বিজ্ঞাপন

আধুনিক রূপচর্চায় প্রাচীন মিশরের প্রভাব

July 5, 2020 | 1:41 am

লাইফস্টাইল ডেস্ক

প্রাচীন মিশরের রহস্যের শেষ নেই। তবে প্রাচীন ওই সভ্যতায় সৌন্দর্য চর্চার কৌশল অবশ্য এখন আর অজানা নয়। আজকের বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের মেকআপ শিল্পকে হয়ত হালের নতুন আমলের ফ্যাশন বলে মনে হতে পারে তবে প্রাচীন বিশ্বের দৈনন্দিন জীবনেও মেকআপ সমান জরুরি ও গুরুত্বপূর্ণ ছিল। মিশরীয় সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তনের শুরু থেকেই সকল শ্রেণীর নারী ও পুরুষ উদারভাবে আইলাইনার, আইশ্যাডো, লিপস্টিক ও পাউডার ব্যবহার করত।

বিজ্ঞাপন

দুই বিখ্যাত রানী ক্লিওপেট্রা ও নেফারতিতির জীবন-যাপন, রূপ ও মোহনিয়তা দিয়েই আমরা মূলত প্রাচীন মিশরের সৌন্দর্য চর্চাকে বোঝা ও জানার চেষ্টা করি। প্রাচীন মিশরের সৌন্দর্যচর্চার আদর্শ মানদণ্ড হিসেবে আমরা এই দুই রানীকেই মনে করে থাকি। যেমন, ১৯৬৩ সালে এলিজাবেথ টেলর যখন ক্লিওপেট্রার চরিত্র অভিনয় করেন তখন তাতে মূলত প্রাচীন মিশরের সৌন্দর্যের চটকদার বর্ণনাই করা হয়েছে। এছাড়া ২০১৭ সালে এ যুগের মেকআপ ম্যাগনেট সঙ্গীত শিল্পী রিহানা ভোগ আরব ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদে প্রাচীন রানী নেফারতিতির সম্মানে তার মতো করে সাজেন। প্রাচীন মিশরের দুই রানীর মত সাজতে গিয়ে এলিজাবেথ টেলর ও রিহানা দুজনই নীল আইশ্যাডো ও ঘণ আইলাইনার ব্যবহার করেছিলেন- যা মূলত হাল আমলেরই ফ্যাশন।

যদিও প্রাচীন মিশরীয়রা শুধু তাদের দৃশ্যমান বাহ্যিক সৌন্দর্য বাড়াতে প্রসাধনী ব্যবহার বা মেকআপ করতেন না- আচার অনুষ্ঠান, অন্যান্য ব্যবহারিক তাৎপর্য যেমন, প্রতীকী অর্থেও প্রসাধনীর ব্যবহার করতেন- তবুও প্রাচীন মিশরীয়রা তাদের দৈনন্দিন সৌন্দর্য চর্চায় খুবই গুরুত্ব দিতেন। ‘মেকআপ শিল্পী’র প্রাচীন মিশরিয় হায়ারোগ্লাফিক অর্থটি ‘সেশ’ থেকে উদ্ভূত যার অর্থ ‘লেখা’ বা ‘খোদাই’ করা। এ থেকেই বোঝা যায়, মেকআপ শিল্পী হতে হলে যথেষ্ট দক্ষতার প্রয়োজন হত এবং সমাজে তাদের গুরুত্বও ছিল।

ধনী মিশরীয় নারীদের সবচেয়ে শুদ্ধ রূপচর্চা হতো স্নানকক্ষে। প্রাচীন মিশরের মধ্যযুগের (২০৩০-১৬৫০ খ্রি:পূ:) একজন ধনী নারী যেকোনো ধরণের মেকআপ নেওয়ার আগে ত্বক প্রস্তুত করে নিতেন। তারা সবার আগে মৃত সাগরের লবণ দিয়ে ত্বক এক্সফোলিয়েট করতেন যা এখনও অনুসরণ করা হয়।

বিজ্ঞাপন

এক্সফোলিয়েট অর্থাৎ মরা কোষ ঝরানর পর মসৃণ ত্বক পেতে দুধে স্নান করতেও ভালোবাসতেন তারা। দুধ ও মধুর মিশ্রণে তৈরি ফেস মাস্ক সেসময়ের জনপ্রিয় এক ট্রিটমেন্ট। মিশরীয় নারীরা ত্বক মসৃণ ও নরম করতে এবং সুগন্ধি হিসেবে নানারকম ফুলসমৃদ্ধ বা মশালযুক্ত তেল ব্যবহার করতেন। এমনকি তারা মধু ও চিনির মিশ্রণে প্রাকৃতিক ওয়াক্সিংয়ের একটি পদ্ধতি আবিষ্কার করেছিল। আজ এ পদ্ধতিকেই ‘সুগারিং’ বলা হয়। এ পদ্ধতিতেই আজকালকার বিউটি কোম্পানিগুলো হট ওয়াক্সের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করে যা তুলনামূলক কম যন্ত্রণাদায়ক।

সাগরের লবণ দিয়ে এক্সফোলাইট বা দুধে স্নানের পর মেকআপের পালা। এ জন্য একজন দাস বা দাসী নানা উপাদানে তৈরি প্রসাধনী ও প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম নিয়ে স্নানকক্ষে প্রবেশ করতো। এসব সরঞ্জাম, প্রসাধনী রাখার পাত্র ও মেকআপ শিল্পীদের নিজস্ব শৈল্পিক গুরুত্ব ছিলো যা সমাজে শৈল্পিক শ্রেণী নির্ধারণ করত। ক্যালসাইটের তৈরি পাত্রে রাখা হতো মেকআপ সরঞ্জাম বা নানা ধরণের অনুলেপ এবং সুগন্ধি। চোখের পাপড়ি সাজানোর রঙ এবং তৈল জাতীয় দ্রব্য রাখার পাত্র তৈরি করা হতো স্বর্ণ অথবা অতি মূল্যবান কাঁচ বা পাথর দিয়ে। কাজল তৈরির জন্য বিভিন্ন উপাদান চূর্ণ করতে ব্যবহার করা হতো সিলটস্টোনের প্যালেট। এসব প্যালেট বিভিন্ন পশু বা দেব-দেবীর আদলে তৈরি করা হতো।

প্যালেটের এসব প্রতীক পুনর্জন্ম ও পুনরুৎপাদনের প্রতিনিধিত্ব করত। কোনো প্রাণি বা দেব-দেবীর আদলে তৈরি প্যালেটে বিভিন্ন রঞ্জক উপাদান চূর্ণ করার কাজটিকে মনে করা হতো এতে  ওই প্রাণীর ক্ষমতা প্রসাধনী ব্যবহারকারীর মধ্যে প্রবাহিত হবে।

বিজ্ঞাপন

এদিকে একই সময় চোখের সাজসজ্জার জন্য কোনো দাস পশুর চর্বি বা উদ্ভিজ্জ তেলের সঙ্গে ম্যালাকাইটের গুঁড়ো মিশিয়ে তৈরি করত আইশ্যাডো। এসময় সম্ভ্রান্ত নারীরা তার স্নানকক্ষে মসৃণ ব্রোঞ্জের আয়নার সামনে বসতেন। দাস বা দাসীরা হ্যাথর দেবীর আদলে হাতির লম্বা দাঁতের তৈরি ব্রাশ দিয়ে চোখের মেকআপ করতেন। আজকে যেমন নারীরা আইশ্যাডোর সঙ্গে চোখের চারপাশে কাজল ব্যবহার করেন ঠিক তেমন।

রূপচর্চার পাশাপাশি চোখে কাজল বা আইশ্যাডো লাগানোর একটি ব্যবহারিক উদ্দেশ্যেও ছিলো। প্রাচীন মিশরে সকল শ্রেণীর নারী-পুরুষ কাজল ব্যবহার করত কারণ এটি মরুভূমির উত্তপ্ত সূর্যের তাপ থেকে চোখ রক্ষা করত।

সর্বশেষ মেকআপের অনুষঙ্গটি হলো ঠোঁটে লাল লিপস্টিকের ব্যবহার। এই রঙের লিপস্টিককে আজকের দিনেও ক্লাসিক হিসেবে মানা হয়। লাল লিপস্টিক তৈরিতে গিরিমাটির পেস্টের সঙ্গে মেশানো হতো পশুর চর্বি বা ভেজিটেবল অয়েল। যদিও রানী ক্লিওপেট্রা তার ওষ্ঠরঞ্জনীর নিখুঁত গাঢ় লাল রঙ পেতে ব্যবহার করতেন বিটল নামক এক ধরণের পোকা পিষে তৈরি গুঁড়া। লিপস্টিকে ব্যবহৃত আয়োডিন ও ব্রোমিন ম্যানাইট থেকে নিষ্কাশিত এসব রঙ অত্যন্ত বিষাক্ত। এসব রঙ গুরুত্বর অসুস্থ বা এমনকি মৃত্যুরও কারণ হতে পারে। সম্ভবত এ থেকেই ‘মৃত্যুর চুম্বন’ (কিস অব ডেথ) কথাটির উদ্ভব।

মৃত্যুর পরেও প্রাচীন মিশরীয়দের সাজসজ্জার বিষয়টি ছিলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মিশরের সমাধিক্ষেত্রগুলো আধুনিক সভ্যতার শুরু থেকেই উন্মুক্ত হয়ে যায় ফলে জানা যায় প্রাচীন মিশরি নারী-পুরুষদের সমাধিতে দৈনিক ব্যবহার্য জিনিস যেমন চিরনি, সুগন্ধি, অলঙ্কার ও প্রসাধনী রাখা হতো। মমিকরণ প্রক্রিয়ায় মিশরীয়দের দৈনন্দিন আচার অনুষ্ঠান বিস্তারিত অনুসরণ করা হতো। জীবিত থাকতে ত্বক নরম ও মসৃণ করার জন্য যেমন নানা চেষ্টা থাকত তেমনি মমিকরণেও এটির ধর্মীয় গুরুত্ব ছিলো। মমিকরণের সময় ত্বক নরম ও মসৃণ করতে প্রসাধনী ব্যবহার করা হতো।

বিজ্ঞাপন

প্রাচীন মিশরীয়দের দৈনন্দিন রূপচর্চার এসব বিস্তারিত কার্যক্রমের সঙ্গে আজকের দিনের মেকআপ শিল্পের যথেষ্ট মিল রয়েছে। হাল আমলের ফ্যাশন যে কতটা মিশর প্রভাবিত তা স্পষ্টতই ফুটে ওঠে। শুধু মেকআপ শিল্পই যে মিশরীয় প্রভাবে প্রভাবিত তা নয় বস্তুত স্থাপত্যশিল্প, চিত্রশিল্প থেকে মেকআপ শিল্প পর্যন্ত নান্দনিকতা, কমনীয়তা ও শৈলীর প্রশ্নে এখনকার আধুনিক রীতিকে ধারণ করত প্রাচীন মিশর। সৌন্দর্যের আদর্শগুলো এখনও প্রাচীন মিশর দ্বারা প্রভাবিত। এখনও রূপ চর্চায় প্রাচীন মিশরীয় কায়দায় আইলাইনার ও লিপস্টিকের ব্যবহার জনপ্রিয়।

এ প্রবন্ধটি আর্টসিডটনেট- এ  প্রথম প্রকাশ হয়। জুলিয়া ফিওরের লেখা প্রবন্ধটি পরে সিএনএনসহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমেও প্রকাশ হয়।

ভাষান্তর: আতিকুল ইসলাম ইমন।

সারাবাংলা/আইই

Tags: , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন