বিজ্ঞাপন

‘মানুষ বিশ্বাস করা শুরু করেছিল যে, ভরসার একটা জায়গা আছে’

June 16, 2020 | 7:52 pm

চীনের হুবেই প্রদেশের রাজধানী উহান থেকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া নভেল করোনাভাইরাস সংক্রমণে সৃষ্ট বৈশ্বিক মহামারি কোভিড-১৯ এ আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ৮০ লাখ ছুঁই ছুঁই। আর এতে মৃত্যু হয়েছে প্রায় ৪ লাখ ৩০ হাজার মানুষের। এর মধ্যে আক্রান্ত ও মৃত্যুর দিক দিয়ে সর্বোচ্চ অবস্থানে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। দেশটিতে এ পর্যন্ত প্রায় ২২ লাখ মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। আর মারা গেছেন প্রায় সোয়া এক লাখ মানুষ। যুক্তরাষ্ট্রের ভয়াবহ করোনা পরিস্থিতির মধ্যেও বাংলাদেশি কমিউনিটিসহ দেশটির অন্যান্য নাগরিকদের চিকিৎসাসেবা দিয়ে আলোচনায় আসেন বাংলাদেশের চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ থেকে পাস করা ডা. ফেরদৌস খন্দকার। যুক্তরাষ্ট্রে বিভিন্ন পর্যায়ের রোগীদের সেবা দিয়ে এই চিকিৎসক আলোচনায় আসেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও। খুব দ্রুতই পরিচিত মুখ হয়ে ওঠেন বাংলাদেশেও। সম্প্রতি ডা. ফেরদৌস খন্দকারকে ঘিরেই বাংলাদেশের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম চলছে সমালোচনার ঝড়। কারণ এবার তিনি নিজের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে করোনাকালীন এই পরিস্থিতিতে মানুষের পাশে থাকতে দেশে এসেছেন গত ৭ জুন। বাংলাদেশে আসার পর থেকেই তিনি আছেন ব্র্যাক ট্রেনিং সেন্টারে কোয়ারেনটাইনে। কেন তিনি বাংলাদেশে এসেছেন? যুক্তরাষ্ট্র কীভাবে কোভিড-১৯ পরিস্থিতি মোকাবিলা করছে? কীভাবে নমুনা পরীক্ষা করানো হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে? কীভাবে কমেছে যুক্তরাষ্ট্রের পিক? এমন অনেক প্রশ্ন নিয়ে সারাবাংলার পাঠকদের জন্য ডা. ফেরদৌস খন্দকারের সঙ্গে কথা বলেছেন অনলাইন গণমাধ্যমটির সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট সৈকত ভৌমিক। আজ প্রকাশ হলো দুই পর্বের কথোপকথনের শেষ পর্ব।

বিজ্ঞাপন

সারাবাংলা: যুক্তরাষ্ট্রের কোভিড-১৯ পরিস্থিতির সঙ্গে যদি বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি তুলনা করা হয় তবে এখানকার পরিস্থিতি এখন কোন দিকে যাচ্ছে বলে মনে করেন?

ফেরদৌস খন্দকার: বাস্তবতা হচ্ছে, মানুষের যদি নিজ উদ্যোগ না থাকে তবে যেকোনো দেশের পক্ষে পরিস্থিতি মোকাবিলা করা কষ্টসাধ্য। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম নয়। কোনো সংগঠন, কোনো রাষ্ট্র, কোনো হাসপাতাল দুর্যোগ পরিস্থিতিকে বদলাতে পারে না। মানুষ যে যেখানে আছে সেখান থেকেই তাকে সচেতন হতে হবে। একজন মানুষ যদি সামান্য একটু আদা কেনার জন্য দোকানে যায় তবে সেটা কিন্তু ঠিক হবে না। এই মুহূর্তে ভাবতে হবে একটি পরিবার কীভাবে পাঁচটি পরিবারের জন্য বাজার করতে পারবে। সেভাবেই চলার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। সবার এখন সচেতনতা প্রয়োজন। এছাড়া কঠিন পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। এরপরেও বলতে হয় বাংলাদেশের চিকিৎসক সমাজ নিজেদের উজাড় করে দিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও কাজ করে যাচ্ছেন। গণমাধ্যমকর্মীসহ অন্যান্য পেশাজীবী যারা আছেন তারাও কিন্তু কাজ করছেন যার যার অবস্থান থেকে। বাকি যারা আছেন তাদের কিন্তু ঘরে থেকে সচেতন হয়ে নিজেদের কাজ করতে হবে।

সারাবাংলা: যুক্তরাষ্ট্রে প্রাইভেট চিকিৎসকদের বুস্টআপ করার জন্য কি আলাদা কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল সরকারের পক্ষ থেকে? বা আপনার কীভাবে কমিউনিটির মধ্যে কাজ করেছিলেন?

বিজ্ঞাপন

ফেরদৌস খন্দকার: যারা প্রাইভেট প্র্যাকটিস করে তাদের বিষয়ে সরকারের আসলে কোনো দায়িত্ব নেই। যে চিকিৎসক কোনো একটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করে এ বিষয়ে দায়বদ্ধতা একমাত্র সেই প্রতিষ্ঠানের। আমি ব্যক্তিগতভাবে কিছু পিপিই কিছু জায়গা থেকে কিনে নিয়েছি। ৯০ শতাংশ প্রাইভেট ফিজিশিয়ান ওটাও পারেনি। সেজন্য কমিউনিটি চিকিৎসায় তাদের সেভাবে পাওয়া যায়নি।

সারাবাংলা: যুক্তরাষ্ট্রে আপনি বলেছেন পিপিই সংকট ছিল ও আছে। বাংলাদেশে এখনও এমন অভিযোগ আছে। আপনারা কীভাবে এই সংকট মোকাবিলা করে কাজ করেছেন?

ফেরদৌস খন্দকার: যুক্তরাষ্ট্রে পিপিই সংকট এখনও আছে। আমি আসার আগের দিনও সেখানে অর্ডার দেওয়ার চেষ্টা করেছি। কিন্তু পিপিই কোথাও নেই। আমরা অনেকেই যারা প্রাইভেট প্র্যাকটিস করি তারা রেইনকোট অর্ডার করেছি। এছাড়া আসলে কী করব? এটা আসলে বৈশ্বিক সমস্যা। কিন্তু একজন চিকিৎসক হিসেবে পিছিয়ে থাকার কোনো উপায় নেই। আর তাই কাজ করে যাওয়ার চেষ্টা করি সব সময়।

বিজ্ঞাপন

সারাবাংলা: পিপিই সংকটের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের প্রাইভেট চিকিৎসকরা কি চেম্বার বন্ধ করে দিয়েছিলেন?

ফেরদৌস খন্দকার: এক্ষেত্রে আসলে আমরা কিছু মানুষ চেষ্টা করেছি ক্লিনিক বা চেম্বার চালিয়ে যেতে। দেখা গেছে, কিছু ডেডিকেটেড সেন্টার ও কিছু ডেডিকেটেড ফিজিশিয়ান মিলে কাজ চালিয়ে গেছে।

সারাবাংলা: যুক্তরাষ্ট্রে কোভিড-১৯ আক্রান্ত এমন অনেকেই আছে যারা হাসপাতালে যেতে পারছেন না, তারা বাংলাদেশের মতো বাসায় থেকে চিকিৎসা নিয়েছেন?

ফেরদৌস খন্দকার: হ্যাঁ যুক্তরাষ্ট্রে এরকম অনেক আছে। আর এটা বিশ্বের প্রায় সব দেশেই একই নিয়মে হয়ে থাকে।

বিজ্ঞাপন

সারাবাংলা: বাসায় চিকিৎসা নেওয়ার ক্ষেত্রে অনেকের মাঝে আতঙ্ক করে। আমরা দেখেছি আপনি অনেকের বাসায়ও গিয়েছেন। এই বিষয়টা রোগীদের কি সাহস যুগিয়েছিল বলে মনে করেন?

ফেরদৌস খন্দকার: কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে অনেক চিকিৎসক শুরুতেই অসুস্থ হয়ে পড়ে। আমি তখন ভাবছিলাম আমাদের কমিউনিটির রোগীরা কী করবে? হাসপাতালগুলোতে রোগী পরিপূর্ণ। আবার অনেকেই হাসপাতালে যেতেও ভয় পাচ্ছে। পাশাপাশি অনেকের কাছ থেকে চিকিৎসা না পাওয়ার অভিযোগ শুনছিলাম। আমার কাছে মনে হলো, এটা আসলে ঠিক হচ্ছে না। তখন আমি আমার ব্যক্তিগত মোবাইল নম্বর ওপেন করে দিই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে শুরু করে সবখানে। এরপরে প্রতিদিন আমার কাছে প্রচুর ফোন কল আসা শুরু হয়। আমার যেহেতু অনেক রোগী আছে, তাই সবার ফোনের উত্তর দেওয়া শুরু করি। যতটুকু পেরেছি চেষ্টা করেছি। সকাল সাড়ে সাতটা থেকে রাত দুইটা পর্যন্ত আমি এভাবেই চালিয়ে গেছি। এটার কারণে আসলে চিকিৎসা কী দিতে পেরেছি জানি না। কিন্তু মানুষ বিশ্বাস করা শুরু করেছিল যে, ভরসার একটা জায়গা আছে। যেখানে চাইলে আমি ফোন করতে পারব। এটা আসলে তাদের মানসিকভাবেও অনেক সাহস যুগিয়েছে। আবার অনেকে দেখা গেছে হাইয়ার সেন্টারে দেখিয়ে গিয়ে ভাষাজনিত সমস্যার কারণে আমাকে ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করতো, ভাইয়া এমন হয়েছে, কী করব? মানুষ আসলে আমাকে ভরসার একটা জায়গা থেকে নিয়েছে।

সারাবাংলা: যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমানে যে অবস্থায় তাতে মনে হচ্ছে, তারা পিক থেকে নেমে আসছে। এটা কী তাদের উন্নত স্বাস্থ্য ব্যবস্থার জন্য নাকি জনসাধারণের সচেতনতার কারণে হয়েছে?

ফেরদৌস খন্দকার: এটা একমাত্র সম্ভব হয়েছে মানুষের সচেতনতার কারণে। তারা সবাই ঘরে থেকেই কাজ করছে। বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেছে। একমাত্র এটাই কারণ; যার জন্য তারা আজ পিক থেকে নেমে আসতে পারছে। আমাদের দেশের সঙ্গে তাদের পার্থক্য হলো, যুক্তরাষ্ট্র সরকার যখন শুরুতেই সবাইকে বলল, সবাইকে ঘরে ঢুকে যেতে হবে। তখন তারা সবাই কিন্তু ঘরে ঢুকে গেছে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, বাংলাদেশেও এরকম আদেশ জারির পর মোটামুটি বড় একটা বড় অংশ এটি আমলে নেয়নি। আমার অবজার্ভেশনে উচ্চ মধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিত্তরা বাসায় ঢুকে গেছে। বাকিরা হয় এখনও অসচেতন অথবা তাদের অবস্থা আসলে ঘরে থাকার মতো না।

সারাবাংলা: এক্ষেত্রে যারা বাসায় থেকেই যুক্তরাষ্ট্র সরকার কী তাদের বাসায় কোনো আর্থিক বা মানবিক সাহায্য পাঠিয়েছে? বিশেষ করে দৈনন্দিন যে চাহিদা রয়েছে, সেগুলো কি যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের জন্য নিশ্চিত করা হয়েছিল?

ফেরদৌস খন্দকার: এটা সত্য যে, সরকার সেখানে ব্লাইন্ডলি বলে দিয়েছে যে, যাদের আর্থিক আয় একটা নির্দিষ্ট সীমার নিচে তারা সবাই জনপ্রতি এত টাকা পাবে। এটা নিশ্চিতভাবেই কমিউনিটিকে বাসায় রাখতে করা হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের পরিস্থিতিতে এটা করা একটু কষ্টসাধ্য। যেমন ধরুন, যুক্তরাষ্ট্রে সবাই ট্যাক্স রিটার্ন করতে বাধ্য। আপনি ট্যাক্স দেন বা না দেন আপনাকে এই ট্যাক্স রিটার্ন ফাইল করে জানাতে হবে যে, আপনি জীবিত আছেন। এ কারণে সরকারের কাছে প্রত্যেক মানুষের তথ্য-উপাত্ত থাকে। কার ইনকাম কত, কে কোথায় আছে, তা এক ক্লিকেই বলা যায়। এই ডাটাবেইজ মেইনটেইন করার কারণে তারা যথাযথভাবে সবার ইনকাম চেক করে একটা প্রণোদনার ব্যবস্থা করতে পেরেছে। এর জন্য তাদের সবার প্রয়োজনীয়তা হিসেব করতে সুবিধা হয়েছে।

সারাবাংলা: প্রথমদিকে যুক্তরাষ্ট্রে উপসর্গহীন ব্যক্তিদের নমুনা পরীক্ষা করানো হয়েছিল? বাংলাদেশে যেমন শুরুর দিকে নমুনা পরীক্ষা করা হচ্ছিল শুধুমাত্র উপসর্গ দেখে। এক্ষেত্রে আমরা দেখেছি যুক্তরাষ্ট্রে সিডিসিও শুরুর দিকে একইভাবে নমুনা পরীক্ষা করে। পরে তারা নমুনা পরীক্ষা কীভাবে বাড়ায়?

ফেরদৌস খন্দকার: না, যুক্তরাষ্ট্রে শুরু থেকে সবার নমুনা পরীক্ষা করানো হয়নি। নমুনা পরীক্ষার অভাব প্রথম ছয় থেকে আট সপ্তাহ ছিল। প্রথমদিকে আমরা একেবারেই নমুনা পরীক্ষা পাইনি। তারপরে যখন টেস্ট কিট কিছু কিছু আসে কিন্তু তখন দেখা গেলো পিপিই সংকট। কারণ পিপিই ছাড়া তো নমুনা সংগ্রহ সম্ভব না। এ কারণে টেস্ট কিট এসেও লাভ হয়নি। এ কারণে মোটামুটি হাসপাতাল ছাড়া আর কোথাও প্রথম দেড় থেকে দুই মাস তেমন কাজ হয়নি। ততদিনে যা ক্ষতি হওয়ার হয়ে গেছে। এমনকি আমি আসার আগ পর্যন্ত অনেক জায়গায় দেখেছি, টেস্টিং কিট আছে কিন্তু পিপিই নাই। সেক্ষেত্রে জ্বরের রোগী থাকলে কী করা যায়? এজন্য সবাইকে হাসপাতালে যেতে বলা হয়েছে।

সারাবাংলা: বাংলাদেশে বর্তমানে নমুনা সংগ্রহ বুথ বসাতে গেলেও বাধা দেওয়া হচ্ছে। আইসোলেশন সেন্টারও কিছু এলাকায় করা যাচ্ছে না স্থানীয়দের বাধার কারণে। এমনটা কি যুক্তরাষ্ট্রের কমিউনিটিতে হয়েছে?

ফেরদৌস খন্দকার: না। বরং এ বিষয়ে আরও সাহায্য এবং সহযোগিতা পাওয়া গেছে। পার্কিং লটে, পার্কে, অফিস, ফার্মেসিসহ বিভিন্ন স্থানে বুথ স্থাপন করা হয়েছে সকলের সহযোগিতায়। কারণ এটাতো সবারই উপকার আসবে।

সারাবাংলা: আজ এ পর্যন্তই। সুন্দর আগামীর প্রত্যাশা আপনার জন্য।

ফেরদৌস খন্দকার: ধন্যবাদ সারাবাংলাকেও। প্রত্যাশিত নতুন ভোরের অপেক্ষায় সবাই। একদিন সেই ভোর আসবেই। এবং সেটা খুব শিগগিরই।

আরও পড়ুন: ‘রাজনীতি করতে আসিনি, সেবা দিয়ে মাটির ঋণ শোধ করতে এসেছি’ (প্রথম পর্ব)

সারাবাংলা/এসবি/পিটিএম

Tags: , , , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন