বিজ্ঞাপন

জীবনের গল্প ফুরায় কি!

July 6, 2020 | 11:31 pm

আহমেদ জামান শিমুল

জন্ম, বেড়ে ওঠা, খ্যাতি, সম্মান— সবই এ দেশের মাটিতে। দেশকে বড্ড বেশি ভালোবাসতেন ‘প্লেব্যাক সম্রাট’ এন্ড্রু কিশোর। তাই তো সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসক লিম সুন থাই যখন জানালেন, আয়ু মাত্র একমাস, খুব বেশি হলে এক বছর— তখনই স্ত্রীকে বলেছেন তার দেশে ফেরানোর ব্যবস্থা করতে। ভয়ংকর খবর শুনেও অবিচল চিত্তে বলেছেন, ‘আমি আমার দেশে মরতে চাই, এখানে না।’

বিজ্ঞাপন

সৃষ্টিকর্তা কিংবদন্তি এ শিল্পীর শেষ ইচ্ছা পূরণ করেছেন। তার মৃত্যু হয়েছে দেশেই, জন্মস্থান রাজশাহীতে। মৃত্যুর কয়েক ঘণ্টা আগেও কথা বলেছেন প্রিয় বন্ধু জনপ্রিয় উপস্থাপক হানিফ সংকেতের সঙ্গে। কথা বলেছেন সুরকার আলম খানের সঙ্গেও, যার হাত দিয়ে আজকের এন্ড্রু কিশোরকে পেয়েছে দেশ। তাদের বলেছেন, মৃত্যুতে যেন কষ্ট কম হয়— এ দোয়া করবেন।

আরও পড়ুন- চলে গেলেন সুরের দরিয়া

গত বছরের ৯ সেপ্টেম্বর সিঙ্গাপুর গিয়েছিলেন শারীরিক অসুস্থতার চিকিৎসা করাতে। সমস্যা ছিল কিডনি ও হরমোনের। কিন্তু সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালের ডাক্তাররা পরীক্ষা করে তাকে জানালেন, তার শরীরে বাসা বেঁধেছে মরণব্যাধি ক্যানসার (ডিফিউজ লার্জ বি সেল লিম্ফোমা)।

তবুও মানুষ স্বপ্ন দেখে বাঁচার। ক্যানসার জয় করে এ দেশেরই আরেক কিংবদন্তি সাবিনা ইয়াসমিন গান করে যাচ্ছেন। আরও অনেক শিল্পী ক্যানসারকে হারিয়েছেন। তার চিকিৎসকরাও তাকে আশা দিলেন। বললেন, ১৮টি কেমোথেরাপি নিলে সুস্থ হয়ে যাবেন। স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে শুরু হলো সিঙ্গাপুরে বাঁচার লড়াই।

বিজ্ঞাপন

এরই মাঝে এ বছরের ৯ ফেব্রুয়ারি সিঙ্গাপুর বিজনেস সোসাইটি এবং বাংলাদেশ চেম্বারের আয়োজনে সিঙ্গাপুরের স্থানীয় গেটওয়ে থিয়েটার হলে আয়োজন করা হয় ‘এন্ড্রু কিশোরের জন্য ভালোবাসা’। হুইল চেয়ারে বসে গায়ে লাল পাঞ্জাবি ও মাথায় হ্যাট পরে এসে গাইলেন, ‘জীবনের গল্প, আছে বাকি অল্প’।  সে অনুষ্ঠানে আরেক অসুস্থ সুরকার ও সংগীত পরিচালক সেলিম আশরাফের চিকিৎসা সহায়তায় ৫ হাজার সিঙ্গাপুরি ডলারের একটি খাম সাবিনা ইয়াসমীন ও সৈয়দ আব্দুল হাদীর হাতে তুলে দেন। ভাবা যায়, কতটা মহানুভব ছিলেন!

সিঙ্গাপুরে যাত্রার আগে থেকেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার শারীরিক অবস্থার খোঁজখবর রাখছিলেন। দিয়েছেন চিকিৎসা সহায়তা, যে হাসপাতালে ছিলেন সেখানকার ব্যয় নির্বাহেরও ব্যবস্থা করেছিলেন।

বিজ্ঞাপন

দেখতে দেখতে কেমোথেরাপি, রেডিওথেরাপি শেষ হয় গত এপ্রিল মাসে। ১৩ মে তার দেশে ফেরার টিকেট কাটা ছিল। তার শরীর অসুস্থ থাকায় টিকেট বাতিল করা হয়। ডাক্তার ভেবেছিলেন কেমোর কারণে শরীর দুর্বল।

আবার টিকেট কাটা হয় ১০ জুন। কিন্তু ২ জুন হালকা জ্বর, ৩ জুন রাতে কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসে এন্ড্রু কিশোরের। ৪ জুন হাসাপাতালে ভর্তি করা হয়। তার শরীরে কোনো ওষুধ কাজ করছিল না। ৯ জুন পিইটি স্ক্যান করা হয়। তার স্ত্রী ইতি কিশোর সারারাত ঈশ্বরকে ডাকলেন। কারণ ডাক্তার বলেছিলেন, লিম্ফোমা যদি একবারে নির্মূল না হয়, যদি ব্যাক করে, তাহলে সেটা দ্বিগুণ শক্তি নিয়ে আসে। আর খুব দ্রুত ছড়ায়। এবং সেটা কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয় না।

১০ জুন সকাল ১০টায় ডাক্তার লিমের চেম্বারে ইতি কিশোর। শুনলেন নির্মম সত্য, তার শরীরে আশঙ্কা অনুযায়ী লিম্ফোমা আবার ধরা পড়েছে। আয়ু মাত্র এক মাস, খুব বেশি হলে এক বছর। ‘কিছু কি করার নেই?’— ইতি কিশোরের ব্যাকুল প্রশ্নে চিকিৎসক বললেন মাত্র তিনটি শব্দ— ‘আই অ্যাম সরি’। ঈশ্বর ইতির ডাক শুনলেন না!

বিজ্ঞাপন

সব শুনে এন্ড্রু কিশোর চিকিৎসককে ডাকলেন। বললেন, ‘তুমি আজই আমাকে রিলিজ করো। আমি আমার দেশে মরতে চাই, এখানে না। আমি কালই দেশে ফিরব।’ স্ত্রীকে বললেন, ‘আমি তো মেনে নিয়েছি, সব ঈশ্বরের ইচ্ছা। আমি তো কাঁদছি না, তুমি কাঁদছ কেন?’

প্রচণ্ড মানসিক শক্তির অধিকারী কিশোর বাংলাদেশ হাইকমিশনে ফোন করে ১১ জুন বিশেষ বিমানে দেশে ফেরার ব্যবস্থা করান। হাইকমিশনের কর্মকর্তাদের বলেছিলেন, ‘কালই আমার ফেরার ফ্লাইট ঠিক করে দেন। আমি মরে গেলে আপনাদের বেশি ঝামেলা হবে, জীবিত অবস্থায় পাঠানো সহজ হবে।’

দেশে এসে চলে যান রাজশাহীতে। সেখানকার মহিষবাথান এলাকায় বোন ডা. শিখা বিশ্বাসের বাসায় থেকে চিকিৎসা নিচ্ছিলেন এই শিল্পী। শিল্পীর দুলাভাই ক্যানসার বিশেষজ্ঞ ডা. প্যাট্রিক বিপুল বিশ্বাসের তত্ত্বাবধানে ছিলেন তিনি। সেখানেই সোমবার (৬ জুলাই) না ফেরার দেশেই চলে যান। ক্যানসারের তীব্রতা তাকে বেশি দিন সহ্য করতে হয়নি।

রাজশাহীর মাটিতে ১৯৫৫ সালের ৪ নভেম্বর এন্ড্রু কিশোরের জন্ম। সেখানেই বেড়ে ওঠা। পড়েছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। তার মা মিনু বাড়ৈ উপমহাদেশের প্রখ্যাত শিল্পী কিশোর কুমারের ভক্ত ছিলেন। তাই ছেলের নাম রাখলেন কিশোর। কে জানতো তার ছেলেও একদিন বিখ্যাত শিল্পী হবে। পাবে কিংবদন্তির মর্যাদা।

বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে এন্ড্রু কিশোর নিজেই এক ইতিহাস। গেয়েছেন ১৫ হাজার গান। এমন একটা সময় গেছে, চলচ্চিত্রের গান মানেই যেন এন্ড্রু কিশোর। তার গাওয়া গান নিয়ে অসংখ্য অ্যালবামও হয়েছে।

এন্ড্রু কিশোর প্রাথমিকভাবে সংগীত পাঠ শুরু করেন রাজশাহীর আবদুল আজিজ বাচ্চুর কাছে। একসময় গানের নেশায় রাজধানীতে ছুটে আসেন। মুক্তিযুদ্ধের পর তিনি রবীন্দ্র সংগীত, নজরুল সংগীত, আধুনিক গান, লোকগান ও দেশাত্মবোধক গানে রেডিওর তালিকাভুক্ত শিল্পী হন।

চলচ্চিত্রের প্লেব্যাক তার যাত্রা শুরু হয় ১৯৭৭ সালে আলম খানের সুরে ‘মেইল ট্রেন’ দিয়ে। সেখানে তিনি ‘অচিনপুরের রাজকুমারী নেই যে তার কেউ’ গানে কণ্ঠ দেন। তার রেকর্ড করা দ্বিতীয় গান বাদল রহমান পরিচালিত ‘এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী’ চলচ্চিত্রের ‘ধুম ধাড়াক্কা’। তবে ১৯৭৯ সালে মুক্তি পাওয়া এ জে মিন্টু পরিচালিত ‘প্রতিজ্ঞা’ চলচ্চিত্রের ‘এক চোর যায় চলে’ গাওয়া গান প্রথম জনপ্রিয়তা লাভ করে। ওই শুরু। এরপর টানা দুই দশক বাংলা চলচ্চিত্রের গান মানেই এন্ড্রু কিশোর।

তার বিখ্যাত গানের মধ্যে রয়েছে— ‘জীবনের গল্প আছে বাকি অল্প’, ‘হায় রে মানুষ রঙিন ফানুস’, ‘ডাক দিয়াছেন দয়াল আমারে’, ‘আমার সারাদেহ খেয়ো গো মাটি’, ‘আমার বুকের মধ্যে খানে’, ‘আমার বাবার মুখে প্রথম যেদিন শুনেছিলাম গান’, ‘ভেঙেছে পিঞ্জর মেলেছে ডানা’, ‘সবাই তো ভালোবাসা চায়’, ‘বেদের মেয়ে জোসনা’, ‘পড়ে না চোখের পলক’, ‘কী জাদু করিলা’, ‘চাঁদের সাথে আমি দেবো না’, ‘কারে দেখাব মনের দুঃখ’, ‘ওগো বিদেশিনী’, ‘আমি চিরকাল প্রেমের কাঙাল’ এবং আরও অনেক গান।

‘বড় ভালো লোক ছিল [১৯৮২]’, ‘সারেন্ডার [১৯৮৭]’, ‘ক্ষতিপূরণ [১৯৮৯]’, ‘পদ্মা মেঘনা যুমনা [১৯৯১]’, ‘কবুল [১৯৯৬]’, ‘আজ গায়ে হলুদ [২০০০]’, ‘সাজঘর [২০০৭’ ও ‘কি যাদু করিলা [২০০৮]’ ছবিগুলোতে গান গেয়ে মোট আটবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান ‘প্লেব্যাক সম্রাট’। এছাড়া পাঁচবার বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি (বাচসাস) পুরস্কার পান। পেয়েছেন আরও অসংখ্য পুরস্কার।

সংগীতের পাশাপাশি ১৯৮৭ সালে বাবর আহমাদ ইউসুফ, আনোয়ার হোসেন বুলু, ডলি জহুর, দিদারুল আলম বাদল, শামসুল ইসলাম নান্টুকে নিয়ে গড়ে তুলেন মিডিয়া হাউজ ‘প্রবাহ’।

ব্যক্তি জীবনে এন্ড্রু কিশোর ছিলেন এক ছেলে ও এক মেয়ের জনক। তারা দু’জনেই অস্ট্রেলিয়ায় থাকেন। মেয়ে মিনিম এন্ড্রু সংজ্ঞা সিডনিতে গ্রাফিক ডিজাইন ও ছেলে জে এন্ড্রু সপ্তক মেলবোর্নে ফ্যাশন ডিজাইনিংয়ে পড়াশোনা করছেন।

এত বর্ণাঢ্য  জীবনের অধিকারী এ শিল্পী মাত্র ৬৫ বছর বয়সে চলে গেছেন দয়ালের ডাকে, যে ডাকে ফেরার সাধ্য কারোই নেই। কিন্তু তার জীবনের গল্প কি ফুরাবে কখনো? প্রজন্মের পর প্রজন্ম গাইবে, ‘হায় রে মানুষ, রঙিন ফানুস রঙ ফুরাইলে ঠুস!’

ওপারে ভালো থাকবেন এন্ড্রু কিশোর।

সারাবাংলা/এজেডএস/

Tags: , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন