2020 | 3:29 pm

এমদাদুল হক তুহিন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: দেশের প্রায় ৪০ শতাংশ পোশাক কারখানায় এখনো এপ্রিল মাসের বেতন হয়নি। বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ’র সদস্যভুক্ত তিন হাজার ১০৭টি কারখানার মধ্যে অন্তত ১ হাজার ২০০ কারখানায় বেতন হয়নি বলে জানা গেছে। একইসঙ্গে ঈদের আগে বোনাস নিয়েও শঙ্কা তৈরি হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সক্ষম মালিকরা ঈদের আগে শতভাগ বোনাস দিলেও অনেক মালিকই অর্ধেক পরিশোধ করবেন। বাকি অর্ধেক তারা ঈদের পরে পরিশোধ করবেন। তবে শতভাগ বোনাসের দাবি জানিয়ে আসছেন শ্রমিক ও শ্রমিক নেতারা। এমন পরিস্থিতে গার্মেন্টস খাতে ঈদের আগে  শ্রম অসন্তোষের শঙ্কা তৈরি হয়েছে।

করোনাভাইরাসের কারণে সাধারণ ছুটি ঘোষণার পরপরই পোশাক শ্রমিকদের বেতন পরিশোধে ৫ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা ঘোষণা করে সরকার। সেই প্রণোদনার অর্থেও সঠিক সময়ে বেতন দিতে পারেনি মালিকপক্ষ। কবে নাগাদ এপ্রিলের বেতন দেওয়া শেষ হবে, তা জানাতেও পারছেন না তারা। কেবল এপ্রিল নয়, প্রায় ৩০০ কারখানায় এখনো মার্চ মাসের বেতনই বকেয়া রয়েছে!

অথচ বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, সরকার ঘোষিত ৫ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ থেকে ঋণের টাকায় শ্রমিকদের বেতন দিতে ২ হাজার ৪৪টি কারখানা আবেদন করে। কারখানাগুলোকে ওই ঋণের টাকা দিতে ৪৭টি ব্যাংকের অনুকূলে ২ হাজার ৭২০ কোটি ৩০ লাখ টাকা ছাড় করা হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

বিজিএমইএ’র তথ্যমতে, তাদের সদস্যভুক্ত ২ হাজার ২৭৪টি কারখানার মধ্যে চট্টগ্রামের ২৫৭টি কারখানা বাদে অন্যান্য অঞ্চলের ১ হাজার ২৩৩টি কারখানায় এপ্রিল মাসের বেতন হয়েছে। সে হিসাবে ৭৮৪টি কারখানায় বেতন হয়নি। এর বাইরেও চট্টগ্রামের অর্ধেক কারখানায় বেতন হয়নি বলে আভাস পাওয়া গেছে। সে হিসেবে বিজিএমইএর অন্তত ৯০০ কারখানায় এখনো বেতন হয়নি।

এছাড়া বিকেএমইএর সদস্যভুক্ত কারখানা ৮৩৩টি। এরমধ্যে ৬০ শতাংশ কারখানার বেতন হয়েছে বলে দাবি বিকেএমইএ’র। সে হিসেবে বেতন হয়েছে ৫০০ কারখানায়। আর হয়নি ৩৩৩টিতে। সব মিলিয়ে বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ’র বেতন না হওয়া পোশাক কারখানার সংখ্যা ১ হাজার ২০০টির কম নয়।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিজিএমএই’র এক নেতা জানান, প্রণোদনার অর্থে বেতন দিতে তাদের ১ হাজার ৩৭৭টি কারখানার আবেদন টিকেছিল। রোববার (১৭ মে) পর্যন্ত ১ হাজার ২৩৯টি কারখানার বেতন দেওয়া হয়েছে। আর এবার সর্বনিম্ন ৫০ শতাংশ বোনাস দিতে হবে। রোববার থেকে কিছু কিছু কারখানায় বোনাস দেওয়াও শুরু হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

বিকেএমইএ’র প্রথম সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম সারাবাংলাকে বলেন, এর মধ্যে আমাদের ৬০ শতাংশ কারখানায় এপ্রিলের বেতন দেওয়া শেষ হয়ছে। এখনও ৪০ শতাংশ কারখানা বেতন দিতে পারেনি। আগামী দুই তিন দিনে হয়তো অনেকেই দিতে পারবে। তাদের জন্যে অনেক ব্যাংকে দেনদরবার করছি। আমাদের কাছ থেকে প্রত্যয়নপত্র দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তেমন আশানুরূপ ফল দেখছি না। আমরা আশঙ্কা করছি, ২০ তারিখের পর থেকে শ্রমিক অসন্তোষ দেখা দিতে পারে। শ্রমিকদের অনুরোধ করব, তারা যেন ধৈর্য ধরেন।

বোনাস দেওয়া হবে কি না— জানতে চাইলে মোহাম্মদ হাতেম বলেন, যেখানে কাজ নেই, উৎসব নেই, সেখানে উৎসব ভাতা মাননসই নয়। তারপরও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বৈঠক থেকে ৫০ শতাংশ বোনাস দিতে বলা হয়েছে। আমাদের অনেক কারখানা হয়তো বোনাস দিতে পারবে। কিন্তু সবাই বোনাস দিতেও পারবে না। তারা তো এখনো এপ্রিল মাসের বেতনই দিতে পারেনি।

অন্য এক প্রশ্নের উত্তরে বিকেএমইএর এই নেতা বলেন, শতভাগ বোনাস দিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়নি। কেউ যদি শতভাগ বোনাস চায়, সেটা অন্যায় হবে।

আর বিকেএমইএ’র পরিচালক ফজলে শামীম এহসান সারাবাংলাকে বলেন, বোনাস সাধারণত ঈদের আগে ছুটির দিন দেওয়া হয়। তবে এবার কিছুসংখ্যক কারখানা বোনাস মনে হয় না দিতে পারবে। এখনো বেশ কিছু কারখানায় এপ্রিলের বেতন দেওয়া বাকি আছে। কারণ মোবাইল ব্যাংকিং সার্ভিস, বিশেষ করে রকেটের কারণে অনেক শ্রমিক ঝামেলাতে আছে।

বিজ্ঞাপন

মালিকপক্ষ কমপক্ষে ৫০ শতাংশ বোনাস দেওয়ার কথা বললেও শ্রমিক নেতারা শতভাগ বোনাস দেওয়ার দাবি জানিয়ে আসছেন। একইসঙ্গে সম্প্রতি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকের বিষয়টিও তারা তুলে ধরছেন। এ প্রসঙ্গে জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি আমিরুল হক আমিন সারাবাংলাকে বলেন, বোনাসের ব্যাপারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পরশু বৈঠক হয়েছে। সেখানে শ্রম প্রতিমন্ত্রী, বিজিএমএইএ ও বিকেএমইএ’র প্রতিনিধি এবং শ্রমিক সংগঠনের প্রতিনিধিরা ‍উপস্থিত ছিলেন। সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত হয়েছে, শতভাগ বোনাস দেওয়া হবে। অন্যান্য বছর যেভাবে দেওয়া হয়, এবারও সেভাবে দেওয়া হবে। যাদের একান্ত সমস্যা আছে, তারা ঈদের আগে কমপক্ষে ৫০ শতাংশ বোনাস দেবে, বাকি ৫০ শতাংশ ঈদের পর পরিশোধ করবে।

এক প্রশ্নের উত্তরে এই শ্রমিক নেতা বলেন, এখন পর্যন্ত ৪৫ থেকে ৫০ শতাংশ কারখানায় এপ্রিল মাসের বেতন হয়েছে। বাকি ৫০ শতাংশ কারখানায় যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বেতন দেওয়া দাবি করছি। একইসঙ্গে দ্রুত সময়ে শ্রমিকদের শতভাগ বোনাস দেওয়ার দাবি জানিয়ে আসছি। কারণ শ্রমিক কিন্তু সারাবছর কাজ করেছে। কাজ বন্ধ ছিল একমাস। এক্ষেত্রে বোনাস শ্রমিকের প্রাপ্য অধিকার।

সম্প্রতি অনুষ্ঠিত এই বৈঠকের বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সারাবাংলাকে বলেন, পোশাক খাতের সব পক্ষকে নিয়ে একটি বৈঠক হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, বোনাস শতভাগই দিতে হবে। তবে করোনা পরিস্থিতির কারণে কেউ যদি দিতে না পারে, তাকে ঈদের আগে অন্তত ৫০ শতাংশ বোনাস দিতে বলা হয়েছে। বাকি ৫০ শতাংশ ঈদের পরে তিন থেকে ছয় মাসের মধ্যে সময় বুঝে পরিশোধ করবে। যাদের শতভাগে বোনাস দেওয়ার সামর্থ্য রয়েছে, তারা ঈদের আগেই সেটা দিয়ে দেবে বলে আমরা আশা করছি।

জানতে চাইলে গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক জলি তালুকদার সারাবাংলাকে বলেন, এখনো বেশিরভাগ কারখানায় এপ্রিল মাসের বেতন হয়নি। কিছু কারখানায় মার্চ মাসের বেতনও বকেয়া রয়েছে। আমরা বিভিন্ন বৈঠকে শতভাগ বোনাস ও মে মাসের বেতনও দেওয়ার দাবি জানিয়েছি। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, বিভিন্ন কারখানা এখনো মার্চ মাসের বেতনই দিতে পারেনি।

বাংলাদেশ জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক কর্মচারী লীগের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম রনি বলেন, ৮০ শতাংশ কারখনায় এপ্রিল মাসের বেতন হয়েছে। অনেকে শতভাগ বোনাস দিচ্ছে। আবার কেউ ৬০ শতাংশ। এটি নিয়ে শ্রমিকদের মধ্যে অসন্তোষ রয়েছে। আগে যেভাবে বোনাস দেওয়া হতো সেভাবে দিলে হয়তো সমস্যা হবে না।

এফবিসিসিআইয়ের সহসভাপতি ও বিজিএমইএ’র সাবেক সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, আইন বলে বোনাস দিতে হবে। আগে যেমন বোনাস দেওয়া হতো, এখনও তাই দেওয়া হবে। এরই মধ্যে দেওয়াও শুরু হয়েছে। যারা পারবে, তারা দেবে। সর্বোচ্চ কতটুকু দিতে পারবে, তার একটা নিয়ম আছে। কিন্তু সর্বনিম্ন বিষয়ে বলা নেই। লাভ হলে মালিকরা বোনাস দেয়। এখন তো ফ্যাক্টরিই বন্ধ। সক্ষমতা থাকলে দেবে, সক্ষমতা না থাকলে দেবে কীভাবে? এখানে অনেক ছোট ছোট ফ্যাক্টরি আছে। তারা যতটুক দিয়ে সন্তুষ্ট করতে পারে, সেটি মেনে নিতে হবে।

শ্রমিকদের ধৈর্য ধরার আহ্বান জানিয়ে পোশাক খাতের এই নেতা বলেন, কোনোভাবেই বিশৃঙ্খলা করা যাবেনা। শ্রমিক ও মালিককে একসঙ্গেই এই পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হবে। শ্রমিক যদি ধৈর্য না ধরে, তারাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। পরে ক্ষতিগ্রস্ত হবে মালিক। আর সবমিলিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে দেশ। তাই তাদের ধৈর্য ধরতে হবে।

সারাবাংলা/ইএইচটি/টিআর

Tags: , , , , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন