বিজ্ঞাপন

নারীবাদ প্রয়োজন নাকি বিলাসিতা: নারীবাদ আছে, পুরুষবাদ কেন নাই!

July 17, 2020 | 6:09 pm

আনুশা মেহরিন

আগের পর্বে আমরা ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক সব ক্ষেত্রে নারীর প্রতি বৈষম্যের দিকটি তুলে ধরেছি। আজ আমরা কথা বলবো নারীবাদের বিকল্প হিসেবে ‘পুরুষবাদ’ কে দাঁড় করানোর চেষ্টা নিয়ে। আরও থাকবে পুরুষ নারীবাদীর কথা। তবে সেই আলোচনায় যাওয়ার আগে আমাদের জানা প্রয়োজন নারীর বঞ্চনার ইতিহাস। সেটি না জানলে আপনারা বুঝতে পারবেন না, কেন নারীবাদের বিকল্প হিসেবে পুরুষবাদের কথা বলা উচিৎ নয়। কেন প্রয়োজন নারীবাদ আর পুরুষরাও কেন নারীবাদী হয়।

বিজ্ঞাপন

ব্যক্তিগত জীবনের মৌলিক যেই অধিকারগুলো পুরুষ জন্মসূত্রে স্বাভাবিকভাবে লাভ করে, তার অনেকগুলো অর্জন করতে নারীকে সমাজের সাথে যুদ্ধ করতে হয়েছে দীর্ঘদিন। আসুন একবার চোখ বুলিয়ে নেই সেগুলোয়-
– উইল কিংবা কোন ধরনের আইনি নথিপত্রে স্বাক্ষর
– আইন তৈরিতে অংশগ্রহণ
– ভোট দেওয়া
– শিক্ষাগ্রহণ
– বিবাহবিচ্ছেদ চাওয়া
– উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া সম্পদ দাবি করা
– পুরুষের সমান মজুরি
– জীবনসঙ্গি মারা যাওয়ার পর পুনর্বিবাহ
– জীবনসঙ্গি মারা যাওয়ার পর বেঁচে থাকার অধিকার (হাসি পাচ্ছে? সতীদাহ প্রথার কথা ভাবুন)
– জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী কেনা ও ব্যবহার
– নিজের নামে ক্রেডিট কার্ড ইস্যু করা
– সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্ট ও নির্যাতকের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা
– যুদ্ধক্ষেত্রে ফ্রন্ট লাইনে কাজ করা
– নিজের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের ব্যাপারে সরাসরি ডাক্তারের সাথে কথা বলা
– কোনো বিচারিক পদে কাজ করা
– অ্যাথলেটিক জুতা কেনা
– নিজের নামে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খোলা
– বিয়েতে মতামত দেওয়া
– সন্তানধারণের সিদ্ধান্ত নেওয়া, যদিও সন্তান তিনি নিজ শরীরেই ধারণ করেন
– দিনের বেলা টয়লেটে যাওয়া
– সম্পত্তির মালিকানা
– নিজের অধিকারের জন্যে আন্দোলন করার

একজন নারীকে এই প্রতিটি মৌলিক থেকে মৌলিকতম অধিকারের জন্যে যুদ্ধ করতে হয়েছে সমাজের সঙ্গে, পরিবারের সঙ্গে। যেই নারীরা বলেন, আমরা নারীবাদী না- আপনাদের কি মনে হয় নূন্যতম নারীবাদ প্রতিষ্ঠিত না হলে এই সাধারণ কথাটুকুও আপনি বলতে পারতেন? নারীবাদীরা আন্দোলন না করলে আপনার এখনও নিজের কণ্ঠস্বর বা নিজের মতামত বলে কিছুই থাকতো না। এখনও দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে আপনারা পুরুষের মুখাপেক্ষী হয়ে কাটিয়ে দিতেন জীবন। নারীবাদীরা নারীবাদ প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছে বলেই আজ আমরা নিজেদের একটা জীবন পেয়েছি যেই জীবন নিয়ে আমাদের কিছু হলেও বলার আছে।

এখন প্রশ্ন করতে পারেন নারীবাদ আছে, পুরুষবাদ কেন নেই?
তার কারণ পুরুষকে তার সেক্সুয়াল আইডেন্টিটি বা লৈঙ্গিক পরিচয়ের জন্য উপরের কোন অধিকারের জন্য লড়াই করতে হয়নি। তার জননাঙ্গের জন্য তাকে ডাক্তারের কাছে যাওয়ার জন্যে আন্দোলন করতে হয়নি, তাকে ভোট দেওয়া থেকে বিরত রাখা হয়নি, কম মজুরী দেওয়া হয়নি এমনকি মেরেও ফেলা হয়নি। একজন মানুষ হিসেবে যা স্বাভাবিকভাবে পাওয়ার কথা তা পুরুষ এমনিতেই পায়। আর যা পায়না তার জন্য আইন আদালত, সমাজ সংসার সবই তার পক্ষেই কথা বলে। এমনকি একজন পুরুষ একজন নারীকে বা শিশুকে ধর্ষণ করলেও সমাজ কাঠগড়ায় দাঁড় করায় নির্যাতিত নারীটিকে, সেই পুরুষটিকে নয়।
দিনে রাতে যেকোন সময় বাইরে যাওয়ার, পছন্দমত পোশাক পরার, ইচ্ছামত খাওয়ার, যা ইচ্ছা করার, বলার অধিকার পুরুষ জন্ম থেকেই পায়। আপনারা দেখবেন একজন পুরুষ প্রসাব পেলে রাস্তার পাশে কোথাও দাঁড়িয়ে যান। একটি পাবলিক টয়লেট খুঁজে বের করার প্রয়োজনীয়তা পর্যন্ত তিনি বোধ করেন না। একজন নারী কিন্তু নিজের শালীনতা বোধের জন্য অনেকসময় সারাদিনই প্রসাব-পায়খানা আটকে রাখতে বাধ্য হন। নারী হয়ে টয়লেটে যাবেন, এটি জনসম্মুখে বলাও তার জন্য লজ্জার বিষয় করে রাখা হয়েছে। শহরে যেমন মানসম্মত পাবলিক টয়লেটের সুবিধা নাই তেমনি গ্রাম এলাকায় বাইরের দিকে টয়লেট থাকায় দিনের বেলা নারীরা যেতে লজ্জাবোধ করেন। নিজের শরীর নিয়ে কথা বলাই তার জন্য লজ্জার বানিয়ে রাখা হয়েছে। এভাবে যৌনতা, আরাম-আয়েশ ইত্যাদি সকল সুবিধাও পুরুষ ভোগ করেন এবং নারীকে বঞ্চিত করেন। তাই নারীবাদ থাকলেও পুরুষবাদ নাই। আর আমি নারীবাদে বিশ্বাসী একজন মানুষ হিসেবে চাইনা পুরুষ অথবা নারী কেউই কোন ধরনের বঞ্চনার শিকার হোক। যদি কোন পুরুষ তার মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়, আমি তার পক্ষেও কথা বলবো। নারী পুরুষ নির্বিশেষে পৃথিবীর প্রতিটি মুক্তবুদ্ধির সচেতন মানুষই তাই বলেন।

বিজ্ঞাপন

নারীবাদ প্রয়োজন নাকি বিলাসিতা: বৈষম্যের বিরুদ্ধে কথা বলে নারীবাদ

এখন অনেকেই বলবেন নারীরা নাহলে নারীবাদী হল, পুরুষরা কীভাবে নারীবাদী হয়। আসলে সবই শোয়ার ধান্ধা!
নারীবাদী হওয়ার সঙ্গে জননাঙ্গের কোনো সম্পর্ক নেই। একজন নারী যেমন নারীবাদী হতে পারে, একজন পুরুষও পারে। এতে পুরুষত্ব চলে যাওয়ার কোনো ভয় নেই। একজন মানুষ যদি বিশ্বাস করে একজন নারী ও পুরুষের সমান অধিকার থাকা উচিত, তবেই সে নারীবাদী বলে নিজেকে ভাবতে পারে। নারীবাদী কোনো ঘৃণ্য বা নোংরা কথা নয় যে এটাকে ‘আমি লেবেলড হতে চাই না’ বলে এড়িয়ে যেতে পারবেন। পুরুষ নারীবাদীরা ‘শোয়ার ধান্ধা’ করতে নিজেকে নারীবাদী দাবি করে না, তারা সমানাধিকার চান তাই তারা নারীবাদী। আসুন আমরা কিছু বিখ্যাত নারীবাদী পুরুষের নাম জেনে নেই।
-গায়ক জন লিজেন্ড
-অভিনেতা মার্ক রাফেলো
– কোল্ডপ্লের ভোকালিস্ট ক্রিস মার্টিন
– অস্ট্রেলিয়ান অভিনেতা ক্রিস হেমসওর্থ
– অভিনেতা উইল স্মিথ
– অভিনেতা অ্যাশটন কুচার
– অভিনেতা-পরিচালক-গায়ক-প্রযোজক ফারহান আখতার
– নারীকূলের হার্টথ্রুব জেসন মোমোয়া
– সবার প্রিয় রস গেলার , ডেভিড শুইমার
– আমাদের সবার প্রিয় হ্যারি পটার, ড্যানিয়েল রেডক্লিফ
– অভিনেতা সেথ মেয়ার
– ব্রিটেনের রাজপুত্র প্রিন্স হ্যারি
– নারীকূলের হার্টথ্রুব রায়ান গসলিং
– জেমস বন্ডখ্যাত ড্যানিয়েল ক্রেইগ
– ব্রুকলিন ৯৯৯ এর জেইক পেরাল্টা, অ্যান্ডি স্যাম্বার্গ
– দালাই লামা (জ্বী, তিনিও)
– বারাক ওবামা
– আমার তালিকাতে লাস্ট বাট নট দ্যা লিস্ট, জাস্টিন ট্রুডো।
এরা প্রত্যেকেই সেলফক্লেইমড (দাবিকৃত) ফেমিনিস্ট। এবং কেউই ‘শোয়ার ধান্ধা’ করে নারীবাদী হননি। তারা অনুভব করেন পৃথিবীটা সবার, তাই সবার সমান সুবিধা পাওয়া উচিৎ, তাই তারা নারীবাদী।

নারীকে একজন মানুষ হিসেবে জীবনযাপন করতে পাল্টাতে হয়েছে আইন, যেন তাকে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হয়ে থাকতে না হয়। সকল আইন-কানুনে সমান অধিকার পেতে নারীকে বছরের পর পর আন্দোলন করতে হয়েছে। নারী ন্যায়বিচার পায়নি, নারী নিজের শরীরের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি, নারী নিজের জীবনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। তাহলে নারীর অধিকার আদায়ের জন্যে লড়াইয়ের নাম কেন নারীবাদ হবে না? একটা সমাজের যেই গোষ্ঠী ন্যায়বিচার পায় না, অত্যাচারিত হয়, তাদের জন্যেই তো মতবাদ প্রতিষ্ঠিত হতে হবে। (চলবে…)

লেখক- তরুণ উদ্যোক্তা (ডিজাইনার ও ফাউন্ডার, ময়নার গয়না)

বিজ্ঞাপন

সারাবাংলা/আরএফ

Tags: , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন