বিজ্ঞাপন

‘এমন হাসপাতালে কেন যে বাবাকে নিয়ে এলাম!’

June 25, 2020 | 3:50 pm

সোহেল রানা, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: বুধবার (২৪ জুন), বেলা ১১টা। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নতুন ভবন। কোভিড-১৯ চিকিৎসা কেন্দ্রের নিচতলা। একটি মৃতদেহ জড়িয়ে ধরে কাঁদছেন স্বজনরা। মৃত ব্যক্তির ছেলে বাহাউদ্দিন এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করছেন আর বলছেন, ‘এমন হাসপাতালে কেন যে বাবাকে নিয়ে এলাম!’

বিজ্ঞাপন

পরে বাহাউদ্দিনের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তিনি জানান, তাদের বাড়ি কদমতলির ধনিয়ায়। তার বাবা মিয়াজি উদ্দিন (৮০)। শুধু ডায়বেটিক ছিল তার। ভোরে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। তখনই একটি অ্যাম্বুলেন্সে করে চলে আসেন ঢাকা মেডিকেলে। হাসপাতালে এসেই পড়েন বিপাকে। নেই কোনো লোকজন, নেই হুইলচেয়ার, নেই কোনো অক্সিজেন ব্যবস্থা। পরে জরুরি বিভাগ থেকে ট্রলি নিয়ে এসে বাবাকে নিয়ে যান ছয়তলায়। সেখানে গিয়ে পড়েন আরও বিপদে। নেই কোনো চিকিৎসক, নেই কোনো নার্স।

বাহাউদ্দিন বলেন, ‘কিছুক্ষণ পর এক চিকিৎসক এসে বলেন, নার্সকে বলেন; নার্সের কাছে গেলে বলেন, আগে চিকিৎসক দেখবেন। এভাবে কিছুক্ষণ অতিবাহিত হওয়ার পর দেখি, বাবা আর নড়াচড়া করছেন না। পরে এক ওয়ার্ড বয়ের মাধ্যমে ইসিজি করে দেখা যায়, বাবা দুনিয়াতে নেই।’

শুধু বাহাউদ্দিনের বাবা নয়, এভাবে বিনা চিকিৎসায় ঢামেক হাসপাতালে মারা যাচ্ছে অনেক মানুষ। তাদেরই একজন শরিফা বেগম (৫০)। বাড়ি নারায়ণগঞ্জের মদনপুরে। সাত বছর ধরে লিভার জটিলতায় ভোগার পর চিকিৎসা নিয়ে প্রায় সুস্থ হয়ে উঠছিলেন। কিন্তু মাঝে বাধ সাধে করোনাভাইরাস। হঠাৎ শরিফার লিভার জটিলতা বেড়ে যায়। তখন নারায়ণগঞ্জের একটি হাসপাতালে নিয়ে গেলে করোনার অজুহাত দেখিয়ে তার ভর্তি নেওয়া হয়নি। অবশেষ তাকে চলে আসতে হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। হাসপাতালে তখন সবেমাত্র কোভিড-১৯ রোগীদের চিকিৎসা শুরু হয়েছে। কোভিড-১৯ পরীক্ষার জন্য শরিফারও নমুনা নেওয়া হয়। কিন্তু করোনার ভয়ে ডাক্তার-নার্স কেউই তার কাছে আসতো না। এক পর্যায়ে তার অবস্থা মারাত্মক খারাপ হয়ে যায়। এরই মধ্যে শরিফার করোনা নেগেটিভ আসে। কিন্তু ততক্ষণে সে না ফেরার দেশে।

বিজ্ঞাপন

শরিফার স্বামী আব্দুর রশিদ বলেন, ‘লিভারের চিকিৎসা নেওয়ার পর বেশ ভালোই ছিল। এই করোনাকালে হঠাৎই বেড়ে যায় তার সমস্যা। নারায়ণগঞ্জের মদনপুর অ্যাক্টিভেট হাসপাতালে যাই স্ত্রীকে নিয়ে। করোনার অজুহাত দেখিয়ে সেখানে চিকিৎসা দেওয়া হয়নি তাকে। পাঠিয়ে দেয় ঢাকা মেডিকেলে। ঢাকা মেডিকেলে এসে নতুন ভবনের ৭০২ নম্বর ওয়ার্ডে ভর্তি করি। সেখানে করোনা ভাইরাসের নমুনা নেওয়া হয়। কিন্তু করোনার ভয়ে চিকিৎসক, নার্স, ওয়ার্ডবয় কেউই কাছে আসেনি। এক সময় তার অবস্থা মারাত্মক খারাপ হয়ে মৃত্যুর কোলো ঢলে পড়ে। এর মধ্যে করোনার রিপোর্টও আসে নেগেটিভ। কিন্তু বিনা চিকিৎসায় শরিফাকে চলে যেতে হলো।’

এমনই আরেকজন সাবেতুন আক্তার (১৯)। তাদের বাড়ি মুন্সিগঞ্জের লৌহজং উপজেলায়। সদ্য সন্তান প্রসব করা সাবেতুনের অবস্থা খারাপ হলে পরিবারের লোকজন ঢামেক হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে নিয়ে আসে। কিন্তু এখানেও তাদের পড়তে হয় ভর্তি জটিলতায়। অবশেষে কয়েকজন গণমাধ্যমকর্মীর অনুরোধে ভর্তি নিলেও এক ঘণ্টা পর মারা যায় সাবেতুন।

বিজ্ঞাপন

সাবেতুনের স্বামী রাহাতুল জানান, এর আগে অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আসেন তারা। আসার পর তাদের পাঠানো হয় ২১২ গাইনি ওয়ার্ডে। সেখানে করোনাভাইরাসের ভয় দেখায় কিছু দালাল। পরে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় পান্থপথের লাইফ এইড জেনারেল হাসপাতালে। সেখানেই সিজারের মাধ্যমে সন্তান প্রসব করে সাবেতুন। সেখানে খরচ হয় ২৫ হাজার টাকা।

রাহাতুল আরও জানান, এখানেই শেষ নয়,বাচ্চা হওয়ার কিছুদিন পর আবার অসুস্থ হয়ে পরে সাবেতুন। সিজারের জায়গায় ইনফেকশন হয়। আবারও ছুটে যান পান্থপথের সেই হাসপাতালে। সেখানে চারদিন ভর্তি রাখা হয়। এই চারদিনে বিল করে ৩২ হাজার টাকা। এক পর্যায়ে বেশি অসুস্থ হয়ে পড়লে সেখানে তার চিকিৎসা হবে না বলে জানিয়ে দেয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। তারা রোগীকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যেতে বলে। ততক্ষণে সাবেতুনের শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে গেছে।

রাহাতুল বলেন, ‘তাকে নিয়ে ছুটে যাই ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটে, যেখানে কোবিড-১৯ চিকিৎসা দেওয়া হয়। কিন্তু সেখানে সিট না থাকায় পাঠানো হয় বক্ষব্যাধি ও সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে। কিন্তু ওই দুই হাসাপাতালেও তার ভর্তি নেয়নি। আবারও পাঠিয়ে দেয় ঢাকা মেডিকেলে। সেখানে সিট না থাকায় তার ভর্তি নিচ্ছিল না। পরে কয়েকজন গণমাধ্যমকর্মীর অনুরোধে ভর্তি নেওয়া হয়। অবজারভেশনে রেখে অক্সিজেনও দেওয়া হয়। কিন্তু কিছুক্ষণ পর জানা যায়, মারা গেছে সাবেতুন।’

বিজ্ঞাপন

১৯ দিনের বাচ্চাকে নিয়ে এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে ছুটাছুটি করা সাবেতুনের বাবা-মাসহ আত্মীয়-স্বজন বলছিল, সাবেতুনের তো করোনা হয়নি। কেন তাকে বিনা চিকিৎসায় মরতে হলো?

এভাবে প্রতিদিন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যাচ্ছে রোগী। গত ২৪ ঘন্টায় মারা গেছে ১৩ জন। এর মধ্যে দুজনের কোভিড-১৯ পজিটিভ ছিল। বাকি ১১ জন উপসর্গ নিয়ে মারা গেছেন। এভাবে প্রতিদিন উপসর্গ নিয়ে এবং উপসর্গ ছাড়া মারা যাচ্ছে অনেক রোগী।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কোভিড-১৯ চিকিৎসার ৫৩ দিন অতিবাহিত হয়েছে। হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, ৫৩ দিনে করোনা উপসর্গ নিয়ে মারা গেছেন সাড়ে ছয়শ’র মতো রোগী। এছাড়া সাধারণ মৃত্যু তো রয়েছেই।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উপ-পরিচালক ডা. আলাউদ্দিন আল আজাদ বলেন, ‘একটি দেশে যুদ্ধ লাগলে সাধারণ জনগণও কিছু মারা যায়। বর্তমান প্রেক্ষাপটও এমন। করোনা এমন মহামারি আকার ধারণ করেছে যে, এখন করোনা আক্রান্তদের পাশাপাশি করোনা সন্দেহে চিকিৎসা না পেয়ে কিছু সাধারণ রোগীও মারা যাচ্ছে।’

তিনি বলেন, ‘প্রতিদিন অনেক অনেক রোগী হাসপাতালে আসছে। এর মধ্যে করোনা উপসর্গ নিয়েও আসছে, এর বাইরেও আসছে। করোনা রোগীর চিকিৎসা দিতে গিয়ে কিছু সাধারণ রোগীও মারা যাচ্ছে। ডাক্তার-নার্সদেরও কিছু সমস্যা আছে। অনেকেই ভয়ে কাছে যেতে চান না। তবে আমাদের পক্ষে যতটুকু সম্ভব রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।’

ডা. আলাউদ্দিন আল আজাদ জানান, বুধবার সকাল পর্যন্ত ঢামেকে ১৯২ জন কোভিড-১৯ পজিটিভ রোগী মারা গেছে। এছাড়া নতুন ভবনে ৫২৪ জন ও বার্ন ইউনিটে ১০২ জন রোগী ভর্তি আছেন।

সারাবাংলা/এসএসআর/পিটিএম

Tags: , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন