বিজ্ঞাপন

২০ বছর পরেও হতাশার অনুরণন

June 26, 2020 | 12:41 am

মহিবুর রহমান, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট

টেস্ট ক্রিকেটে ২০ বছর পেরিয়ে ২১ এ পা দিল বাংলাদেশ। ২০০০ সালের আজকের এই দিনে ক্রিকেট কুলিনদের ক্লাবে যোগ দেয় ১৬ কোটির ছোট্ট এই ব-দ্বীপ। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো ‍দুই দশকের লম্বা এই সময়টিতেও এই ফরম্যাটে স্বরুপে উদ্ভাসিত হতে পারেনি লাল সবুজের দল, ছড়াতে পারেনি উজ্জ্বলতার আভা। ওয়ানডে ফরম্যাটে যত্রতত্র উড়ন্ত পারফরম্যান্সে এশিয়ার উঠতি পরাশক্তি হিসেবে আখ্যা পেলেও কখনো কখনো সাদা তাদের পোশাকের পারফরম্যান্স ‘নবিশ’ বলেই স্বাক্ষ্য দেয়।

বিজ্ঞাপন

একথা অনস্বীকার্য যে টেস্ট মর্যাদা পাওয়ার শুরুর দিকটায় টাইগাররা কোনো রকম উইকেটে টিকে থাকার প্রত্যয়েই নামত। জয় নয়, ম্যাচ ড্র কিংবা বিব্রতকর হার এড়ানোই ছিল তখনকার একমাত্র লক্ষ্য। কিন্তু সময়ে পরিক্রমায় আজ তাদের মানসিকতা বদলেছে। উইকেটে টিকে থাকা, ড্র কিংবা বা লজ্জার হার এড়ানো নয় বরং এই বাংলাদেশ লাল বলের লড়াইয়ে নামে জয়ের অভিষ্ট লক্ষ্য নিয়েই। মাঠের খেলায়ও তার প্রতিফলন দেখা গেছে। দেশের মাটিতে পরাশক্তি অস্ট্রেলিয়া ও ইংল্যান্ডকে হারিয়ে দিয়েছে প্রবল বিক্রমে। বাদ যায়নি ওয়েস্ট ইন্ডিজও। বছর তিনেক আগে বিদেশের মাটিতেও দাপিয়েছে লাল সবুজের দল। ২০১৭ সালে শ্রীলঙ্কা সফরে শততম টেস্ট জয়ের তিলক কপালে পরে তবেই দেশে ফিরেছে। কিন্তু হালের বাংলাদেশ টেস্ট দল কেমন যেন অচেনা!

দৃশ্যটি বিশেষ করে চোখে পড়তে শুরু করেছে গেল নভেম্বরে ভারত সফর থেকে। ইনদোরে স্বাগতিকদের বিপক্ষে টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের প্রথম ম্যাচটি দেখে মনে হয়েছে আজও বুঝি টেস্ট মেজাজটাই বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের সত্বায় জন্ম নেয় নি! ২০ বছরের সুদীর্ঘ্য পথ চলায়ও তারা যেন টেস্ট ক্রিকেটের ব্যাকরণটাই রপ্ত করতে পারেননি! টেস্ট ক্রিকেট মানেই তো ধৈর্য্যের পরীক্ষা। গেরিলাদের মতো ঘণ্টার পর ঘণ্টা, সেশনের পর সেশন এখানে সুযোগের অপেক্ষায় কাটাতে হয়; এই মন্ত্রটাই যেন আজও শেখা হয়ে ওঠেনি লাল সবুজের যোদ্ধাদের! ব্যাটিংয়ে কেমন নবিশ নবিশ একটি ভাব! বোলিং, ফিল্ডিংয়ের অবস্থাও তথৈবচ।

বিজ্ঞাপন

সেটা মনে হত না যদি না ৫৮ দশমিক ৩ ওভারে ১৫০ রানেই প্রথম ইনিংসের সলিল সমাধি গড়ত। ইনদোরের উইকেটে তারা যদি সারা দিন আঁকড়ে এই সংগ্রহ গড়তেন বোধ করি কেউ তাদের দিকে আঙুল তুলতেন না। ক্রিকেটের বয়সে এত পরিণত কিন্তু কাজে তার লেশমাত্র ছিটে ফোঁটাও নেই। হোক না ভারতের অগ্নিস্ফুলিঙ্গ ঝরানো বোলিং তাই বলে একজন ব্যাটসম্যান ৫০ রানও করতে পারবেন না? কী দৃষ্টিকটুই না ছিল সেই পারফরম্যান্স! পাঁচ দিনের ম্যাচের প্রথম দিনেই এতটা বেহাল দশা এদেশের প্রতিটি ক্রিকেট প্রেমীর হৃদয় ক্ষতবিক্ষত করেছে। প্রশ্নের উদ্রেক করেছে তাদের সাদা পোশাকের সক্ষমতা নিয়ে।

এরপর কলকাতায় সিরিজের দ্বিতীয় ও শেষ ম্যাচ এবং পাকিস্তানের বিপক্ষে রাওয়ালপিন্ডিতেও ওই অভিন্ন দৃশ্য। অথচ বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড তাদের জন্য প্রতিটি বিভাগেই দক্ষ কোচের সুবন্দোবস্ত করেছে। ট্রেনার থেকে শুরু করে নামিদামি ফিজিও; বাদ যায়নি মনোবিজ্ঞানীর উপস্থিতিও। তাহলে বিশ পরেও কেন এদেশের এই বেহাল দশা?

বিজ্ঞাপন

টেস্টে বাংলাদেশ ক্রিকেটের ২০ বছর পূর্তিতে এই সময়োপযোগী প্রশ্নটিই সারাবাংলা রেখেছিল এদশের প্রথম টেস্ট অধিনায়ক নাইমুর রহমান দুর্জয়ের কাছে। জবাবে দুর্জয় যা বলেছেন তার সারমর্ম হলো, এই ২০ বছরে বাংলাদেশ অবশ্যই এগিয়েছে। তবে আরো এগুতো পারত যদি এদেশের ঘরোয়া ক্রিকেটটা ঠিকমত হত। অর্থাৎ তিনি বলতে চেয়েছেন যদি সংগঠকেরা এই ফরম্যাটের দিকে সুনজর দিতেন, উইকেট তৈরিতে আরো দূরদর্শিতার পরিচয় দিতেন তাহলে টেস্টেও মুমিনুল, মুশফিক, তামিমদের পারফরম্যান্সের গ্রাফ উর্ধ্বমুখিই হত। তবে শুধুই বোর্ডই নয়, লঙ্গার ভার্সনের প্রতি ক্রিকেটোরদের অনীহাকেও তিনি কাঁঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছেন। অর্থাৎ তার মতে এই দুই দশকেও এদেশে টেস্ট ক্রিকেটের সংস্কৃতিটা গড়ে উঠেনি। আরো একটি বিষয়কে তিনি অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে দেখছেন আর সেটা হলো, কম সংখ্যক টেস্ট খেলা।

দুর্জয়ের মুখেই শুনুন, ‘এই বিশ বছরে পিছিয়ে যাইনি অবশ্যই। সামনে আগানোর সময়টাই বেশি। কিন্তু বিশ বছর তো একরকম না তাই না? টেস্ট স্ট্যাটাস প্রাপ্তির পরের সময়টা একরকম। তখন সবার কাছেই বিষয়টি অপরিচিত ছিল। ওইটা ছিল শুরু। তারপর আস্তে আস্তে বুঝতে শেখা, জানতে শেখা, মোর ইম্পরটান্টলি খেলতে শেখা। তখন তো আমাদের কোচ, ফিজিও, ট্রেনার এত সাপোর্টিং স্টাফ ছিল না যা এখন আপনারা দেখতে পান। আমাদের সময়ে একজন কোচ থাকত আর একজন ফিজিও পেয়েছিলাম। এখনতো প্রতিটি বিভাগেই কোচ আছে, ট্রেনার, ফিজিও, সাইকোলজিস্ট রাখা হয়েছে। ধরেন প্রথম সময়টা আমাদের বুঝতে বুঝতেই চলে গেছে কে কিভাবে একটা টেস্ট খেলুড়ে দেশ চলে। এরপরে আমরা আস্তে আস্তে বুঝতে শিখি। সেখান থেকে আমাদের উন্নতিরও শুরু।’

‘আমাদের ক্রিকেট সংস্কৃতিটা যেমন ধরেন আঞ্চলিক ক্রিকেট, প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট বা লঙ্গার ভার্সনের প্রতি আমরা শুরুর থেকেই উদাসীন। এখানে সবারই আরেকটু আন্তরিকতার দরকার ছিল। সেটা প্লেয়ার বলেন বা সংগঠক বলেন সবাই আমরা ওয়ানডে কেন্দ্রীক। আমাদের সংস্কৃতিটা যদি লঙ্গার ভার্সন কেন্দ্রীক হত তাহলে আরেকটু ভালো করতাম। প্লেয়ারদের ক্ষেত্রে দেখা যায় ঘরোয়া ক্রিকেটে ওয়ানডেটা যেভাবে খেলে লঙ্গার ভার্সনটা অতটা সিরিয়াসলি খেলে না। অনেক সময় খেলার জন্য তাদের পাওয়াও যায় না। তাদের যত ব্যতিব্যস্ততা, কাজ; সব জমা থাকে লঙ্গার ভার্সনের জন্য। এই সময় এসে তারা জমে থাকা কাজ করবে, ছুটি নিবে। তো এই আন্তরিকতাটা প্লেয়ারদের ভেতরেও কম। সেখান থেকে আমাদের বদলাতে হবে। যদি সংগঠকদের কথা বলি এখন সুযোগ সুবিধা বেড়েছে, টাকা পয়সাও বেড়েছে। আগে শুধু আমরা ফ্ল্যাট উইকেটই চাইতাম। এখন কিন্তু ঘাস রাখাটা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। কেননা আমাদের শুধু ব্যাটসম্যান তৈরি করলেই হবে না, বোলারও তৈরি করতে হবে। এগুলো কিন্তু ১৫ বছর আগে ছিল না। শেষ দুই তিন বছরে হয়েছে। এই ক্ষেত্রে প্লেয়ার ও সংগঠক সবারই আন্তরিকতাটা বাড়াতে হবে তাহলে আমরা আরো ভালো করব। কারণ আমাদের মেধাবী ক্রিকেটারের অভাব নেই। কয়েকজন প্রতিভাবান সিনিয়র খেলোয়াড়ও আছে। যারা ধারাবাহিকভাবে সব ফরম্যাটেই ভালো পারফর্ম করছে। কিন্তু দল হিসেবে আমরা নিচের দিকে। এখন র‌্যাংকিংয়ে ওপরে যাওয়াটাই লক্ষ্য হওয়া উচিত এবং সেজন্য সবাইকে কাজ করতে হবে।’ যোগ করেন দুর্জয়।

বিজ্ঞাপন

টাইগার

গেল বিশ বছরে বাংলাদেশ মোট টেস্ট ম্যাচ খেলেছে মোট ১১৯টি। তন্মধ্যে জয় মাত্র ১৪টিতে, ৮৯ টিতে ম্যাচে হার আর ড্র হয়েছে বাকি ১৬টি। ঘরের মাঠে দশটিতে জয়। বাকি চারটি বিদেশে বিভুঁইয়ে। এরমধ্যে ২০০৯ সালে ওয়েস্টে ইন্ডিজ সফরে ২ জয়, ২০১৩ সালে হারারেতে স্বাগতিক জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ১টি ও সবশেষ জয়টি এসেছে ২০১৭ সালে শ্রীলঙ্কায় শতততম টেস্টে।

পরিসংখ্যান দেখে প্রশ্নের উদ্রেক হওয়াটা অযৌক্তিক নয়, তাহলে বিদেশের মাটিতে কেন দেশের মাটির অনুরুপ ম্যাচ জিততে পারেনি? এমন প্রশ্নে লাল সবুজের প্রথম টেস্ট দলপতির উত্তর হলো, ‘দেখেন হোম গ্রাউন্ডের বাড়তি সুবিধার একটি ব্যাপার কিন্তু থাকেই। তাছাড়া অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায় আমরা হঠাৎ করেই টেস্ট খেলতে যাই। দেখা যাচ্ছে আমরা টি-টোয়েন্টি খেলছিলাম হুট করে আমাদের টেস্টের সূচি এসে গেল। টেস্টের প্রস্তুতিটা কিন্তু ওরকম হতে হবে। তাছাড়া টেস্টের আগে যদি প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটটা ঠিকমতো না খেলেন, ঘরোয়া ক্রিকেটের যে সুযোগগুলো আছে সেগুলা কাজে না লাগান হঠাৎ করে কিন্তু ওদের সঙ্গে পারা যাবে না। কারণ ওরা টেস্ট খেলছে একশ দেড়শ বছর যাবৎ। তাদের সঙ্গে খেলতে যাওয়ার আগে আমরাাদের প্রস্তুতিটা আরো ভালো হওয়া উচিৎ, তাই না?’

সারাবাংলা/এমআরএফ/এসএস

Tags: , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন