বিজ্ঞাপন

শহীদ আজাদের জন্মদিনে এক বিন্দু আনন্দ অশ্রু

July 11, 2020 | 11:03 am

রাহাত মিনহাজ

সময়টা ১৯৪৬। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ মাত্র শেষ হয়েছে। ভারতবর্ষে ব্রিটিশ রাজমাতার বর্বর শাসনের গনগনে সূর্য তখন প্রায় অস্তমিত। দিল্লী থেকে লাহোর, কলকাতা থেকে ঢাকা ‘আজাদী, আজাদী’ ধ্বনিতে প্রকম্পিত চারপাশ। এমনই এক সময়ে ভারতের উত্তর প্রদেশের কানপুরে ১১ ই জুলাই জন্ম হয় এক ক্ষণজন্মার। নাম মাগফার উদ্দীন আহমেদ চৌধুরি আজাদ। আজাদীর প্রাক্কালে জন্ম বলেই বনেদী বাবা সন্তানের নাম রাখেন আজাদ। আজাদের বাবা চাকুরি সূত্রে তখন উত্তর ভারতের কানপুরে। সেই সন্তানই জন্মের মাত্র ২৪ বছর পর, দেশ মাতৃকার আরেক আজাদীর (স্বাধীনতা) জন্য নিদারূণ কষ্ট সহ্য করে প্রাণ বিসর্জন দেন। যার রক্ত কণিকায় গাঢ় সবুজ জমিনে জন্ম হয় এক লাল সূর্যের। লাখো শহীদের সাথে আজাদের রক্ত ফোটায় আজাদী পায় বাংলাদেশ। আজ সেই অমর শহীদের জন্মদিন। চলুন জানার চেষ্টা করি জন্মভূমির জন্য আজাদের প্রাণ বিসর্জনের অনন্য এক উপাখ্যান।

বিজ্ঞাপন

আজাদের বাবার নাম ইউনূস চৌধুরি। মা মোছাম্মাত সাফিয়া খাতুন। বাবা ছিলেন ইঞ্জিনিয়ার। কর্মরত ছিলেন টাটা কোম্পানিতে। চাকরিজীবনে কলকাতা-দিল্লী-কানপুর-মুম্বাই ঘুরে শেষ পর্যন্ত থিতু হন ঢাকায়। বিক্রমপুরের ছেলে ইউনূস চৌধুরি প্রচুর সম্পদের মালিক বনে যান। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর অতি দ্রুত ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। এদিকে তার একমাত্র জীবিত সন্তান আজাদও বেড়ে উঠতে থাকে স্বচ্ছলতার মধ্যে। আজাদদের শানশওকতও ছিল চোখে পড়ার মতো। ইস্কাটনে প্রাসাদসম বাড়ি, সেই বাড়িতে ছিল হরিণ, মসলার বাগান। ‘ডাকে পাখি খোল আখিঁ, দেখো সোনালী আকাশ, বহে ভোরেরও বাতাস’ ঢাকাই চলচ্চিত্রের এই জনপ্রিয় গানের শুটিং তাদের বাড়িতেই হয়েছিল। তাদের পারিবারিক আভিজাত্য ছিল ঈর্ষা করার মত।

১৯৬১ সালে বাবা দ্বিতীয় স্ত্রী গ্রহণ করলে আজাদের এই সুখী জীবনের ছন্দে ছেদ পড়ে। প্রচন্ড অভিমানী আর জেদী আজাদের মা এক কাপড়ে বেরিয়ে আসেন সংসার থেকে। আজাদের বয়স তখন মাত্র ১৫ বছর। এরপর নানা কষ্টে সন্তানকে মানুষ করার চেষ্টা করেন। স্কুল-কলেজের শিক্ষা শেষে আজাদ ভর্তি হন করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু ক্রমাগত বৈষম্য আর বাঙালি বিদ্বেষের দূষণীয় পরিবেশে আজাদ নিজেকে মানিয়ে নিতে পারেননি। বিষিয়ে ওঠে মন। করাচীর দম বন্ধ করা সেই পরিবেশ থেকে ঢাকায় ফিরে আজাদ ভর্তি হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে। সময় তখন ১৯৬৯। বাংলার ইতিহাসের উথাল-পাথাল সময়। বাঙালির অধিকার আদায়ের আন্দোলন আর আইয়ুব খানের অপশাসনের বিরুদ্ধে উত্তাল ঢাকার রাজপথ, অলি-গলি। আগড়তলা ষড়যন্ত্র মামলায় বিচার চলছে শেখ মুজিবুর রহমানের। অস্থায়ী কারাগারে হত্যাকান্ডের শিকার হন সার্জেন্ট জহুরুল হক, রাজশাহীতে অধ্যাপক শামসুজ্জোহা। এদিকে সারাদেশের গণআন্দোলনে প্রতিদিনই ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ-চট্টগ্রামে কেউ না কেউ প্রাণ দিচ্ছেন। আন্দোলনের মহা এই গণজোয়ারে একাত্ম আজাদও। সাথে তার বন্ধুরা। রুমি-বদি-জুয়েল। তবে আজাদের বেশি ঘনিষ্ঠতা ছিল ক্রিকেটার জুয়েল আর বাস্কেটবল খেলোয়াড় কাজী কামাল ও সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের সাথে।

উত্তাল ৬৯-৭০ পার হয়ে দ্রুতই চলে আসে ১৯৭১। বাঙালি জাতিকে ন্যায়সঙ্গত অধিকার থেকে বঞ্চিত করে ঢাকার বুকে ঝাপিয়ে পড়ে পাক হায়েনারা। শুরু করে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ, ঘৃণ্য নারী নির্যাতন। পাক সেনাদের গুলিতে নিহত হন আজাদদের কাছের মানুষ ক্রীড়ানুরাগী মুশতাক। আজাদরা যাকে মুশতাক ভাই নামেই ডাকতেন। তবে সব অত্যাচার সহ্য করে চুপ থাকেননি আজাদের বন্ধুরা। রুমি-বদি-আজাদ-জুয়েল-সামাদ-ফতেহ’রা যুদ্ধে যোগ দিতে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে চলে যান ভারতের ত্রিপুরার মেলাঘরে। এই দলে ছিলেন শাহাদাৎ চৌধুরি, মায়া, গাজী, চুল্লু, হাবিবুল আলাম, আজম খানসহ আরও অনেকেই।

বিজ্ঞাপন

গেরিলা প্রশিক্ষণ নিয়ে ঢাকায় ফেরা এই যোদ্ধাদের ঢাকা শহরে কয়েকটি আস্তানা ছিল। যেগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল আজাদদের বড় মগবাজারের বাড়িটা। এটা ছিল এক ধরনের মিনি ক্যান্টনমেন্ট, মুক্তিযোদ্ধাদের মেস বাড়ি। এই বাড়ি থেকেই যোদ্ধা বন্ধুদের সাথে ঢাকার বুকে পরিচালিত বেশ কিছু দুঃসাহসিক অভিযান পরিচালনা করেন আজাদ। তেমন কোন প্রশিক্ষণ কিন্তু ছিল না। মায়ের অনুমতি নিয়ে বন্ধুদের সাথে যুদ্ধে চলে যাওয়া টববগে এক যুবক সফল হন কয়েকটি অভিযানে।

পাক সেনা নিধনে গেরিলারা সফল হলেও কিছুদিন পরেই নেমে আসে বিপদ। ফাঁস হয়ে যায় গোপনীয় তথ্য। পাক সেনাদের অভিযানে ২৯-৩০ আগস্ট একে একে ধরা পড়তে থাকেন যোদ্ধারা। যে তালিকায় ছিলেন রুমি-বদি, আলতাফ মাহমুদসহ আরও অনেকেই। ধরা পড়েন আজাদ। আজাদদের ৩৯, বড় মগবাজার বাড়িটি ঘিরে ফেলেছিল পাক সেনারা। সেদিন রাতে ওই বাড়িতে ছিলেন জুয়েল, কাজী কামাল, আজাদসহ আরও অনেকেই। বাড়ির ভেতরে ধস্তাধস্তির এক পর্যায়ে কাজী কামাল পালিয়ে গেলেও আজাদ-জুয়েল ধরা পড়ে যান। প্রচন্ড- মারধরের পর তাদের নেওয়া হয় ক্যাম্পে।

এই ক্যাম্পেই বর্বর নির্যাতন চালানো হয় ঢাকার গেরিলাদের উপর। রুমি-বদি-আজাদ-আলতাফ মাহমুদসহ আরও কত নাম। সীমাহীন নির্যাতন চালিয়ে এই বীর যোদ্ধাদের কাউকে কাউকে রাখা হতো রমনা থানায়। এই থানাতেই একদিন রাতে আজাদের মা দেখা পান তার নাঁড়িছেড়া ধন, আজাদের। আজাদ তখন বিদ্ধস্ত। ক্ষত-বিক্ষত গোটা শরীর। আজাদের সুযোগ ছিল জীবন বাঁচানোর। বন্ধু যোদ্ধাদের নাম বলে দিলে হয়তো প্রাণ রক্ষা হতো। আজাদের মাকে সে রকম প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু আজাদের মা ছেলেকে বলেছিলেন উল্টো কথা। বলেছিলেন ‘শক্ত করে থেকো বাবা, কারও নাম বলো না’। সেই রাতে ভয়াবহ ক্ষুধার্ত আজাদ মায়ের কাছে ভাত খেতে চেয়েছিল। পর দিন আসার সময় মাকে ভাত আনতে বলেছিলেন। কিন্তু হায়! সেই ভাত আর আজাদের খাওয়া হয়নি। পরদিন মা যত্ন করে খাবার নিয়ে গেলেও আজাদ তখন রমনা থানায় ছিলেন না। পরে আর কখনও তাকে থানায় আনাও হয়নি। একেবারেই হাওয়া হয়ে যান আজাদরা।

বিজ্ঞাপন

আজাদের মতোই কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি রুমি-বদি-জুয়েল বা আলতাফ মাহমুদের। খুব সম্ভবত ৪ সেপ্টম্বর ১৯৭১ রাতে তাদের হত্যা করা হয়েছিল। এ বিষয়ে শহীদ জননী জাহানারা ইমাম তাঁর ‘একাত্তরের দিনগুলি’তে লিখেছেন, ‘একটা রক্ত হিম করা গুজব কানে এল। চার সেপ্টম্বর রাতে নাকি অনেক মুক্তিযোদ্ধাকে গুলি করে মেরে ফেলা হয়েছে। পাঁচ সেপ্টেম্বর প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া যে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন, তা নিয়ে সেনাবাহিনীর ভেতরে নাকি মতভেদ ছিল। এক দলের মত ছিল এসব দেশদ্রোহী দুষ্কৃতকারী কোনভাবেই সাধারণ ক্ষমা পাওয়ার যোগ্য নয়। এদের ক্ষমা করে দিলে দেশের সমূহ ক্ষতি। তাই প্রেসিডেন্টের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা হবার আগের রাতেই তাড়াহুড়ো করে প্রায় শ’খানেক দেশদ্রোহীকে প্রাণদন্ড দিয়ে গুলি করে মেরে ফেলা হয়েছে।’ (ইমাম; ২০১৫:২০৯)

হয়তো ঐ রাতেই আজাদ শহীদ হন। সেদিন যে ভাত নিয়ে গিয়েছিলেন ছেলের জন্য, ছেলের দেখা না পেয়ে আর ভাত মূখে তোলেননি আজাদের স্নেহময়ী জননী। সেদিনের পর থেকে মারা যাওয়ার আগ পর্যন্ত ভাত খাওয়া বাদ দেওয়ার পাশাপাশি মেঝেতেই ঘুমিয়েছেন সাফিয়া বেগম। সেদিন হয়ত আজাদের সঙ্গেই ঘাতকের হাতে শহীদ হন আজাদের বন্ধু আর সহযোদ্ধারা। আজাদের মত প্রতিটি মুক্তিযোদ্ধা বা শহীদদেরই প্রাণ বিসর্জনের গল্পই সমান বেদনাদায়ক। যারা নিজের জীবন দিয়ে মিটিয়েছেন স্বাধীনতার চড়া মূল্য। শহীদ আজাদের জন্মদিনে একজন আজাদকে স্মরণ করার সাথে সাথে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি প্রতিটি বীর মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ-বীরঙ্গনাদের। যাদের আত্মত্যাগেই লাল-সবুজের প্রতীক আজ অমাদের সদা জাগ্রত অহংকার।
শুভ জন্মদিন শহীদ আজাদ! শ্রদ্ধা চিরকাল।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

বিজ্ঞাপন

সারাবাংলা/আরএফ

Tags: , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন