বিজ্ঞাপন

স্টিলের ছুরি ২ হাজার টাকা, চামচ ১ হাজার: তদন্ত কমিটি গঠন

July 21, 2020 | 1:42 am

জোসনা জামান, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: ‘কৃষি যান্ত্রিকীকরণ’ প্রকল্পের আওতায় বিভিন্ন পণ্যের দামের সঙ্গে এসব পণ্যের বাজার মূল্যের কোনো সঙ্গতি নেই। প্রকল্পে এক কেজি ধারণক্ষমতার প্লাস্টিকের মসলার পাত্রের দাম ধরা হয়েছে ২ হাজার টাকা, প্লাস্টিকের বড় চপিং বোর্ডের দাম ধরা হয়েছে এক হাজার টাকা। স্টেনলেস স্টিলের বড় ছুরির প্রতিটির দাম দুই হাজার টাকা হিসাবে ৩৬টির জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৭২ হাজার টাকা। তরকারি কাটার জন্য ৩৬টি বড় কাঁচির দামও ধরা হয়েছে ৭২ হাজার টাকা। আবার অ্যালুমিনিয়ামের বড় আকৃতির ৯০টি চামচের প্রতিটির দাম ধরা হয়েছে এক হাজার টাকা।

বিজ্ঞাপন

কেবল তৈজসপত্রই নয়, রিক্রিয়েশন রুমের জন্য স্মার্ট টিভি, ক্যারাম বোর্ড, নেটসহ ভলিবল, বড় আকৃতির ফুটবল, দাবার বোর্ড ও টেবিল টেনিসের পেছনে খরচ দেখানো হয়েছে ৫১ লাখ টাকার বেশি, যা বাজারমূল্যের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ।

গত ১৪ জুলাই জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় অনুমোদন পাওয়া ‘কৃষি যান্ত্রিকীকরণ’ শীর্ষক প্রকল্পের বিভিন্ন অংশের ব্যয় নির্বাহের নথিতে বিভিন্ন পণ্যের বাড়তি দাম প্রাক্কলনের এ চিত্র পাওয়া গেছে। মজার বিষয় হলো— প্রকল্পের মূল কাজের বাইরে ট্রেনিং সেন্টারের জন্য এসব পণ্য কেনা হবে।

আরও পড়ুন- করোনা বিবেচনায় কৃষিতে আসছে ৩ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প

বিজ্ঞাপন

বিষয়গুলো জানাজানি হলে পরিকল্পনামন্ত্রী সারাবাংলাকে জানিয়েছেন, তিনি এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে কৃষি মন্ত্রণালয়কে অবহিত করছেন। অন্যদিকে, কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বাড়তি খরচ হিসাবের বিষয়টি নিয়ে এরই মধ্যে ৩ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।

সূত্র জানায়, প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ব্যয় হবে সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে ৩ হাজার ২০ কোটি টাকা। এটি কৃষি মন্ত্রণালয়ের মেগা প্রকল্প। করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে কৃষির গুরুত্ব ব্যাপকভাবে বেড় যাওয়ায় নতুন এ প্রকল্পটি হাতে নেওয়া হয়েছে। কৃষি যান্ত্রিকীকরণের মাধ্যমে দেশের কৃষি ব্যবস্থার আধুনিকায়ন হবে এবং তাতে বাড়তি ফলনের মাধ্যমে মহামারিকালেও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে— এমন আশাবাদ থেকে প্রকল্পটি অনুমোদন দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

সরকারের অগ্রাধিকার পাওয়া প্রকল্পটির নথির কিছু অংশ সারাবাংলার হাতে পৌঁছেছে। তাতেই দেখা গেছে, প্রকল্পের বিভিন্ন অংশে বিভিন্ন পণ্যসামগ্রী কিনতে ধরা হয়েছে বাজারমূল্যের চেয়ে অনেক বেশি দাম। মসলার পাত্র, চপিং বোর্ড, স্টিলের ছুরি, স্টিলের কাঁচি, অ্যালুমিনিয়ামের চামচের কথা তো আগেই বলা হয়েছে। এর বাইরেও মাঝারি আকারের অ্যালুমিনিয়ামের চামচের দাম ধরা হয়েছে প্রতিটি ৫০০ টাকা হিসাবে ৪৫ হাজার টাকা। বাজারে এক থেকে দেড়শ টাকাতেই এই চামচ পাওয়া যায়। একইভাবে ২০০ লিটারের প্লাস্টিকের পানির ড্রামের দাম ধরা হয়েছে ১০ হাজার টাকা করে। এরকম ৩৬টির জন্য বরাদ্দ তিন লাখ ৬০ হাজার টাকা। কিন্তু বাজারে এরকম একটি ড্রামের দাম হাজার তিনেক টাকার আশপাশে। আর সবজি কাটতে বড় আকৃতির একেকটি বটির দাম ধরা হয়েছে ১০ হাজার টাকা, ৩৬টি বটির জন্য ৩ লাখ ৬০ হাজার টাকা। অথচ বাজারে সবচেয়ে ভালো মানের ও সবচেয়ে বড় আকারের বটির দামও তিন থেকে চার হাজার টাকার বেশি নয়।

বিজ্ঞাপন

প্লেট-গ্লাসের ক্ষেত্রেও বরাদ্দের হাল একইরকম। যেমন— পোরসেলিনের ফুল প্লেট একেকটির দাম ধরা হয়েছে এক হাজার টাকা, ৭২০টির জন্য ৭ লাখ ২০ হাজার টাকা। একইরকম হাফ প্লেটের দাম প্রতিটি ৫০০ টাকা। চা চামচের দাম ধরা হয়েছে ১০০ টাকা করে। প্রকল্পে একেকটি চেয়ারের দাম ধরা হয়েছে ৫০ হাজার টাকা। ৭২টির জন্য বরাদ্দ ধরা হয়েছে ৩৬ লাখ টাকা।

রান্নাঘরের অন্যান্য সরঞ্জামের মধ্যে অ্যালুমিনিয়ামের (২০ জন) রাইস ডিশের দাম ধরা হয়েছে ৩ হাজার টাকা করে ৯০টির দাম ২ লাখ ৭০ হাজার টাকা, তরকারির ডিশ ধরা হয়েছে ৯০টি ২ হাজার টাকা করে এক লাখ ৮০ হাজার টাকা। নন-স্টিক ফ্রাই প্যান ৯০টির দাম ধরা হয়েছে ৫ হাজার টাকা করে সাড়ে চার লাখ টাকা। পাথরের বড় শিল-পাটার দাম একেকটি ৫ হাজার টাকা হিসাবে ১৮টির দাম ৯০ হাজার টাকা।

এদিকে, ৪ ফুট বাই ৪ ফুট আকৃতির কাঠের ক্যারাম বোর্ডের একেকটির দাম ধরা হয়েছে ২০ হাজার টাকা, ৩৬টির দাম ৭ লাখ ২০ হাজার টাকা। নেটসহ ৩৬ সেট ভলিবলের দাম ৫ হাজার টাকা করে ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা। একই দাম ৩৬টি ফুটবলেরও। প্লাস্টিকের দাবার বোর্ডের দাম অবশ্য কিছুটা ‘কম’— তিন হাজার টাকা করে ৩৬টি ১ লাখ ৮ হাজার টাকা। আর একেকটি টেবিল টেনিস কোর্টের খরচ ১ লাখ টাকা। এরকম মোট ১৮টি কোর্ট বসবে।

এছাড়া প্রকল্পের আওতায় দেড় থেকে দুই টন ক্ষমতার ১০টি এসির দাম ধরা হয়েছে ২ লাখ টাকা করে ২০ লাখ টাকা। অথচ বাজারে ২ টন এসির দাম এক লাখ টাকার কিছু বেশি। আবার ইন্টেল কোরআইফাইভ ৫ প্রসেসরের ১৪ ইঞ্চি আকৃতির ডিসপ্লে’র পাঁচটি ল্যাপটপ কিনতে প্রতিটিতে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা। বাজারে এর চেয়ে অনেক উচ্চ কনফিগারেশনের ল্যাপটপও ৭০ থেকে ৮০ হাজার টাকায় পাওয়া যায়। প্রকল্পে প্রতিটি সাদাকালো প্রিন্টারের দাম ধরা হয়েছে ২০ হাজার টাকা, যার বাজার মূল্য আট হাজার টাকার বেশি নয়।

বিজ্ঞাপন

প্রকল্পটির এমন লাগামছাড়া খরচ নিয়ে জানতে চাইলে পরিকল্পনা কমিশনের কৃষি, পানিসম্পদ ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগের সদস্য (সচিব) জাকির হোসেন আকন্দ সারাবাংলাকে বলেন, বাজারের দামের সঙ্গে ট্যাক্স, প্রতিষ্ঠানের লাভসহ অন্যান্য ব্যয় মিলে ২৫ শতাংশ বেশি হিসাব ধরা হয়। কিন্তু তাই বলে সব পণ্যের দাম অসামঞ্জস্যপূর্ণ হবে— এমন হতে পারে না।

পরিকল্পনা কমিশনে প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভায় প্রকল্পগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখা সম্ভব হয় না বলে মন্তব্য করেন জাকির হোসেন আকন্দ। তিনি বলেন, এগুলো দেখার প্রথম দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট অধিদফতরের, যারা উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) তৈরি করে। তারপর যায় মন্ত্রণালয়ে। সেখানে পরিকল্পন উইং এগুলো যাচাই-বাছাই করে। ওই মন্ত্রণালয়ের স্ট্যান্ডিং কমিটির মিটিংয়ে প্রকল্প প্রস্তাব যাচাই-বাছাই হয়। এরপর সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সচিবের অনুমতিসাপেক্ষে পরিকল্পনা কমিশনে প্রস্তাবটি আসে। পরে পিইসি সভা হয় মাত্র দেড় থেকে দুই ঘণ্টা। এই সময়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সবকিছু দেখা সম্ভব হয় না। তার ওপর রয়েছে জনবল সংকট, কোভিডের কারণে কর্মকর্তাদের উপস্থিতিও কম। এতসব সীমাবদ্ধতার মধ্যেও সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হয় ভালোভাবে দেখার।

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) সচিব আবুল মনসুর মো. ফয়েজ উল্লাহ সারাবাংলাকে বলেন, ‘প্রকল্প প্রস্তবে বেশি দাম ধরাটা এক ধরনের অনিয়ম। বাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই প্রকল্পের পণ্যের দাম নির্ধারণ করতে হবে। এটিই নিয়ম। ডিপিপিতে বেশি দাম ধরলে ঠিকাদাররা দুর্নীতি করার সুযোগ পেয়ে যান। এটি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা উচিত।’

এ বিষয়ে জানতে কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাকের মোবাইল নম্বরে একাধিকবার কল করলেও তিনি রিসিভ করেননি। তবে সারাবাংলার সঙ্গে কথা হয় পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নানের। তিনি বলেন, ‘এটা খুবই দুঃখজনক। আমি বিষয়টি খতিয়ে দেখছি। এরই মধ্যে ফাইলপত্র তলব করেছি। পরিকল্পনা কমিশনের সংশ্লিষ্ট সদস্যদের (সচিব) সঙ্গে বৈঠক করছি। একনেকে পাস হলেও কী করা যায়, সে বিষয়টি নিয়ে আমি কৃষিমন্ত্রীকে ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ জানিয়েছি। তিনি নিশ্চয়ই ব্যবস্থা নেবেন।’ এরকমভাবে পণ্যের দাম বেশি ধরা হলে নিশ্চিতভাবেই অনিয়মের সুযোগ থাকে বলে মন্তব্য পরিকল্পনামন্ত্রীরও।

পরে কৃষি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল একটি সূত্র সারাবাংলাকে জানায়, পরিকল্পনামন্ত্রীর অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে সোমবার কৃষি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব আব্দুর রউফকে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। সাত দিনের মধ্যে কমিটিকে তদন্ত প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। প্রতিবেদন পেলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়াসহ অন্যান্য পদক্ষেপ নেওয়া হবে। এক্ষেত্রে কৃষি মন্ত্রণালয় কঠোর অবস্থানে রয়েছে বলে জানা গেছে।

সূত্র জানায়, ‘সমন্বিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ’ শীর্ষক প্রকল্পটি সারাদেশে বাস্তবায়ন করবে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর (ডিএই)। চলতি জুলাই থেকে শুরু করে ২০২৫ সালের জুনের মধ্যে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের লক্ষ্য ধরা হয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতি সরবরাহ ও ব্যবহার বাড়িয়ে ফসলের ১০ থেকে ১৫ শতাংশ অপচয় রোধ, চাষাবাদে ৫০ শতাংশ সময় এবং ২০ শতাংশ অর্থ সাশ্রয় করা যাবে। পাশাপাশি সমন্বিত আবাদ করে কৃষি যন্ত্রপাতির ৫০ শতাংশ কর্মদক্ষতা বাড়ানো সম্ভব। এছাড়া যান্ত্রিকীকরণের মাধ্যমে ফলন কাটা সংক্রান্ত ব্যবস্থাপনায় নারীদের অংশগ্রহণও বাড়ানো সম্ভব হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

সারাবাংলা/জেজে/টিআর

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন