বিজ্ঞাপন

হায়া সোফিয়ার মসজিদে রূপান্তর: ধর্মীয় নয়, রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত

July 22, 2020 | 1:29 pm

সারাবাংলা ডেস্ক

ঢাকা: তুরস্কের ইস্তানবুলে বিশ্ব বিখ্যাত জাদুঘর হায়া সোফিয়াকে মসজিদে রূপান্তরের আদেশ দিয়েছেন সেদেশের একটি আদালত। গত ১০ জুলাই হায়া সোফিয়ার জাদুঘর মর্যাদা নাকচ করা হয়। আদালতের রায়ের পরপরই একই দিন ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্য হায়া সোফিয়া জাদুঘর থেকে মসজিদের রূপান্তরের এক ডিক্রিত স্বাক্ষর করেন প্রেসিডেন্ট এরদোগান। সেদিনই হায়া সোফিয়ায় প্রায় ৮৬ বছর পর প্রথম আজান দেওয়া হয় এবং প্রেসিডেন্ট এরদোগান এক বিবৃতিতে বলেন, আগামী ২৪ জুলাই থেকে এখানে নামাজ পড়া হবে।

বিজ্ঞাপন

এদিন তুরস্কের সর্বোচ্চ প্রশাসনিক আদালত মামলার রায়ে বলেন, ‘১৯৩৪ সালে মন্ত্রিসভার যে সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মসজিদ থেকে হায়া সোফিয়াকে জাদুঘরে রূপান্তরিত করেছিল, তা আইন মেনে করা হয়নি।’ ফলে হায়া সোফিয়াকে মসজিদের রূপান্তরের এরদোগানের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন পূরণে আর কোন বাধা থাকেনি।

এই ঘোষণার পর বিশ্বজুড়ে নানা মহল থেকে মিশ্র প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়। ইউনেস্কো থেকে শুরু করে বিশ্বের নানা দেশ ও ক্যাথলিক খ্রিস্টানদের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা পোপ দুঃখ প্রকাশ করেন। বাংলাদেশেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। এক দল এমন চমৎকার একটি বিশ্ব ঐতিহ্যের স্থাপনাকে ধর্মীয় স্থান বানানোয় দুঃখ প্রকাশ করলেও আরেক দল আনন্দ প্রকাশ করতে থাকে একে ইসলামের বিজয় হিসেবে চিহ্নিত করে। সাধারণ মুসলিম থেকে শুরু করে অনেক ইসলামী বক্তাও এই মসজিদে যেয়ে নামাজ আদায়ের ইচ্ছা প্রকাশ করেন। অন্যদিকে আরেক দল ঐতিহ্যবাহী এই স্থাপনাকে মসজিদে রূপান্তরের ফলে এতে আগের মত আর সবার প্রবেশাধিকার থাকবে কি না এবং স্থাপনাটি নির্মূলের আশঙ্কা প্রকাশ করেন।

এমন পরিস্থিতিতে সারাবাংলা প্রযোজিত ‘নিউ নরমাল’ অনুষ্ঠানের আলোচনার বিষয় ছিল হায়া সোফিয়া। আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ ফাহিম তানভীর আহমেদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক শাহাব এনাম খান। আলোচনায় বক্তারা বলেন, হায়া সোফিয়াকে মসজিদে রূপান্তর একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। এর সঙ্গে ধর্মের কোন সম্পর্ক নাই।

বিজ্ঞাপন

অনুষ্ঠানটির সঞ্চালনায় ছিলেন সারাবাংলা ডট নেটের সিনিয়র রিপোর্টার সৈকত ভৌমিক। আলোচনার শুরুতেই সারাবাংলা ডট নেটের নিউজরুম এডিটর আতিকুল ইসলাম ইমন হায়া সোফিয়ার বিস্তারিত ইতিহাস তুলে ধরেন।

এরপর ইসলামি চিন্তাবিদ ফাহিম তানভীর আহমেদ হায়া সোফিয়ার মসজিদের রূপান্তরের ধর্মীয় গুরুত্ব ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যেসব কথাবার্তা হচ্ছে সেগুলোর স্বরূপ তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘১০ ই জুলাই রায়ের পর থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানা ধরনের আলাপ দেখা যাচ্ছে। আমি ইসলামের আলোকে করনীয় ও বর্জনীয় সম্পর্ক আলাপ করব যতটা সম্ভব। হায়া সোফিয়াকে মসজিদে রূপান্তর বিষয়ে দুটি মতবাদ আছে। গত কয়েকদিনের আলোচনার একটি দিক নিয়ে আমি প্রথমেই বলতে চাই আর তা হল হায়া সোফিয়াকে সুলতান মুহম্মদ ফাতিহ আর এরদোগানের মসজিদে রূপান্তরের ঘটনাকে এক করে দেখা হচ্ছে যা সঠিক নয়। দুটির প্রেক্ষাপট একদমই আলাদা।

বিজ্ঞাপন

ইতিহাস বলে হায়া সোফিয়া একদম শুরু থেকেই বিভিন্ন সময়ে ভাঙা-গড়ার মধ্য দিয়ে গেছে, হয়েছে একের অধিক বার হাত বদল। বিশ্বের বিভিন্ন উপাসনালয়ের ইতিহাসের ক্ষেত্রেই এটি দেখা গেছে। মুসলমানরা যদি এমন কোন স্থানে যায় যেখানে অন্য ধর্মের লোকজন বাস করে এবং মুসলমানদের কোন উপাসনালয় নাই তবে সেখানে যেয়ে করণীয় সম্পর্কে ইসলামি নির্দেশনা খুবই পরিষ্কার। যুদ্ধের নিয়ম সম্পর্কে কুরআনে স্পষ্ট করে বলা আছে, মুসলমানরা অন্য কোন ভূমিতে গেলে বা সেখানে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করলেই সেখানে যেসব সম্প্রদায়ের উপাসনালয় আছে তা অপবিত্র বা ধ্বংস করা যাবে না। আল কুরআনের ২২ নম্বর সুরা, সুরতুল হাজ্বের ৪০ নম্বর আয়াতে এ বিষয়ে স্পষ্ট নির্দেশনা দেওয়া আছে। মুসলমানরা যখন আরব পেনিনসুলা থেকে বের হয়ে পূর্ব ও উত্তর দিকে যাওয়া শুরু করে তখন তারা এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে শুরু করে। তারা যখন বাইজেন্টাইন যায় সেখানে তারা খ্রিস্টানদের মুখোমুখি হয়। সিরিয়া, মিশর, লেবানন, ফিলিস্তিন, তুরস্কের একটি বড় অংশ ইত্যাদি নিয়ে তখন বাইজান্টাইন সাম্রাজ্য ছিল।

অন্য ভূমিতে ইসলাম প্রচার বিষয়ক প্রচারণা শুরু হয়েছিলো হজরত মুহম্মদ (সঃ) বেঁচে থাকা অবস্থাতেই। ৬৩৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি মৃত্যুবরণ করেন আর ৬৩৬ খ্রিস্টাব্দে জেরুজালেমের পতন হয় মুসলমানদের হাতে। মুসলমানদের দ্বিতীয় খলিফা ওমর ইবনে খ্বাত্বাব (রঃ) এর নেতৃত্বে মুসলিমরা যখন বাইজান্টাইন অধিকৃত এলাকাতে ঢুকতে শুরু করে। সেখানে তিনি একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেন। সেই চুক্তিতে লেখা আছে একজন মুসলমান অমুসলিম এলাকা দখল করলে কি করবে না করবে। সেই চুক্তিতে স্পষ্টভাবে লেখা আছে তিনি সেখানে থাকা চার্চ দখল করবেন না। সেসময়ে দেখা গেছে এখনকার মত জাতি ব্যবস্থা ছিল না। তখন জাতি বলতে বোঝাতো মুসলিম জাতি, বাইজান্টাইন জাতি, ক্যাথলিক জাতি ইত্যাদি। এবং বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জাতিই অন্য ধর্মের স্থাপনা দখল ও লুট করেছে। এমনকি পোপ এখন হায়া সোফিয়াকে নিয়ে শোক প্রকাশ করলেও ওনার ট্রেজারিতে এখনও হায়া সোফিয়া থেকে লুট করা মূল্যবান জিনিসপত্র পাওয়া যাবে।

মুসলমানরা যখন নতুন কোন জায়গায় যাবে সেক্ষেত্রে দুটি ঘটনা ঘটতে পারে। জেরুসালেম অধিকার করার পর তারা মুসলমানদের কাছে আত্মসমর্পণ করে। সেখানে মুসলিম শাসন চালু হওয়ার পরেও স্থানীয় অধিবাসীদের নিজ ভূখণ্ডে থেকে যাওয়ার পূর্ণ অধিকার ছিল। তাদের সেখানে থাকার নিয়মনীতি স্পষ্টভাবে চুক্তিতে লেখা ছিল। অনেক খ্রিস্টানই সেখানে থেকে যায়। ফলে তাদের চার্চগুলোতে আর হাত দেওয়া হয়নি। তবে হায়া সোফিয়া ছাড়াও আরও কিছু চার্চে হাত দেওয়া হয়েছে। এটি করা হয়েছে মূলত দুটি কারণে। প্রথমত, সেসব জনপদ ছিলো যুদ্ধের মাধ্যমে অধিকৃত অর্থাৎ যারা কোন শান্তিচুক্তি করেনি এবং পরাজিত অন্য ধর্মাবলম্বীরা সেই ভূখণ্ড থেকে চলে যায়। কনস্টান্টিনোপলে যখন মুসলমানরা বিজয়ী হয়, তখন খ্রিস্টানরা সেখান থেকে জাহাজ ভর্তি করে পালিয়ে যায়। এমন অনেক ক্ষেত্রে মুসলমনারা নতুন উপাসনালয় না বানিয়ে পরিত্যক্ত সেসব উপাসনালয়কে নিজেদের উপাসনালয় হিসেবে তৈরি করে নিয়েছে।’

তুরস্কের বর্তমান এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানাচ্ছে জাতিসংঘসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও সংগঠন। এমনকি তুরস্কের অভ্যন্তরে সেক্যুলার রাজনৈতিক দলগুলোও এমন পদক্ষেপের বিরোধিতা করছে। এমন পরিস্থিতিতে বিশ্ব রাজনীতিতে তুরস্কের ভবিষ্যৎ কি? এমন প্রশ্নের জবাবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শাহাব এনাম খান বলেন, এখানে আসলে আমাদের মনে রাখা দরকার হায়া সোফিয়াকে যে হঠাত করে রূপান্তর করা হয়েছে তা নয়, এটি তুরস্ক সরকারের অনেক পুরনো এজেন্ডা। ১৯৬৫ সালে এটিকে রূপান্তর করার জন্য তুরস্কের সিভিল সোসাইটি বা পয়েটিক বা লিটারেচার কমিউনিটি কিন্তু দাবি করেছিলো। একটা জিনিস দেখতে হবে যে কেন ২৪ তারিখ নামাজ পড়ার কথা বলা হলো। এটা করোনার সাথে কোনো সম্পর্কিত কি না বা, আসলে করোনার সাথে কোন সম্পর্কেই এটার নাই। ২৪ তারিখ দিনটি আসলে কোইনসাইড করে ট্রিটি অব লুজানের সাথে। ট্রিটি অব লুজানের মাধ্যমেই কিন্তু অটোমান এম্পেরার শেষ হয়ে যায় এবং পরবর্তীতে আমরা নতুন টার্কি বা মর্ডান টার্কি বলি বা বলার চেষ্টা করছি সেক্যুলার টার্কি তার উত্থান।

বিজ্ঞাপন

নামাজ পড়া হলেও ব্লু মস্কে যে কেউ যেতে পারে। এমনকি ছবি তুলতে ও ঘুরতেও যেতে পারে। একইভাবে হায়া সোফিয়ায় নামাজের সময় বাদ দিয়ে যদি সবার জন্য ওপেন রাখা যায় সেটিতে আমি তেমন সমস্যা দেখছি না। কারণ, ধর্মীয় স্থাপনার ক্ষেত্রে এমন বিধিনিষেধ অন্যান্য সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রেও (উদাহরণস্বরূপ ক্যাথলিক চার্চ) দেখা যায়। আমার কনসার্নের জায়গা হল তুরস্ক এই ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটটিকে তার স্থাপনা অটুট রেখে সবার জন্য ওপেন রাখতে পারবে কিনা।’

ফাহিম তানভীর আহমেদ বলেন, ‘হেরিটেজের কথা আসলে বলতে হয়, তুর্কি জাতি যদি নিজেদের ইতিহাসের কথা চিন্তা করে তাহলে সেখানে ইসলাম ছাড়া কিছু নাই। তারা নিজেদের অতীত বর্জন করতে পারবে না। তাদের জাতিসত্তার মধ্যেই ইসলাম আছে যা স্বয়ং কামাল আতাতুর্কও বদলানোর চিন্তা করেননি। হায়া সোফিয়া ছিল বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের প্রতীক। এখানে সম্রাটদের অভিষেক অনুষ্ঠান হত। এর মাধ্যমে তারা পরম সত্তার কাছ থেকে আশীর্বাদ লাভ করেছে বলে মনে করত। এটি যে একটি বাইজান্টাইন সাম্রাজ্য ছিল সেটি পরিবর্তনের জন্য মুসলিমদের সবার আগে হায়া সোফিয়ায় বদল আনার দরকার ছিল। সেই রূপান্তর মসজিদে হবে না অন্য কিছুতে তা অন্য আলোচনা। কিন্তু সেটি আগের মত একই অবস্থানে থাকতে দেওয়া যেত না। এটিই ছিল সেসময়ের স্বাভাবিক আচরণ। একারণেই ক্যাথলিকরাও সেখানে যেয়ে একে চার্চে রূপান্তর করে। এটি ধর্মীয় নয়, রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। সেক্যুলার মোস্তফা কামাল আতাতুর্ক হায়া সোফিয়াকে মসজিদ থেকে চার্চে রূপান্তর না করে একে জাদুঘরে রূপান্তর করেন। কারণ, তিনি তুরস্ককে ধর্ম বিশ্বাসের জাতি থেকে বের করতে চেয়েছিলেন।’

শাহাব এনাম খান বলেন, ‘আপনাকে এখানে খেয়াল করতে হবে যে টার্কির যে পলিটিকাল জেনেসিস যেটা ছিলো সেটার মধ্যে বড় রকমের রিলিজিয়াস কন্টিনিউটি সবসময় ছিলো। এটা ওয়েস্টার্ন সোসাইটি এক  রকমভাবে ব্যাখ্যা করে আর আরব বিশ্ব আরেক রকমভাবে ব্যাখ্যা করে। আপনি যেটা বলছিলেন যে পোপ থেকে শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ইত্যাদি ইত্যাদি নিন্দা করেছে, আবার আরেক দিকে যদি দেখেন আরব ওয়ার্ল্ড বা ইরানিয়ান যে বলয়গুলো আছে তারা কিন্তু এটাকে ওয়েলকাম করেছে। টার্কি কিন্তু ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের ফাউন্ডিং মেম্বার। তার মানে তারা কিন্তু ইইউ এর যে ফর্মেশন কাউন্সিল অব ইউরোপ ১৯৪৯ এর তারা প্রথম থেকেই অংশ। কিন্তু আলটিমেটলি ২০১৭ সালের আগে তাদের ফুল মেম্বারশিপ দেওয়া হয়নি। ফুল মেম্বারশিপ কেন দেওয়া হয়নি এটাও বুঝার দরকার আছে কারণ, ইইউ এর বরাবরই সন্দেহ ছিলো যে তুরস্ক মূলত একটি ইসলামিক স্টেট। এখানেই কিন্তু একটা ডিভিশন ছিলো ইইউ’র ভিতরেই যে তুরস্ককে একটি সেকুলার স্টেট হিসেবে কনসিডার করবে নাকি নন সেকুলার হিসেবে করবে। যদিও কখনই বলা হয়নি যে এটা একটি ইসলামিক স্টেট কিন্তু বলা হয়েছে যে এটি একটি নন সেকুলার স্টেট। ফলে ২০১৭ সালের পর ইইউ এর সাথে আর সম্পর্ক আগায়নি তাদের। ফলে দেখা যায় ইইউ এর সাথে তুরস্কের সম্পর্ক অনেক আগে থেকেই টানাপোড়ন ছিলো। ২০১৭ সালে এসে তা একেবারেই থেমে যায়। ফলে এটা এরদোগানের থেকে শুরু না এটা অনেক আগে থেকেই।

ইউরোপিয়ান ইউনিয়নকে মাথায় রেখে হায়া সোফিয়াকে নিয়ে ভাবনা চিন্তা করার কোনো জায়গা নেই তুরস্কের।

আরেকটি বিষয় হলো হায়া সোফিয়ার কারণে গ্লোবাল পলিটিক্স বা খ্রিস্টান ওয়ার্ল্ড, মুসলিম ওয়ার্ল্ড এসবে কোনো প্রভাব পড়বে কি না, আসলে কোনো প্রভাব পড়বে না।

ইউনেস্কোর মেইন কনসার্ন হলো হায়া সোফিয়া পাবলিকের জন্য খোলা থাকবে কি না- ট্যাকনিক্যালি তুরস্কের সরকার নিশ্চিত করেছে যে এটা খোলা থাকবে।’

ফাহিম তানভীর আহমেদ বলেন, ‘বর্তমানে হায়া সোফিয়াকে মসজিদের রূপান্তর করায় মুসলিমদের বিরাট কোন অর্জন হয়েছে বলে মনে করি না আমি। শাহাব এনাম স্যারের সঙ্গে আমি একমত। আমি মনে করি, এটি তুরস্কের একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত যার প্রভাবক ওদের আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক রাজনীতি। এর সঙ্গে ইসলামের বা ধর্মের কোন সম্পর্ক নাই। মোহাম্মদ ফাতেহ যা করেছিলেন তার পেছনে ধর্মীয় একটি ভবিষ্যদ্বাণী কাজ করেছিলো। কনস্টানটাইন দখল সম্পর্কে বলা হাদিস অনুযায়ী তিনি এটি দখল করেন। কিন্তু এরদোয়ান যা করলেন তার সঙ্গে আধ্যাত্মিক কোন ব্যাপার নাই। তুরস্ক অনেক চেষ্টা করেও যখন একটি কম্যুনিটিতে ঢুকতে ব্যর্থ তখন সে নিজের পরিচয় দৃঢ় করতে যা করার তা করত। এই রাজনীতির উপর ভিত্তি করেই এরদোগান ক্ষমতায় এসেছেন এবং নিজের জনপ্রিয়তা বাড়িয়েছেন। এমনকি রাশিয়া, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, গ্রিস, এবং ইউনেস্কো যে উদ্বেগ দেখাচ্ছে তাও কোন ধর্মীয় বিষয় নয়, তাও মূলত রাজনৈতিকই।

আবার দেশ-বিদেশের অনেক সাধারণ মুসলমান ও ইসলামি ব্যক্তিত্বদের দেখা যাচ্ছে তারা হায়া সোফিয়ায় যেয়ে নামাজ আদায় করার জন্য অপেক্ষা করছেন। এভাবে তারা খুব উৎসাহ দেখাচ্ছেন যা একজন মুসলমান হিসেবে আমার কাছে অযৌক্তিক। একজন মুসলমানের যদি কোথাও যেয়ে নামাজ পড়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা থাকে তাহলে তা তিনটি পবিত্র মসজিদ হওয়া উচিৎ- মসজিদুল হারাম, মসজিদুল নববী এবং মসজিদুল আকসা। এই তিনটি ছাড়া পৃথিবীর সব মসজিদের মর্যাদা একই। এটি নিয়ে এতো বাড়তি উত্তেজনার তাই কোন প্রয়োজন নাই। এরদোয়ান যেভাবে দেখাচ্ছেন অর্থাৎ, মোহাম্মদ ফাতেহর মত একে মুসলমানদের বিজয় হিসেবে দেখানোর কিছু নাই।

উনিশের দশকের মধ্যভাগ থেকে মুসলিম রাজনীতির যে ধারা দেখা যাচ্ছে যার প্রবক্তা মাওলানা মউদুদি ও সৈয়দ কুতুব, তা অনুযায়ী এধরণের ঘটনা খুব স্বাভাবিক এবং এমন ঘটনা সারা বিশ্বেই আরও ঘটতে থাকবে। বাংলাদেশেও ঘটার সম্ভাবনা আছে। এটা ঘটতে থাকবে ততদিন যতদিন একে মানুষ ক্ষমতায় যাওয়ার পাথেয় হিসেবে ব্যবহার করবে।’

একজন মুসলমান হিসেবে পাঁচশ-ছয়শ বছর ধরে ব্যবহৃত একটি মসজিদকে আবার মসজিদের রূপান্তর করায় আমি অবশ্যই আনন্দিত। কিন্তু একে ধর্মীয় বিজয় হিসেবে দেখার কোন যুক্তি আমি খুঁজে পাচ্ছি না। হায়া সোফিয়াকে মসজিদে রূপান্তর করায় যে জিহাদী জোস দেখা যাচ্ছে তা দেখে আমি চিন্তিত। এটি একদমই প্রাজ্ঞ আচরণ নয়।

একটি বিষয় বলতে হয় আর তা হল, আমাদের দেশে যেভাবে মসজিদ কাউকে ঢুকতে দেওয়া হয় না, ইসলামের নীতি তা সমর্থন করে না। হায়া সোফিয়ার পাশেই ব্লু মস্ক আছে যেখানে যে কেউ ঘুরতে যেতে পারে। নবীর (সঃ) শিক্ষাও তেমনই। তিনি বেঁচে থাকতে মদিনায় আর্মেনিয়ান খ্রিস্টানরা এসে ১৩ দিন থাকে। সেখানে তারা তাদের সানডে সার্ভিসও করে। কিন্তু আমরা তো সেগুলো ভুলতে বসেছি।’

শাহেদ আনাম খান বলেন, ‘বিশ্ব রাজনিতিতে তিনটি খুব ইন্টারেস্টিং তুর্কি টার্ম আছে- একটাকে আমরা মাঝে মাঝে বলি তুর্কি কাণ্ড বা ইয়াং টার্কস। এই তরুণ তুর্কিরা অটোমান ন্যাশনালিজমের প্রবক্তা। এরা পশ্চিমা দার্শনিক মন্টেস্কো, রুশো, হবসের রিপাবলিক মতবাদ দ্বারা উদ্বুদ্ধ। তুর্কি কাণ্ডের সাথে আসে অটোমানিজম। আর অটোমানজিমের সাথে আসে আমরা যেটা বলি কনস্পিরেসি থিওরি। কনস্পিরেসি থিওরির জেনুইন প্রবক্তাদের মধ্যে যারা আছে তারা হলো টার্কিশ। অর্থাৎ টার্কিতে কনস্পিরেসি থিওরির যে ভূমিকা- যে পর্যন্ত আপনি এই থিওরি নিয়ে না আসবেন আপনাকে খুব একটা অভিজাত হিসেবে গণ্য করা হবে না। এটাই সেখানকার বাস্তবতা। যেমন ইরানের বাস্তবতা সেখানে অভিজাত তকমা পেতে হলে আপনাকে জানতে হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘বর্তমানে প্রচলিত আরব মুসলিম, মসজিদে ঢোকা বা না ঢোকা, এগুলো সাম্প্রতিক বাস্তবতা। সম্ভবত ৩০ থেকে ৪০ বছর আগের। এগুলো হলো সালাফি বা ওহাবি এজেন্ডা। যেখানে পিউরিটান হওয়ার যে ফর্মটা আছে সেটা ডাইলিউট (মেশানো) করা হয়েছে। এটাই ফান্ডামেন্টালিজম বা মৌলবাদ। আবার যখন আপনি রিফর্ম করতে যান তখনই ওল্ড টেস্টামেন্ট-নিউ টেস্টামেন্ট- কন্ট্রাডিকশন, পাঁচ রকমের চার্চ হয়। আমাদের কিন্তু সেটা নাই, আমাদের যেটা আছে শিয়া বা সুন্নি বা আহমেদি নিয়ে বিতর্ক। এভাবেই ধর্মকে একেক জন একেকজনের মত করে ব্যবহার করেন।’

ফাহিম তানভীর আহমেদ বলেন, ‘ইসলাম আর ইসলামি রাজনীতি এক জিনিস না। এরদোগান এবং তার মত যারা আছে তারা রাজনীতিবিদ। আমাদের উপমহাদেশের মানুষের এই ঘটনা থেকে বুঝতে হবে যে এটি রাজনীতি যার সঙ্গে ইসলামের কোন সম্পর্ক নাই। তাই উত্তেজনার কোন কারণ নাই। তুর্কি জাতিয়তিায়বাদের জাগরণকেও ইসলামের বিজয় বলে ভাবার কোন কারণ নাই। কারণ, এর অনেক কিছুই ইসলামের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এসব কিছু মাথায় রেখে ঘটনাগুলোকে যৌক্তিকভাবে দেখতে ও বিবেচনা করতে হবে।

একজন ইসলামী বক্তা দেখলাম বলছেন, গুগল নাকি গুগল ম্যাপ থেকে প্যালেস্টাইন নাম মুছে দিয়েছে। কিন্তু গুগল একটি আমেরিকান কোম্পনি। আমেরিকা প্যালেস্টাইনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকার করে না। তাই সেখানে কখনও প্যালেস্টাইন ছিলই না। একইভাবে ছিল না কাশ্মীরও। এসব উত্তেজনার মধ্যে ধর্ম খুব একটা থাকে না। তাই আমাদের যেকোনো ঘটনায় উত্তেজিত হয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না।’

উল্লেখ্য, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর তুরস্কে অটোমান সাম্রাজ্য বা উসমানি সালতানাতের পতন হয় এবং ১৯২৪ সালে খিলাফত উচ্ছেদ করা হয়। তখন তুর্কি প্রজাতন্ত্রের প্রেসিডেন্ট মুস্তফা কামাল পাশা তুরস্কে সেক্যুলার বিপ্লব করেন এবং দেশটিকে একটি আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে পরিণত করেন। ১৯৩৪ সালে মুস্তফা কামাল পাশা অটোমান আমলের মসজিদ হায়া সোফিয়াকে জাদুঘরে পরিণত করেন।

ইসলামপন্থী একেএ পার্টি ক্ষমতায় আসার পর ২০০৫ সালে সর্বপ্রথম এ হায়া সোফিয়াকে মসজিদে রূপান্তরের দাবিতে পার্মানেন্ট ফাউন্ডেশন সার্ভিস টু হিস্টোরিকাল আর্টিফেক্টস অ্যান্ড এনভায়োরনমেন্ট অ্যাসোসিয়েশন নামক একটি সংগঠন আদালতে মামলা করে। মামলায় দাবি করা হয়, হায়া সোফিয়া সুলতান দ্বিতীয় মেহমুদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি। তিনি খ্রিস্টান পাদরিদের কাছ থেকে বায়তুল মালের অর্থে নয় বরং তার নিজস্ব তহবিল থেকে অর্থ ব্যয় করে স্থাপনাটি কিনে নেন। পরে সুলতান এটি মসজিদের জন্য ওয়াকফ করেন। সুতরাং একে মসজিদের পরিবর্তে জাদুঘর হিসেবে ব্যবহার অবৈধ। তবে ২০০৮ সালে আদালত এ মামলাটি খারিজ করে দেন। মামলা খারিজ হয়ে গেলেও একেএ পার্টি হায়া সোফিয়াকে মসজিদে পরিণত করার জন্য জনমত তৈরি চেষ্টা করে এবং ওই সংগঠনটি আবারও আদালতে মামলা করে। এর মধ্যে তুরস্কের অভ্যন্তরীণ প্রশাসনিক কাঠামোতে দৃঢ় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয় এরদোগানের।

২০১৬ সালে এরদোগানকে উৎখাতের এক ব্যর্থ ক্যুর পর তিনি প্রশাসনিক আদালতে তার আরও বেশি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন। এ মামলার পক্ষে নানা সময় মন্তব্য করেন প্রেসিডেন্ট এরদোগান। গত বছর এক বিবৃতিতে এরদোগান বলেছিলেন, হায়া সোফিয়াকে মসজিদ থেকে জাদুঘরে রূপান্তরিত করার সিদ্ধান্তটি একটি বড় ভুল ছিল। এক মাস আগে এরদোগান ১৫ জুলাই হায়া সোফিয়ায় নামাজ পড়ার প্রস্তাব দেন। এই তারিখটি এমন একটি তারিখ যা ২০১৬ সালে এরদোগানকে উৎখাতে এক ব্যর্থ ক্যু’র তারিখের সঙ্গে মিলে যায়।

১০ জুলাই হায়া সোফিয়াকে মসজিদের রূপান্তরের ঘোষণা দিয়ে এরদোগান বলেন, হায়া সোফিয়ায় সব ধর্মের মানুষরা প্রবেশ করতে পারবে।

সারাবাংলা/আইই/আরএফ

Tags: , , , , , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন