বিজ্ঞাপন

শাকিব খানের ছেঁড়া প্যান্ট বনাম বোরকা হিজাব

March 4, 2018 | 2:59 pm

১.
আমি লিবার্টির পক্ষে। যাদের সাথে আমার সম্পর্ক আছে তারাও লিবার্টির পক্ষের মানুষ বলে জানি। সে অর্থে মানুষের পোশাক পরার স্বাধীনতাকে আমি সমর্থন করি। এমনকি বোরকা-হিজাব পরার অধিকারের প্রতিও আমার শ্রদ্ধা আছে। এর অর্থ এই নয় কে কী পরলো তা নিয়ে আমার মাথা ব্যথা নেই। আছে, বিস্তর মাথা ব্যথা আছে। বোরকা-হিজাব নিয়ে প্রচণ্ড মাথাব্যথা আছে।

বিজ্ঞাপন

লিবার্টি-ফ্রিডম এসব খুবই চমৎকার বিষয়। এগুলো প্রকৃতিতে আছে। মানুষ এসব পেতে চেয়েছে। এজন্যই উপমা দিয়ে মানুষ বলে, ” প্রকৃতির মতো স্বাধীন হও/ হও বিহঙ্গের মতো মুক্ত “।

এরকম স্বাধীনতা ও মুক্তি প্রত্যাশী মানুষকে সেই মানুষই আবার শৃঙ্খলে আবদ্ধ করে। চাপিয়ে দেয় সমাজ নির্ধারিত প্রথা, বিধিনিষেধ, নিয়মের বেড়াজাল। সেকারণে সব রীতিনীতি, সংস্কৃতি, আইন চূড়ান্ত কিছু নয়। সামাজিক বিবর্তনের নিয়মে এসবই পরিবর্তিত হয়,  হয়েছে এবং ভবিষ্যতেও হবে। ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে পুরনো, পশ্চাৎপদ, অন্ধতার জিঞ্জির।

২.
বাংলা ফিল্মের নায়ক শাকিব খান যে প্যান্টটি পরেছেন এবং যা নিয়ে তুমুল তর্ক-বিতর্ক চলছে তা আমার কাছে দৃষ্টিনন্দন মনে হয়নি। আমার সৌন্দর্য ও নন্দনতাত্ত্বিক চেতনা, ধারণা এবং চর্চায় ওই তথাকথিত ফ্যাশনেবল ছেঁড়াফাড়া প্যান্টটি বিরক্তির উদ্রেক করেছে। কিন্তু তারমানে এই নয় তার ওই টাইপের পোশাক পরার স্বাধীনতার বিপক্ষে আমি। এমনকি তিনি কানে দুল, নাকে নাকফুল, নখে নেইলপলিশ, ঠোঁটে লিপস্টিক, চোখে কাজল, গলায় নেকলেস, হাতে চুড়ি, কোমরে বিছা, শরীরে জামদানী শাড়ি পেঁচিয়ে পাবলিক প্লেসে হেঁটেচলে বেড়ালেও আমার সমস্যা নেই। এতে আপনার আমার সমস্যা থাকা উচিৎ নয়।

বিজ্ঞাপন

যদি দেখেন সমস্যা হচ্ছে। যদি মগজ ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় এইটা ভেবে যে একটা ছেলে ক্যান মেয়েদের মতো পোশাক পরবে, মেয়েদের মতো হাঁটবে, চলবে, পা নাড়াবে, কথা বলবে-  তবে নিশ্চিত থাকতে পারেন, গভীর পিতৃতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গিগত সমস্যার মধ্যে আপনি আছেন। আপনি একা নন, বরং অল্প কিছু মানুষ বাদে সবাই আপনার মতো চেতনা লালনপালন করে দিব্যি সুখে শান্তিতে দিনাতিপাত করছে। কিন্তু এই সুখ-শান্তি আপনারে আসলে মুক্তি দেয়নি। আপনি মুক্ত হতে পারেননি। আপনার মনে কখনো আসেইনি এই যে ছেলেরা প্যান্ট-শার্ট-লুঙ্গি পরে অন্যদিকে মেয়েরা সালোয়ার-কামিজ-শাড়ি-চূড়ি পরে, আসলে নারী-পুরুষের পোশাক ভিন্ন কেনো? ভিন্ন ভিন্ন ড্রেসকোড কে নির্ধারণ করে দিয়েছে? কাপড়চোপড় ছাড়াই সদ্যজাত একটা শিশুরে কে বা কারা ছেলের পোশাক অথবা মেয়ের পোশাক পরাচ্ছে? একটা ছেলে শিশুরে প্রচলিত মেয়ের পোশাক পরালে ওই শিশুর কি লিঙ্গ চেঞ্জ হয়ে যাবে? সে কি বায়োলজিক্যালি মেয়ে হয়ে উঠবে?

যদি সেটা না হয় তবে আপনি আমার সাথে একমত হচ্ছেন যে ছেলেদের পোশাক, মেয়েদের পোশাক বলে যা আমরা দেখছি এবং ব্যবহার করছি এসব আসলে সমাজ নির্ধারিত। সমাজ ঠিক করে দিয়েছে বিধায় এটাকে চূড়ান্ত ধরে নেওয়ার কিছু নেই। এমন দিন হয়তো একদিন আসবে, ছেলেমেয়ের আলাদা আলাদা পোশাক থাকতে পারে এই জিনিসটা জানতে পেরে দূর ভবিষ্যতের মানুষ বিস্ময়ে হতবাক হবে। ভাববে, ‘আদিম যুগের মানুষেরা কতো পিছিয়ে ছিল; পোশাক-আশাকে, চিন্তা-ভাবনায় ওরা কী ভীষণ প্রাচীনপন্থী ছিল!’

পোশাকের স্বাধীনতা নিয়ে এতো লেকচার দেওয়া এই আমি তাহলে বোরকা-হিজাব নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করি কেনো?

বিজ্ঞাপন

এর পেছনে ওই লিবার্টি, ওই স্বাধীনতা এবং অসাম্প্রদায়িক পরিচয়ের চেতনা না থাকা প্রধান কারণ। বোরকা-হিজাব-নেকাব স্পষ্টত ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক পরিচয় বহন করে। এতে বর্তমানে মুসলমান আইডেন্টিটিকে সামনে এনে আত্মপরিচয়ের দিকটিকে শক্তিশালী করার অভিপ্রায় প্রকাশ করা হয়। বাঙালি মুসলমানের আইডেন্টিটি ক্রাইসিসের উৎকট প্রদর্শন বোরকা-হিজাব। আজ থেকে ২০ বছর আগেও বাঙালি মুসলমানই এ অঞ্চলে সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল। কই তখনতো বোরকা-হিজাবের দরকার পড়েনি। রাস্তাঘাটে এক দুজনের বেশি কোনো নারীর মাথায় ওই জিনিস দেখিনি। এই লেখা যারা পড়ছেন এবং ত্রিশ প্লাস যাদের বয়স তারা মনে করে দেখুন। যাচাই করে নিন আমার কথার সত্যাসত্য।

৩.
যারা ধর্মীয় বিশ্বাস কিংবা ভাললাগা থেকে পরছেন তারা কি ভেবে দেখেছেন এই বিশ্বাস বিশ বছর আগে কোথায় ছিল, নাকি আগের মানুষ কম ধার্মিক ছিল?

আর যে ভাবছেন, ‘আমিতো এমনি এমনি পরি, আমার ভাললাগে তাই পরি’। আজ্ঞে না। আপনি এমনি এমনি পরেন না। চৈত্র মাসে সূর্য যখন মাথার উপরে তখন মস্তক ঢেকে রাখা ওই বস্তু মোটেই আরামদায়ক হয় না। ওইটা আপনার ভাল লাগে না। আপনি ওইটা পরেন কারণ ওইটা পরলে এই সমাজ আপনারে ‘ভাল মেয়ে মানুষের সার্টিফিকেট’ দেবে। আপনারে বাহবা দেবে। ‘অমুকের মাইয়াটা’ পর্দানশীন বলে এলাকার ময়-মুরুব্বীগণ পানবিড়ি খেতে খেতে গপসপ করবে।

আপনি ওইটা পরেন কারণ না পরলে, বেয়াদব মেয়েছেলে হিসেবে আপনার বদনাম হবে। আপনি ওইটা পরেন কারণ, আপনার মা-খালা-ফুফুরে ওইটা পরতে দেখতেছেন। আপনি ওইটা পরেন কারণ, আপনার পরিবার বিশেষ করে আপনার পিতা, আপনার বড় ভ্রাতা, বড় বোন ওইটা পরতে আপনারে বাধ্য করছে। আপনি ওইটা পরেন কারণ আপনার বান্ধবীরা ওইটা পরে। আপনার স্কুলে, কলেজে, ভার্সিটিতে ওইটা পরার জন্য শিক্ষকগণের সরব কিংবা নীরব, লিখিত-কিংবা অলিখিত নির্দেশনা আছে।

বিজ্ঞাপন

এই যে অমুকে-তমুকে ভাল অথবা মন্দ বলবে, গুণগান কিংবা নিন্দা-মন্দ গাইবে এটা মাথায় রেখে, জ্বালাযন্ত্রণা সহ্য করেও মাথা ঢেকে ফেলেন। এই ঢাকনা দেওয়াতে ভীতি ছাড়াও ‘লাভ’ ও ‘লোভ’ দুটোই আছে। এইটারে কয় ইহকালের নগদ লাভ এবং পরকালের বাকী লোভ।

৪.
এই লাভ-লোভের পশ্চাতে আছে সুচতুর রাজনীতি। আপনি ওই রাজনীতির ঘুটি মাত্র। ধর্ম ও ধর্মাচার যতক্ষণ ব্যক্তিগত পর্যায়ে থাকে ততক্ষণ এটা মন্দ নয়। কিন্তু যখনই এটা সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধবাজ এবং ধান্দাবাজ ধর্মব্যবসায়ীদের হাতে পড়ে তখন এটা ভয়ংকর হয়ে ওঠে। এই ধর্মের নামে তখন হিংসা, ঘৃণা, জিহাদ, জঙ্গিবাদ, তালেবান, লাদেন, বাংলা ভাই, আইএস, বোকো হারাম জায়েজ হয়ে যায়। মানুষের দ্বারা মানুষ জবাই করা তখন ফরজ হয়ে ওঠে।

সব স্বাধীনতা আদতে তাই স্বাধীনতাই নয়, মুক্তিও নয়। নায়ক শাকিব খানের ক্ষেত্রে ফ্যাশনেবল ছেঁড়া প্যান্ট পরা তাঁর স্বাধীনতা হলেও বোরকা-হিজাব পরার স্বাধীনতা মোটেই স্বাধীনতা নয়, বরং নারীর স্বাধীন ও মুক্ত চলাফেরাকে নিয়ন্ত্রণ ও সংকুচিত করে বন্ধি করে রাখার পুরুষতান্ত্রিক ষড়যন্ত্র এইসব বোরকা-হিজাব। এই ষড়যন্ত্র মুখে জোয়াল, মাথায় বোঝা নিয়ে মোকাবেলা করা যাবে না। মুখ ও মাথা থেকে ওইসব জঞ্জাল তাড়াতে হবে আগে। মনে রাখতে হবে বিশ্বাস ব্যাপারটা হৃদয়ে ধারণ করার, মাথার মুকুট করে প্রদর্শন করার বিষয়বস্তু নয়।

 

সারাবাংলা/এসএস

 

Tags: , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন