বিজ্ঞাপন

নির্মলা সিং থেকে সরোজ খান: এক সাধারণের কিংবদন্তী হয়ে ওঠা

July 3, 2020 | 9:55 pm

এন্টারটেইনমেন্ট ডেস্ক

কোভিড-১৯’র কালো থাবায় যখন সারাবিশ্ব লড়াই করছে, তখন একের পর এক নক্ষত্রপতন। বিভিন্ন ক্ষেত্রে মানুষেরা একটা ধাক্কা সামলে ওঠার আগেই আরেকটি ধাক্কা এসে লণ্ডভণ্ড করে দিচ্ছে সবকিছু। বলিউডের সিনে পাড়া যেন তারই সাক্ষাৎ প্রতিফলন। একের পর এক শিল্পীকে হারাতে হচ্ছে সিনেপ্রেমীদের। ইরফান খান, ঋষি কাপুর, ওয়াজিদ খান, বাসু চ্যাটার্জী, সুশান্ত সিং রাজপুত— মৃত্যু যেন বলিউডের পিছু ছাড়তে চাইছে না। এবার তাদেরই পথ মাড়ালেন বলিউডের ‘নাচের রানি’খ্যাত কোরিওগ্রাফার সরোজ খান।

বিজ্ঞাপন

গতকাল (বৃহস্পতিবার) দিবাগত রাত ১টা ৫২ মিনিটে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন বলিউডের বহু তারকার নেপথ্য কারিগর প্রিয় ‘মাস্টারজি’ সরোজ খান। একের পর এক ব্যবসাসফল ছবির কোরিওগ্রাফার ছিলেন তিনি। ‘ডর’, ‘বাজিগর’, ‘ইয়ারানা’, ‘মোহরা’, ‘দিলওয়ালে দুলহনিয়া লে জায়েঙ্গে’, ‘খামোশি দ্য মিউজিক্যাল’, ‘পরদেশ’, ‘সোলজার’, ‘লগান’, ‘স্বদেশ’, ‘বীর জারা’, ‘মঙ্গল পাণ্ডে’, ‘ফানা’, ‘ডন’, ‘সাওয়ারিয়া’, ‘যব উই মেট’, ‘দিল্লি সিক্স’, ‘লভ আজ কাল’, ‘এজেন্ট বিনোদ’, ‘রাউডি রাঠৌর’, ‘গুলাব গ্যাং’, ‘তনু ওয়েডস মনু রিটার্নস’, ‘হম দিল দে চুকে সনম’, ‘দেবদাস’, ‘গুরু’, ‘চালবাজ’, ‘মণিকর্ণিকা’র মতো অসংখ্য বক্স অফিস সফল ছবিতে ছড়িয়ে আছে সরোজ খানের কৃতিত্ব।

সিনেমার নামগুলো যেমন, গানগুলোর শিরোনামে যেন তার কৃতিত্বটা আরও বেশি ফুটে ওঠে। ‘হাওয়া হাওয়াই’, ‘তাম্মা তাম্মা লোগে’, ‘এক দো তিন’, ‘চোলি কা পিছে ক্যায়া হ্যায়’, ‘ধাক ধাক কারনে লাগা’— এমন একের পর এক গানের কথা বলে শেষ করা যাবে না। এসব গানের অমরত্ব পাওয়ার পেছনে যে কেবল কথা-সুর আর সংগীতায়োজনই নয়, কোরিওগ্রাফিরও বড় ভূমিকা রয়েছে— তা অস্বীকার করার মতো খুব মানুষই রয়েছে।

বিজ্ঞাপন

সরোজ খানের জন্ম ১৯৪৮ সালের ২২ নভেম্বর, মুম্বাইয়ে। বাবা কিষণচন্দ সাধু সিং এবং মা ননীসাধু সিংহের মেয়ে সরোজ খানের প্রথম জীবনের নাম ছিল নির্মলা সিং। কেরিয়ার শুরু হয়েছিল মাত্র তিন বছর বয়সে ‘নজরানা’ ছবিতে অভিনয় দিয়ে। এরপর দীর্ঘ বিরতি দিয়ে পঞ্চাশের দশকে বলিউডের সিনেমা জগতে তিনি আবার ফিরে এলেন একজন নেপথ্য নৃত্যশিল্পীর ভূমিকায়। দীর্ঘদিন তাকে কঠোর পরিশ্রম চালিয়ে যেতে হয়। মাত্র ১৩ বছর বয়সে বিয়ে করলেন তার নৃত্যগুরু চল্লিশোর্ধ বি. সোহনলালকে। বিয়ের আগে নির্মলা ধর্মান্তরিত হয়ে নতুন নাম নিলেন ‘সরোজ খান’। এ প্রসঙ্গে গণমাধ্যমে দেওয়া বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে সরোজ খান বলেছিলেন, তিনি স্বেচ্ছায় ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। তার ওপর কোনো চাপ ছিল না।

সোহনলাল-সরোজ খানের দাম্পত্য জীবনে জন্ম নেয় তিনটি সন্তান— প্রথম সন্তান হামিদ খান (যিনি পরিচিত রাজু খান নামে) ও তৃতীয় সন্তান হিনা খান। হামিদের জন্মের দু’বছর পরেই দ্বিতীয় সন্তানের জন্ম হলেও মাত্র আট মাস বয়সেই মৃত্যু হয় তার। তৃতীয় সন্তান হিনা খানের জন্মের পরেই ফাটল ধরে সোহনলাল-সরোজ খানের দাম্পত্য জীবনে। বিচ্ছেদ হয়ে যায় তাদের। নিজের পরিচয় ও ধর্ম বিশ্বাসে সন্তানদের একাই বড় করেন কিশোরী সরোজ। পরবর্তীতে ব্যবসায়ী সর্দার রোশন খানকে বিয়ে করেন সরোজ খান। তাদের এই সংসারে জন্ম নেয় একমাত্র মেয়ে সুকাইনা খান, যিনি বর্তমানে দুবাইয়ে নৃত্য প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করছেন।

বিজ্ঞাপন

সরোজ খান তার প্রথম জীবনে একজন সহকারী নৃত্য পরিচালক হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করলেও বলিউডে একক নৃত্য পরিচালক হিসেবে যাত্রা শুরু করেন ১৯৭৪ সালে ‘গীতা মেরা নাম’ ছবিতে। কিন্তু তার মেধা ও দক্ষতার স্বীকৃতি পেতে তাকে অপেক্ষা করতে হয়েছে দীর্ঘ ১৩ বছর। ১৯৮৭ সালে মুক্তি পাওয়া অনিল কাপুর-শ্রীদেবী জুটির চূড়ান্ত ব্যবসাসফল ছবি ‘মিস্টার ইন্ডিয়া’তে শ্রীদেবীর ‘হাওয়া হাওয়াই’ নাচটির কোরিওগ্রাফি করে রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে ওঠেন সরোজ খান। শ্রীদেবী আর সরোজ খান— যেন একে অপরের পরিপূরক। শ্রীদেবী সঙ্গে ‘নাগিনা’ ও ‘চাঁদনি’ ছবিতে সরোজ খান দেখিয়ে দিলেন তার কাজ।

বলিউডের আরেক সফল অভিনেত্রী মাধুরী দীক্ষিত। তার সাফল্যের নেপথ্য কারিগর হিসেবে সরোজ খানকেই গণ্য করা হয় প্রতিটি ক্ষেত্রে। ‘তেজাব’ ছবিতে ‘এক দো তিন’, ‘থানেদার’র ‘তাম্মা তাম্মা লোগে’, ‘বেটা’ ছবিতে ‘ধক ধক করনে লগা’— সরোজ খানের কোরিওগ্রাফিতে একের পর এক মাধুরীর আইকনিক পারফরম্যান্স, যা চিরকালীন হয়ে রয়েছে বলিউড সিনেমা জগতে। এমন কি ২০১৯ সালে মাধুরীর সর্বশেষ মুক্তি পাওয়া ছবি ‘কলঙ্ক’-তেও শেষবারের মতো কোরিওগ্রাফি করেছেন সরোজ খান।

দু’হাজারের বেশি গানের কোরিওগ্রাফি করা সরোজ খান ‘দেবদাস’, ‘জব উই মেট’ ও তামিল ছবি ‘শৃঙ্গারম’র জন্য তিন বার জাতীয় পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছেন। তার প্রিয় নায়িকা ছিলেন শ্রীদেবী ও মাধুরী দীক্ষিত। নায়কদের মধ্যে অনিল কাপুর, হৃত্বিক রোশন ও হালের রণবীর কাপুরকে ভীষণ পছন্দ করতেন তিনি।

বিজ্ঞাপন

মাত্র ৭১ বছর বয়েসেই চলে গেলেন বলিউডের নায়ক নায়িকাদের সাফল্যের এই নেপথ্য কারিগর। বলিউড ছাড়াও সরোজ খানের গুণমুগ্ধের সংখ্যা ছিল বিশ্বজোড়া। শুক্রবার সকালে সরোজ খান’র মৃত্যুর খবর প্রকাশ্যে আসতেই শোকের ছায়া নেমে এসেছে বিনোদন জগতে। তার এই মৃত্যুতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একের পর এক পোস্টের মাধ্যমে শোক প্রকাশ করেছেন বলিউডের বিভিন্ন তারকা ও ব্যক্তিত্বসহ তার গুণগ্রাহীরা।

বলিউডের আরেক কিংবদন্তী অমিতাভ বচ্চন সরোজ খানের মৃত্যুতে শোক জানিয়ে লিখেছেন, ‘হাতজোড় করে রয়েছি, কিন্তু মন অশান্ত।’ ইনস্টাগ্রাম পোস্টে সরোজের সঙ্গে নানান স্মৃতির কথা তুলে ধরে অমিতাভ লিখেছেন, ‘তখন তিনি একজন নামী ডান্স পরিচালকের সহকারী হিসাবে কাজ করতেন। আর আমি সবে ক্যারিয়ার শুরু করেছি। অভিনেত্রী মুমতাজ তখন তারকা। আমার মতো নতুন একজনের সঙ্গে কাজ করতে সম্মতি দিয়েছিলেন। সেসময় আমি তারকা মুমতাজের কাছে কিছুই ছিলাম না। সরোজজিও তখন একগুচ্ছ শিল্পীর ভিড়ে নাচছিলেন। আমি খেয়াল করলাম, তিনি সন্তানসম্ভবা, তবুও নেচে চলেছেন’।

অমিতাভ বচ্চন একবার ভালো কাজের স্বীকৃতি হিসেবে সরোজ খানের কাছ থেকে এক টাকার কয়েন উপহার পেয়েছিলেন। সে প্রসঙ্গ উল্লেখ করে অমিতাভ আরো লিখেছেন, ‘সরোজ খান বলিউড ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিকে একটা নিজস্ব ছন্দ, স্টাইল ও শিল্প উপহার দিয়েছেন। গানের লাইনের সঙ্গে নাচের ভঙ্গী মিলিয়ে সেটিকে তাৎপর্যপূর্ণ করে তুলেছিলেন। যখন তিনি দেখতেন, কোনো শিল্পী ভালো কাজ করছে, তখন তাকে কাছে ডেকে নিতেন। দিতেন এক টাকার কয়েন। এটাই ছিল তার উপহার, পিঠ চাপড়ে দেওয়া। আর আমি বহুবছর কাজ করার পর সরোজজির কাছ থেকে এই উপহার পেয়েছিলাম।’ অমিতাভ তার ‘ডন’ ছবির ‘খাইকে পান বানারাসওয়ালা’ গানের জন্য সরোজ খানের প্রশংসা করে লিখেছেন, ‘এভাবেই সকলের কাছে সুন্দর স্মৃতি রেখে তিনি চলে গেলেন। আজ তাই মন ভারাক্রান্ত’।

গুরু সরোজ খানকে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন অভিনেত্রী মাধুরী দীক্ষিত, যিনি সবসময় স্বীকার করেছেন যে, আজ পর্যন্ত তার জীবনের সফলতার নেপথ্যে প্রধান ভুমিকায় ছিলেন সরোজ খান। তাই তাকে নিজের গুরু বলেই মানতেন তিনি। শুক্রবার সকালে তার মৃত্যুর খবর জেনে সোস্যাল মিডিয়ায় শ্রদ্ধা জানিয়ে মাধুরী লিখেছেন, ‘আমার গুরু এবং বন্ধু সরোজ খানের মৃত্যুর খবরে আমি গভীরভাবে বিধ্বস্ত। আমি সারা জীবন ওর কাছে কৃতজ্ঞ থাকব। ওর জন্যেই নাচের দিক থেকে আমি শীর্ষে পৌঁছাতে পেরেছিলাম। এই দুনিয়া এক অসাধারণ প্রতিভাকে হারাল। আপনাকে খুব মিস করব। ওর পরিবারের প্রতি আমার সমবেদনা রইল।’

প্রিয় ‘মাস্টারজি’কে খুবই সম্মান করতেন বলিউড কিং শাহরুখ খান। একবার শাহরুখকে চড় মেড়েছিলেন সরোজ খান। সেই স্মৃতিচারণ করে শাহরুখ জানিয়েছেন, “সেই শুরুর দিনের কথা। আমার সেই সময় খুব কাজের চাপ, তিন বেলাই কাজ করতে হচ্ছে। নিঃশ্বাস ফেলারও সময় নেই। একদিকে নিজেকে প্রমাণ করার তাগিদ, অন্যদিকে কাজের চাপে ক্রমাগত পিষে যাওয়ার উপক্রম। একদিন ক্লান্ত হয়ে নালিশের সুরেই ‘মাস্টারজি’কে বললাম, আর পারছি না, এত কাজ! যেই বলা অমনি মাস্টারজি আমার গালে ঠাস করে চড় কষিয়ে দিলেন! কেন জানেন? তার বক্তব্য ছিল— যাই হয়ে যাক না কেন, ‘আমার অনেক কাজ’ এ কথা যেন কেউ নিজে থেকে কোনোদিন না বলে। এটাই ছিল তার থিওরি। কারণ, অনিশ্চয়তার গ্ল্যামার জগতে কে যে কখন ওপরে উঠে যাবে, আর কেই বা এক ঝটকায় নেমে যাবে নিচে, তা কেউ জানে না।”

সেদিনের ‘মাস্টারজি’র দেওয়া সেই চড় যে স্নেহের, আদরের ছিল, সেটাই সবসময় মনে করেন শাহরুখ। তাই আজ সরোজ খানের মৃত্যুর পর টুইটারে তিনি লিখেছেন, ‘ইন্ডাস্ট্রিতে সরোজজিই ছিলেন আমার প্রথম প্রকৃত শিক্ষক’।

সারাবাংলা/এএসজি

Tags: , , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন