বিজ্ঞাপন

হাসপাতালে ‘মেলেনি চিকিৎসা’, দেখতে পেলেন না ছেলের লাশও

May 22, 2020 | 5:13 pm

সৈকত ভৌমিক, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: গাজীপুরের কাপাসিয়ার জাকির হোসেন। ১৮ বছর বয়সী ছেলে তানজিম আহমেদের শারীরিক অসুস্থতার কারণে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে নিয়ে এসেছিলেন রাজধানী ঢাকায়। চারটি হাসপাতাল ঘুরে সন্তানকে কোভিড-১৯ উপসর্গ না থাকার পরেও বাংলাদেশ-কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে ভর্তি করেন।

বিজ্ঞাপন

অভিযোগ করে তিনি বলেছেন সেখানেও চিকিৎসা না পেয়ে মারা যায় সন্তান। মৃত্যুর পরে সন্তানের লাশ দেখার আকুতি নিয়ে তিনি কথা বলেন সারাবাংলার এ প্রতিবেদকের সঙ্গে। অভিযোগ করে বলেন, তাকে না জানিয়েই সন্তানের লাশ দাফন করে ফেলা হয়েছে। যদিও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।

সম্প্রতি বাংলাদেশে নভেল করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) পরিস্থিতিতে সবচাইতে বেশি আলোচনার বিষয় হাসপাতালে চিকিৎসা না পাওয়ার। কোভিড-১৯ বিশেষায়িত হাসপাতালে ভর্তি করালেও অন্যান্য হাসপাতালে পরীক্ষার ফলাফল ছাড়া রোগী ভর্তি নেওয়া হয় না এমন অভিযোগও আছে। আর এমন অবস্থায় জাকির হোসেনকেও পড়তে হয় এক অমানবিক বিড়ম্বনায়। আর সেই বিড়ম্বনায় পরে হারালেন প্রিয় পুত্রকে।

জাকির হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমার ছেলে তানজিম আহমেদের শারীরিক অবস্থা খারাপ হয় গত কিছুদিনে। সে জন্ডিসের সমস্যায় ভুগছিল। তাকে আমি উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় নিয়ে আসি। উত্তরার ক্রিসেন্ট হাসপাতালে তাকে ভর্তি করানোর চেষ্টা করি। সেখানে তারা আমার সন্তানকে চিকিৎসা দেয়নি। বলেছে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল বা কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে নিয়ে যেতে। আমি সেখান থেকে ছেলেকে নিয়ে ঢামেকে ভর্তি করাই রাতেই। সেখানে কোনো চিকিৎসক তাকে দেখতে আসেনি। এমন অবস্থায় আমি সেখান থেকে বন্ড সই দিয়ে তাকে নিয়ে আসি।

বিজ্ঞাপন

তিনি বলেন, ‘এরপরে তাকে আমি নিয়ে যাই উত্তরার আধুনিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখানেও তারা ভর্তি রাখেনি। সেখান থেকে নিয়ে যাই উত্তরাতেই অবস্থিত রেডিয়েন্ট হাসপাতালে। সেখানেও তাকে কেউ ভর্তি করেনি। আর কোনো জায়গায় না পেরে তাকে নিয়ে বুধবার (২০ মে) সকালে ভর্তি করাই বাংলাদেশ কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে।’

কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে তো কোভিড-১৯ রোগীদের চিকিৎসা হয়। আপনার ছেলের কী কোভিড-১৯ উপসর্গ ছিল এমন প্রশ্নের জবাবে জাকির হোসেন বলেন, ‘না, আমার ছেলের কোভিড-১৯ উপসর্গ ছিল না। কিন্তু অন্য কোথাও তো চিকিৎসা পাচ্ছিলাম না। এদিকে ছেলের যন্ত্রণাও বাড়ছিল। বাবা হিসেবে তো আর ছেলের কান্না সহ্য হচ্ছিল না। কী করতাম আর আমি বলেন?’

বিজ্ঞাপন

তিনি বলেন, ‘ছেলেকে কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে ভর্তি করানোর পরে আমাকে বলা হয় সঙ্গে কে থাকবে? আমিই থাকতে রাজি হই। সেখানে একটা রুমে আমার ছেলেকে নেওয়া হয়। তাকে দেখতে কোনো ডাক্তারও আসেনি, নার্সও আসে না। অক্সিজেন শেষ হয়ে গেলে সেটার জন্য আমি কাউকে ডেকেও পাইনি। একপর্যায়ে দেখি ছেলের নাকে-মুখে রক্ত। সেই সময়েও আমি কাউকে পাইনি। এরপরে আমার ছেলেটা মারাই গেলো আমার সামনে। আমি পারলাম না তারে বাঁচাতে।’

তিনি আরও বলেন, ‘ছেলে মারা যাওয়ার পরে জানানো হলো আমাকে কোয়ারেনটাইনে থাকতে হবে সেখানে। ছেলের নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। নমুনা পরীক্ষার ফলাফল না পাওয়া পর্যন্ত আমাকে সেখানে থাকতে হবে। নমুনা পরীক্ষার ফলাফল পাওয়ার পরে ছেলেকে দাফন করা হবে।’

জাকির হোসেন বলেন, ‘ছেলের লাশ তারা বলেছিল রাখবে। আমাকে এ কথা দিয়েই উপরে রাখা হয়। পরের দিন অর্থাৎ বৃহস্পতিবার (২১ মে) আমি জানতে চাই ছেলের নমুনা পরীক্ষার ফলাফল বিষয়ে। আমাকে জানানো হয় ওর নমুনা পরীক্ষার ফলাফল নেগেটিভ এসেছে। এরপরে আমি বলি, এবার আমার ছেলের লাশ দেন আমি বাড়ি নিয়ে দাফন করব। আমি আমার ছেলেরে আমার বাড়ির পাশে রাখব যাতে প্রতিদিন তার কবরটা দেখতে পারি।’ তখন আমাকে জানানো হয় ছেলের লাশ নাকি দাফন করে ফেলা হয়েছে।’

বিজ্ঞাপন

তিনি বলেন, ‘আমারে না জানিয়ে তারা লাশও দাফন করে ফেলেছে। আমি আমার ছেলের চেহারাটা শেষবারের মতো দেখতেও পেলাম না। এটা কেমন বিচার? যদি তার লাশ দাফনই করতে হয় তবে তাও তো অন্তত একটা বাড় আমাকে দেখতে দেওয়া দরকার ছিল। সেটা করা হয় নাই। অথচ আমি সেই বিল্ডিংয়েই ছিলাম। আমাকে এর পরে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়। একটা কাগজ দেওয়া হয় যেখানে লেখা লাশ দাফনের জন্য বুঝে পাওয়া হয়েছে। কিন্তু আমি তো আমার ছেলের লাশই দেখতে পেলাম না। এই বিচার আমি কার কাছে দেব?

এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হয় কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালের সহকারী পরিচালক ডা. শিহাব উদ্দিনের সঙ্গে। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘বাংলাদেশে এখন অনেক উপসর্গ ছাড়াও রোগী পাওয়া যাচ্ছে। তাই আমাদের এখানে এখন এমন রোগীদের ভর্তি করানো হয়। চিকিৎসা না পাওয়ার যে অভিযোগ করেছেন তা আসলে একটু খবর নিয়ে দেখতে হবে। আর লাশ না দেখার বিষয়ে যে অভিযোগ করেছেন সেটা আসলে সত্যি নয়। উনাকে জানানো হয়েছিল। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও বাংলাদেশের স্বাস্থ্য অধিদফতরের গাইডলাইন অনুযায়ী সাসপেক্ট রোগীদের ক্ষেত্রেও আলাদাভাবে স্বাস্থ্য বিধি মেনে দাফন করা হয়। সেটাই করা হয়েছে এই ক্ষেত্রেও। পরবর্তীতে ছেলের রিপোর্ট নেগেটিভ আসে।’

হাসপাতালের মর্গে কী লাশ রাখা সম্ভব ছিল না এমন প্রশ্নের জবাবে কোনো উত্তর দেননি তিনি।

জাকির হোসেন কোভিড-১৯ হাসপাতালে ছিল। এমন অবস্থায় তাকে হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে। এটা কী ঝুঁকিপূর্ণ নয়? এমন প্রশ্নের জবাবে ডা. শিহাব বলেন, ‘হ্যাঁ কিছুটা ঝুঁকিপূর্ণ অবশ্যই। আর তাই আমরা উনাকে স্বাস্থ্য বিধি মেনে চলতে বলেছি।’

হাসপাতালে চিকিৎসা না পাওয়ার অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে সারাবাংলার পক্ষ থেকে উত্তরার ক্রিসেন্ট হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে।

হাসপাতালটির ম্যানেজার কাউসার আহম্মেদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের এখানে রোগীকে হাসপাতালের জরুরি বিভাগে দেখা হয়। সেখানে চিকিৎসক যদি ভর্তি দেন তবে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। নতুবা রোগীকে রেফার করে দেওয়া হয় অন্য হাসপাতালে।’

তবে এ বিষয়ে উত্তরার রেডিয়েন্ট হাসপাতাল ও আধুনিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যোগাযোগ করেও কারো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

সারাবাংলা/এসবি/একে

Tags: , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন