বিজ্ঞাপন

আমাদের সেই ‘শৈশব’কে খুন করে ফেলার চেষ্টা হয়েছে!

March 6, 2018 | 9:56 am

তখন ক্লাস সিক্সে পড়ি । জন্মদিনে একটা বই পেলাম বাচ্চা ভয়ঙ্কর কাচ্চা ভয়ঙ্কর। ফ্ল্যাপে লেখা-এই যে রইসউদ্দিন-এতবড় একজন সাহসী মানুষ, তিনিও কিন্তু একটা জিনিসকে খুব ভয় পান। সেটি জিনিসটি মাকড়সা নয়, জোঁক বা বিছে নয়, পুলিশ কিংবা মিলিটারি নয়, ঝড় বা ভূমিকম্পও নয়, তিনি বাচ্চা-কাচ্চাকে একেবারে যমের মতো ভয় করেন।

বিজ্ঞাপন

আমি সবেমাত্র তিন গোয়েন্দা থেকে চোখ সরিয়ে অন্য বই পড়ার আগ্রহ পেতে শুরু করেছি। ঠিক ওই সময়ে এমন একটা বই আমার সামনে একটা নতুন অধ্যায় খুলে দিল। পাঠ্যবইয়ে বইটা লুকিয়ে, সেই রাতেই বইটা শেষ করলাম! মনে হল এত চমৎকার বই আগে কখনো পড়িনি। সেই থেকে জাফর ইকবাল স্যারের সাথে আমার পরিচয়। তারপর থেকে আজও সেই পরিচয় ফিকে হয়নি।

আমাদের শৈশব কেটেছে দিপু নাম্বার টু হতে চেয়ে, পথচারী স্কুলের মত একটা স্কুলের স্বপ্ন দেখে । কতদিন বাসার পুরানো রেডিও, টেলিভিশন , চার্জার লাইট খুলে দেখেছি বলে বকা খেয়েছি , একটা স্ক্রু ড্রাইভার আর ছুরি নিয়ে কত যে অকাজ করে বেরিয়েছি তার হিসাব নেই ।

আমার বন্ধু রাশেদ এ মিশে আছে আমাদের কান্না , দেশকে ভালবাসার তাড়না।

বিজ্ঞাপন

জাফর ইকবাল স্যার আমাদের কাছে আমাদের শৈশব এর সান্তাক্লজ বুড়োটা , যে তার ঝুলি ভর্তি খুশি নিয়ে হাজির হতেন প্রতি বই মেলায় । আমরা সেই সব বই পড়ে হাসতাম, কাঁদতাম, কখনো দেশের জন্য কিছু করতেই হবে, পণ করতাম । পাহাড়, নদী ছাড়িয়ে কল্পনার রথে ঘুরে বেড়াতাম কত বর্ণিল জগতে ।

গত শনিবারআমাদের সেই শৈশব কে খুন করে ফেলার চেষ্টা হয়েছে।

আমরা যারা শৈশবে জাফর স্যারের বই পড়েছি, তাদের কাছে জাফর স্যার শুধু একজন লেখক নন, কিংবা টেলিভিশনের পর্দায় দেখা ভারিক্কি কোন শিক্ষক নন। জাফর স্যার আমাদের কাছে আমাদেরই একজন মানুষ। যার প্রতি আমাদের ভালবাসা, সম্মান জন্মেছে সেই শৈশবে তাই এই সম্মানের কোন তুলনা চলে না । রাজনীতি, মতভেদ, এখানে মুখ্য না, মুখ্য হল আমরা সবাই জাফর স্যারের সৃষ্ট প্রজন্ম । আমরা গর্ব করেই বলি আমরা আসলেজাফর ইকবাল প্রজন্ম ।

বিজ্ঞাপন

আমরা বড় হয়েছি তার লেখা পড়ে পরে, তার লেখার হাত ধরে ধরে।

একটু বড় হয়ে পড়তে শুরু করলাম স্যার এর লেখা সাইন্সফিকশনগুলো । বিজ্ঞান ভীতি ছিল আমার আজীবন ! কিন্তু স্যার যা লিখতেন তাই যেন বুঝে ফেলতাম এক নিমিষে। রাতের আকাশে সেই সব গ্রহ- নক্ষত্রগুলো খুঁজে বেড়াতাম । মহাকাশটা সম্পর্কে জানতে চাইতাম । নভোচারী হবার স্বপ্নও দেখতে শুরু করলাম। তাই একবার এক জন্মদিনে একটা টেলিস্কোপ কেনার বায়না ধরলাম। সে ইচ্ছে আলোর মুখ দেখেছিল অনেক পরে, তবে সেই স্বপ্নের বীজ জাফর স্যার ই বুনে দিয়েছিলেন ।

এইবার জাফর ইকবাল স্যারকেই কিছু কথা জানাই। স্যার, আপনাকে নিয়ে একটা ছোট অভিমান ছিল আমার। সময়টা প্রথম চার ব্লগার গ্রেফতার হবার দিন পাঁচেক পর, আমি তখন পাগলের মত এদিক ওদিক ছুটছি । হঠাৎ একদিন মনে হল সবাই আপনাকে মেইল করে, আমিও করি । যেই ভাবা সেই কাজ, আপনাকে অনেক কথা লিখে ফেললাম। তারপর অনেকটা সময় অপেক্ষায় ছিলাম আপনি হয়ত দেখবেন কিন্তু দেখলেন না । তার অনেক পরে আপনার সাথে আমার দেখা হল বইমেলায় । সত্যি বলি, সেদিন খুব অভিমানী চোখে আপনার অটোগ্রাফ নিতে গিয়েছিলাম, কিন্তু আপনি যখন হাসলেন, আমি সত্যি সত্যি সব ভুলে গেলাম। সেদিন প্রথম মনে হল আপনার উপড়ে অভিমান করা যায় না । এত হাজার হাজার মেইলের ভীরে আপনি যে আমার বার্তা পাবেন না এবং সেটাই স্বাভাবিক, সেদিন বুঝেছিলাম।

স্যার , আপনার কলাম সমগ্র পড়ে প্রথম রাজনীতির অলিগলির সাথে আমার পরিচয়। জামাত যে একটা ভয়াবহ রোগের নাম, মুক্তিযুদ্ধ আমাদের যে অস্তিত্বের লড়াই ছিল এবং আমরা যে এখনো সেই সব দেশবিরোধী প্রেতাত্মা মুক্ত নই, সেটা আপনার লেখার মাধ্যমে আমার ভেতরে একটু একটু করে প্রবেশ করতে থাকে। অন্ধকার থেকে আলোতে হাঁটার পথটা আপনি দেখিয়েছিলেন। এই যে এত বড় একটা গনজাগরণ হল, সেখানে আনন্দোলন করা প্রত্যেকে কম বেশি আপনার লেখা পড়েছে। একটা প্রচণ্ড জটিল বিষয় কে আপনি আমাদের মাঝে অদ্ভুত সরল ভাষায় প্রবেশ করিয়ে দিয়েছেন। শুধু এই একটা কাজের জন্য হলেও আপনাকে ভালবাসা যায়।

বিজ্ঞাপন

স্যার , আপনি হয়ত দোষ ত্রুটিমুক্ত মানুষ নন, মাঝে মাঝে আপনার অনেক সাদাসিধে কথার সাথে অকপটে দ্বিমত করেছি এবং জানি আপনি সব সময় চান আমরা যেন দ্বিমত করতে শিখি, আস্থা রাখি দ্বিতীয় বিদ্যায়, যুক্তির আলোয় মুক্তি খুঁজি, প্রশ্ন করতে শিখি । ঠিক সেটাই আমরা করি, করেছি, করছি। একটা বিষয় নিয়ে যুক্তির পর যুক্তি দেই, তার পক্ষে-বিপক্ষে মতামত থাকে অসংখ্য, কত কত তথ্য উপাত্তে সমৃদ্ধ হয় সেই আলোচনাগুলো , আপনি নিশ্চয়ই সে সম্পর্কে জানেন । সেই সব আলোচনায় আমাদের জানার পরিধি বাড়ে, আমরা একটু একটু করে জ্ঞানের পথে এগিয়ে যাই । এভাবেই আমরা কুসংস্কারমুক্ত হই।

স্যার, একের পর এক ব্লগার, প্রকাশক, বুদ্ধিজীবী হত্যা এই দেশের জন্য প্রচণ্ড একটা ঝড় ছিল । যখন কেউ কথা বলছিল না তখন আপনি দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করে গেছেন । অভিজিৎ দা কে নিয়ে আপনার লেখা কলাম পড়ে কতটা শক্তি পেয়েছি সে সব আজ নাই বা লিখলাম। প্রশ্ন ফাঁসের প্রতিবাদ করেছেন সব সময় । অভিমান করে বৃষ্টিতে বসে থেকেছেন শুধু এই দেশটার জন্য, এই দেশের মানুষগুলো জন্য। যখনই দেশ সঙ্কটে পরে আপনি সেখানে প্রতিবাদ করবেন, সেটা আমরা কেন যেন ধরেই নিয়েছি। সমস্ত অপবাদ মাথায় নিয়ে আপনি সব সময় প্রগতির পথেই হেঁটেছেন। সব চেয়ে অন্ধকার সময়ে আপনি আলোক বর্তিকা নিয়ে আমাদের পথ দেখিয়ে গেছেন । আপনাকে যারা খুন করতে চায় আপনি ওদেরও ভালবাসেন। স্যার আপনি কেন এত বোকা? কেন আমাদের মত অকৃতজ্ঞদের জন্য দেশে পড়ে আছেন ?

স্যার , আপনি সুস্থ হয়ে ফিরে আসুন । আমি যে দিন মা হব, সেদিন থেকে আমার বাচ্চাটা কে আপনার গল্প শোনাব , ও ঠিক আমার মত আপনার বই পড়ে হাসতে শিখবে , দেশ কে ভালবাসতে শিখবে।

আমি জানি, যেদিন ওর মাথায় আপনি ঢুকে যাবেন, সে দিন থেকে কোন অন্ধত্ব ওকে গ্রাস করতে পারবে না । আপনি যেখানে থাকবেন সেখানে কখনো অন্ধকার হবে না , কখনো না ।

আপনাকে ভালবাসি স্যার । আমাদের জন্য আপনাকে থাকতে হবে।, পরের প্রজন্মের জন্য আপনাকে বাঁচতে হবে । আপনাকে ছাড়া এই দেশ, এই জাতির প্রগতি সম্ভব না।

লেখক: সুইডেন প্রবাসী বাংলাদেশি

[এই কলামে তুলে ধরা সকল মত লেখকের নিজের]

সারাবাংলা/এমএম

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন