বিজ্ঞাপন

‘রাশীদ উন নবী বাবু’ অখণ্ড অভিভাবকের খণ্ডিত স্মৃতি

July 11, 2020 | 8:08 pm

হোসেন শহীদ মজনু

– সেন্টু তুমি পার্টির লোককে নিয়ে আসছো, ও পারবে সাংবাদিকতা করতে?
আমার দেশ পত্রিকার মফস্বল সম্পাদক বজলুর রশীদ সেন্টু কিছুটা হকচকিয়ে গেলেন নির্বাহী সম্পাদক রাশীদ উন নবী বাবুর প্রশ্নে। বিব্রতমুখে বললেন, পারবে বাবু ভাই। এবার তিনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, কি পারবা?
বললাম, জ্বী ভাই পারবো।
– তুমি তো নির্মলদার (কমরেড নির্মল সেন) পার্টি করো। দাদা সাংবাদিক বলে তুমিও পারবে বলছো? দেখো পার্টি করা আর সাংবাদিকতা করা কিন্তু এক না। বাবু ভাইয়ের এ কথার প্রতি উত্তরে বিনীতভাবে বললাম, আমি সংবাদে বিনোদন সেকশনে বছর খানেক হলো কাজ করছি।
– আচ্ছা। তবে বিনোদন সাংবাদিকতা আর ডেস্কের সাব এডিটরের কাজ কিন্তু এক না।
আমার উত্তর, জ্বী ভাই।
– সেন্টু ওর বেতন কত ধরব?
– আপনি একটা ধরে দেন। প্রতি উত্তরে বললেন, মেজো ভাই (বজলুর রশীদ সেন্টু, ঘনিষ্ঠ বন্ধু কাজল রশীদ শাহীনের মেজো ভাই। সে সূত্রে তাকে মেজোভাই ডাকি)

বিজ্ঞাপন

রাশীদ উন নবী বাবু ভাইয়ের বর্ণাঢ্য সাংবাদিকতা জীবনের একপ্রান্তে অনুপ্রবেশ ঘটল আমার। ২০০৫ সালের ফেব্রুয়ারির শুরুতে ৭ হাজার ২০০ টাকা বেতনে সম্ভবত পঞ্চম গ্রেডের কাঠামোতে আমার দেশ পত্রিকায় সহ সম্পাদক হিসেবে চাকরি হলো। যোগদান করতে হবে ১ মার্চ। নিয়োগপত্র পেয়ে বাবু ভাইকে বললাম, কাল থেকেই আমি অফিস করতে চাই। নিজের প্রস্তুতির ঘাটতি থাকলে তা কাটিয়ে নেবো।

বাবু ভাই সানন্দে রাজি হয়ে ওইদিনই যুগ্ম বার্তা সম্পাদক হুমায়ুন সাদেক চৌধুরীর (হুমায়ুন ভাই) সাথে আলাপ করিয়ে দিলেন। এ সময়কালের আরও অন্তত ১০ বছর আগে থেকে বাবু ভাইকে চিনি! মানে উনি যখন আজকের কাগজ কিংবা যুগান্তরে; তখন থেকেই। তোপখানা রোডের শ্রমিক-কৃষক সমাজবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক খ্যাতিমান সাংবাদিক কমরেড নির্মল সেনের লেখা কলাম অনেক দিন আমি বাবু ভাইয়ের অফিসে পৌঁছে দিয়েছি। আমার সঙ্গে দেখা হলেই জিজ্ঞেস করতেন দাদা কেমন আছে? তাই উনার সাথে দেখা হওয়ার পরিস্থিতিতে আমার একটা প্রস্তুতি থাকত নির্মল দা’র শারীরিক অবস্থার সর্বশেষ আপডেট জানার!

পুরো ফেব্রুয়ারির প্রতিদিন বিকাল ৩টায় চলে যাই অফিসে, আপাতত বসার জায়গা হুমায়ুন ভাইয়ের টেবিলের সামনের একটি চেয়ারে। আরেকটি চেয়ারে বসতেন সিনিয়র সাব এডিটর কামরুল ভাই (কামরুল হাসান লিটন)। হুমায়ুন ভাইয়ের বাঁ পাশে বাবু ভাইয়ের টেবিলটি বেশ বড়; ওই টেবিলের সামনে অন্তত ৪টি চেয়ার সবসময় থাকত। বিজ্ঞাপন-সার্কুলেশন ম্যানেজার, অ্যাকাউন্টস কিংবা অন্য সেকশনের হর্তাকর্তারা এসে সেখানে বসে প্রয়োজনীয় আলাপ, ফাইলপত্রে স্বাক্ষর নিয়ে যেতেন। এদিকে কাজের ফাঁকে ফাঁকে মজার মজার গল্প বলেন হুমায়ুন ভাই, দু’চারটা সংবাদ বিজ্ঞপ্তির ফ্যাক্স আমাকে ধরিয়ে দেন, কেটেছেঁটে ঠিক করার জন্য। আমি সেটা করে দেই, উনি শিরোনাম ঠিক করে দেন। ভেতরের কনটেন্টও কেটে সঠিক শব্দ লিখে দেন! আমি মুগ্ধ হয়ে দেখি, চেষ্টা করি শেখার! সেন্ট্রাল ডেস্কের কাজকর্ম সম্পর্কে মোটামুটি বুঝে উঠছি; এমন একদিন রাত সাড়ে ৮টার দিকে কানে এলো ‘মজনু এদিকে আসো’। মনে হয় ভুল শুনেছি এমন যখন ভাবছি; তখন আবার ডাক শুনে চমকে ডানে তাকিয়ে দেখি বাবুভাই আমার দিকে তাকিয়ে। ইতস্তত করে এগিয়ে গেলাম তার টেবিলে, কারণ হুমায়ুন ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবার পর থেকে এ পর্যন্ত তেমন কথা হয়নি!

বিজ্ঞাপন

বললেন, খুলনার তৈয়ব (আবু তৈয়ব) লাইনে আছে একটা নিউজ দেবে লিখে নাও। নিউজ প্যাডে লিখছি অনেকটা নোট নেওয়ার মতো করে; এটা দেখে বললেন, ওভাবে লিখছো কেন? সরাসরি নিউজটা লিখে ফেলো তা না হলে সময়মতো ধরানো যাবে না। তোমার নোট থেকে নিউজ বানানোর পর কম্পোজে দিতে গেলে ওটা আর ফার্স্ট এডিশনে ছাপা হবে না! হাত কিছুটা কাঁপছিল, এই প্রথম ফোনে শুনে সংবাদ লেখা। তবে লিখতে লিখতে ধাতস্থ হলাম। প্রায় ১০ মিনিট ল্যান্ডফোনের হাতল ধরে আছি কানের কাছে, ডান হাতে লিখেই চলেছি। এর ফাঁকে ভাই একবার তাগাদা দিলেন, ‘শেষ করো।’ আমি বললাম, জি ভাই।

এরপর নিউজ প্যাডের পাতাগুলোতে নাম্বারিং করে কোনায় আলপিন লাগিয়ে তার হাতে দিলাম। তখন স্ট্যাপলার যন্ত্রটা মনে হয় আমাদের হাতের কাছে আসেনি! ভাই পুরো লেখাটা পড়লেন, বেশ কয়েকটি শব্দ কেটে দিলেন, নতুন করে কয়েকটি লাইন লিখলেন, এরপর একটা শিরোনাম দিয়ে দিলেন। আমি মন্ত্রতাড়িত হয়ে পুরো প্রক্রিয়াটি দেখলাম, মনের মধ্যে গেঁথে গেল নির্মেদ বাক্য গঠনের সরল অঙ্ক! পাঠিয়ে দিলেন কম্পিউটারে। পরদিন খবরটি পত্রিকার শেষ পৃষ্ঠায় ছাপা হল! তখন বুঝিনি, এখন বুঝি, বাবু ভাই ওইদিন খুলনার খবরটি লিখে নিতে আমাকে ডেকেছিলেন কেন? তিনি বুঝতে চেয়েছিলেন কাজটা কতটুকু শিখেছি! পরীক্ষাটা যে খারাপ হয়েছিল না; সেটা বেশ পরে প্রমাণিতও হয়েছে।

সে সময় প্রায় প্রতিদিনই অফিস শেষে মেজো ভাইয়ের বাসায় চলে আসি। উনি ফ্যাক্সে আসা মফস্বলের কিছু খবর সাথে করে আনেন। সেগুলো আমাকে দেন, আমি সম্পাদনা করে পরদিন তাকে দেখাই, উনি দেখে ভুলভ্রান্তি ধরিয়ে দেন। এভাবে একজন বিনোদন সাংবাদিকের ডেস্কের কর্মী হয়ে ওঠা। মাঝেমধ্যে হুমায়ুন ভাই ইংরেজি দু’একটা কপিও অনুবাদের জন্য দেন, সেগুলো নিয়ে একটু হিমশিম খেতে হয়! মার্চের ১ তারিখ এলো, মেজো ভাই গিয়ে বাবু ভাইয়ের সাথে আলাপ করলেন। উনি আমাকে মফস্বল ডেস্কে বসে কাজ করার জন্য বললেন।

বিজ্ঞাপন

নানাভাবে সহ-সম্পাদক হিসেবে নিজেকে যখন গড়ছি; তখন সাথে পেয়েছি প্রধান প্রতিবেদক সৈয়দ আবদাল আহমদ, সহ-প্রধান প্রতিবেদক মুস্তাফিজ শফি ভাইসহ রিপোর্টিং বিভাগে কাজী হাফিজ, ফখরুল ইসলাম কাঞ্চন, এম আবদুল্লাহ, জাহেদ চৌধুরী, নেছার আহমেদ, বশির আহমেদ, বাছির জামালসহ আরও বেশ কয়েকজন। চিফ সাব এডিটর ছিলেন খান মোহাম্মদ ইকবাল ও সুমন ইসলাম, ডেস্কে ছিলেন নান্নু ভাই, এসআই শরীফ, আসিফ জাকারিয়া, খাতুনে জান্নাত লুনা, মোজাম্মেল হক টিটু, লিজা আক্তার, রিক্তা, ফাতেমা তামান্না, স্পোর্টসে ছিলেন এমএম কায়সার, মাহমুদুল হাকিম অপু (সদ্য প্রয়াত), আপন তারিক, তানজিম। সম্পাদকীয়-ফিচারে ছিলেন কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলন, সঞ্জীব চৌধুরী। বিনোদনে তানভীর তারেক, নবীন হোসেন।

আমি পত্রিকার সার্কুলেশন, বিজ্ঞাপন বুঝি না। কিন্তু মেকাপ শুরুর আগে বাবু ভাইয়ের কাছে হিসাব আসত; কত ইঞ্চি-কলাম বিজ্ঞাপন সংগ্রহ হল! সংশ্লিষ্টরা প্রতিদিন বিকাল-সন্ধ্যা নাগাদ হিসাব নিয়ে আসত। দূরের ডেস্কে বসে আলাপে বুঝতাম, সেসময় প্রতিদিন গড়ে ৪ থেকে ৫ লাখ টাকার বিজ্ঞাপন ছাপা হতো। পুরো পত্রিকার নাড়িনক্ষত্র তিনি বুঝতেন। কিন্তু সংবাদপত্রের চিরায়ত নিয়মেই যেন একদিন অফিসে এসে শুনলাম বাবু ভাই ইত্তেফাকে যোগ দিয়েছেন।

দুই.
২০১১ সালের শুরুর দিকে কিংবা তারও কিছু আগে দৈনিক সকালের খবর নতুন কলেবরে প্রকাশের উদ্যোগ নেওয়া হল। নতুন মালিকানায় পত্রিকাটির সম্পাদকের দায়িত্ব পেলেন বাবু ভাই। নতুন অফিস, নতুন উদ্যম। সিভি জমা দিলাম। একদিন ডাক পড়ল। চোখের সামনে সেদিনের ঘটনাটা জ্বলজ্বল করছে, পত্রিকার মালিক রউফ চৌধুরীর ছেলে রোমো রউফ চৌধুরী ও বাবু ভাই ছিলেন ইন্টারভিউ বোর্ডে।
– এখন কোথায় আছো? জানতে চাইলেন বাবু ভাই।
– কালের কণ্ঠে।
– এতো বড় হাউজ ছাড়বে কেন?
– আপনার সঙ্গে কাজ করতে চাই। আর অভয় দিলে আরেকটা কারণ অবশ্য বলব।
– বলো।
– সংবাদপত্রে তো চাকরি না বদলালে বেতন তেমন বাড়ে না। তাই সিনিয়রিটি চাই, সঙ্গে বেতনটা একটু বাড়িয়ে দেবেন, এটাও একটা কারণ বলতে পারেন।
এবার যেন একটু দ্বিধায় পড়লেন! বললেন, যদি বেতন না বাড়াই কিংবা সিনিয়রিটি দিতে না পারি?
– সেটা আপনার ইচ্ছা। কাজের সুযোগ পেলে চলে আসব।
রোমো রউফকে কিছু বলতে বললেন বাবু ভাই। উনি বললেন, না নবী ভাই (বাবু ভাইকে উনি নবী ডাকতেন) কিছু বলার নেই। শুধু অবাক লাগছে; যে আসে সে-ই দেখি আপনার লোক!

সাক্ষাৎকার এটুকুই। বেতন বাড়িয়েছিলেন, কিন্তু সিনিয়রিটি দিতে পারেননি। তা নিয়ে আফসোস ছিল না, সানন্দে যোগ দেই। ভিন্ন আঙ্গিকে কাগজটি বের হলো, নানান কাগজ থেকে আসা সংবাদকর্মীরা নতুন উদ্যমে কাজ করছেন। বাজারেও সাড়া ফেলেছে। এ সময়কালে কাজের বাইরে ফ্লোরে সামনাসামনি পড়ে গেলে সালাম দিতাম, তিনি প্রথমেই জিজ্ঞেস করতেন, এই দাদা (নির্মল সেন) কেমন আছেন? সর্বশেষ পরিস্থিতি জানাতাম ব্রেন স্ট্রোকে আক্রান্ত প্রখ্যাত সাংবাদিক, বিশিষ্ট বাম রাজনীতিক কলামিস্ট কমরেড নির্মল সেনের। উনি শুনে বলতেন, অনেক দিন দেখা হয় না দাদার সাথে। একবার দেখতে যাব যে, সে সময়ও হয়ে উঠছে না!

বিজ্ঞাপন

বাবু ভাই সম্পাদক হবার আগে-পরে যোগদান করা সাংবাদিকদের মধ্যে ব্রাহ্মণ-নমশুদ্র সম্পর্ক বিরাজ করছিল। তিনি এসব বৈরী পরিস্থিতিকে তেমন পাত্তা না দিয়ে সাংবাদিকতাটাই করছিলেন। এভাবে ভালোই চলছিল, ছয়-সাত মাস যেতে না যেতেই হঠাৎ করে মালিকপক্ষের হস্তক্ষেপ বাড়তে শুরু করল! হুট করেই কালো মাস্টহেড রঙিন করার সিদ্ধান্ত হল! এই এক ইস্যুতে চাকরি ছাড়লেন শিল্প সম্পাদক গুপু ত্রিবেদী! তারপর এক সকালে চিফ রিপোর্টার চাকরি হারালেন বা ছাড়তে বাধ্য হলেন! একদিন দু’দিন বাদেই সকালে একজনের পদবি বদল তো বিকেলে একজনের চাকরি নেই! কিংবা পরদিন নগর সম্পাদক হলেন আরেকজন! কর্তৃপক্ষের সঙ্গে একশ্রেণির সাংবাদিকও আঁতাতে মেতে উঠলেন! কোম্পানির ডিএমডির দাপট কিংবা সহকর্মী সাংবাদিকের কর্মচ্যুতির বিমর্ষ দিন কাটানোর নেপথ্যে সাংবাদিকদের একাংশ মনে করলেন ‘মুই (আমি) কী হনুরে!’ তাদের কারো খায়েশ হলো অনলাইন সম্পাদক থেকে মূল পত্রিকার সম্পাদক হবার! ক্ষণিকের জন্য সে আশাও পূরণ হয়েছিল! এমন ঘনঘোর দিনগুলোতেও নির্লিপ্ত ছিলেন বাবু ভাই। একদিন যাদের নিজের স্বাক্ষরে চাকরি দিয়েছিলেন, তাদের কারো কারো গোপন স্বাক্ষরে (ইন্ধন) তার চাকরি যায় যায় অবস্থা। আমরা বুঝি, তিনিও বোঝেন, কিন্তু পরিস্থিতিটা এমন যে কিছুই করার নেই! বেশ কয়েকজনের পদ-পদবির শনৈ শনৈ উত্থান হলো মাত্র তিন মাসে, বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠানো হলো বাবু ভাইকে। তারপরের ইতিহাস সবার জানা।

তিন.
সকালের খবরের বাধ্যতামূলক ছুটি থেকে আর ফেরা হয়নি অফিসে। বাবু ভাই সমকালে যোগ দিলেন যুগ্ম সম্পাদক হিসেবে। কিন্তু আমাদের কথা ভুললেন না! একদিন ফোনে কথা হল, তিনি বললেন, তোমাদের জন্য সকালের খবর নিরাপদ নয়, সমকালে চলে আসতে পারো। বললাম, ভাই বেতনভাতা কিছু বাড়িয়ে দেন। উনি বললেন, দেখো এখানে চাকরি হারানোর শঙ্কা নেই, বেতন বাড়ানোর সুযোগ কম। ওখানে যা পাও, সেই বেতনে চলে আসো। ভালো থাকবে। ব্যাস রাজি হয়ে গেলাম! একদিন ডেকে পাঠালেন, মোজাম্মেল হক টিটু, আমি, আমাদের সময়ের আবদুল হাকিম চৌধুরীসহ ৫-৬ জন একসঙ্গে গিয়েই নিয়োগপত্র হাতে পেলাম।

এই হলেন আমাদের অভিভাবক! তার প্রযত্নে সমকালই আমার শেষ কর্মস্থল। কিন্তু সম্পর্কটা এমন একটা জায়গায় গিয়েছিল, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন, ঢাকা সাব এডিটরস কাউন্সিলের নির্বাচন কিংবা অন্য কোনো ছুতোয় জাতীয় প্রেস ক্লাব চত্বরে গেলে মনটা খুঁজতো তাকে। আর দেখা হলে অনুভব করতাম, তার অভিভাবকত্বের শীতল ছায়াতেই আছি!

পুনশ্চ: সাংবাদিকতা পেশায় তখনও জড়াইনি, যুগান্তরে প্রথম দফায় সম্ভবত তিনি যুগ্ম বার্তা সম্পাদক, দ্বিতীয় দফায় ছিলেন উপ-সম্পাদক। তিনি যুগ্ম বার্তা সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব নেবার মাস দু’তিনেক পর নির্মল দা’র কলাম নিয়ে গেছি দেওয়ার জন্য। সেদিন ছিল ৩১ আগস্ট, বিকাল ৫টা-৬টার মধ্যে কোনো একটা সময় হবে, নটরডেম কলেজের উল্টো পাশের অফিসে বাঁকানো সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে গেলাম। নিউজ রুমে তিনি ভীষণ ব্যস্ত, পাশে গিয়ে আমি দাঁড়ানোর আগেই একজন এসে বাবু ভাইয়ের হাতে একটি রিপোর্ট দিয়ে বললেন, ‘বঙ্গবীর ওসমানীর জন্মদিনের নিউজে’র শিরোনামে ‘বঙ্গবীর’ লিখব কিনা? আমিও তখন পৌঁছে গেছি। তিনি যেন কয়েক সেকেন্ড ভাবলেন! তারপর বললেন, গতবছর কী ছাপা হয়েছে দেখে সিদ্ধান্ত নাও। তৎক্ষনাৎ বিষয়টিকে তেমন কিছু মনে হয়নি! কিন্তু সাংবাদিকতায় পেশায় আসার পর বুঝেছি কী দূরদর্শী সিদ্ধান্ত ছিল বাবু ভাইয়ের ওই একটি বাক্যে। কারণ প্রতিটি সংবাদপত্রের সম্পাদকীয় নীতি রয়েছে, সেই অনুযায়ী এটি চলে। একটি কাগজের সম্পাদকীয় নীতি বুঝে উঠার জন্য সময় লাগে। একই সঙ্গে পূর্ববর্তী দিনগুলোর সম্পাদকীয় নীতিতে পরিবর্তন না ঘটলে সে অনুযায়ীই চলা সর্বোত্তম। শিরোনামটিও সম্পাদকীয় নীতি অনুযায়ী হয়!

ক্যান্সার আক্রান্ত হয়ে অনেকটা সময় অসুস্থ ছিলেন আমাদের সাংবাদিকতার অভিভাবক। সর্বশেষ ৮ জুলাই তাকে দেখতে গেলাম পান্থপথের বিআরবি হাসপাতালে। মাথার চুল সব উঠে গেছে, অক্সিজেন চলছে। ভাবি ডাকলেন, দেখো তো কে এসেছে, চিনতে পারো কিনা? চোখ মেললেন, কিন্তু চিনতে পারলেন না!

অবশেষে ৯ জুলাই রাতে পাড়ি দিলেন অনন্ত গন্তব্যে। সিঁথির ভাঁজ ভেঙে কপালের দিকে কিছুটা নুয়ে পড়ছে মাথাভর্তি একরাশ চুল; এমন বাবু ভাই-ই মনের গভীরে জেগে রবে সর্বদা। তার স্মৃতিতে গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।

লেখক: গল্পকার ও সংবাদকর্মী, যুগ্ম বার্তা সম্পাদক, দৈনিক যুগান্তর

প্রিয় পাঠক, লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই ঠিকানায় -
sarabangla.muktomot@gmail.com

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত মতামত ও লেখার দায় লেখকের একান্তই নিজস্ব, এর সাথে সারাবাংলার সম্পাদকীয় নীতিমালা সম্পর্কিত নয়। সারাবাংলা ডটনেট সকল মতাদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তবে মুক্তমতে প্রকাশিত লেখার দায় সারাবাংলার নয়।

সারাবাংলা/একে/আরএফ

Tags: ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন