বিজ্ঞাপন

নীরব এক ঘাতক; বছরে কেড়ে নেয় ১৪ লাখ প্রাণ

July 28, 2020 | 12:32 pm

জুয়েল সরকার

বিজ্ঞাপন

নীরব এক ঘাতক; যা সারাবিশ্বে বছরে কেড়ে নেয় ১৪ লাখ প্রাণ। এই মারণ ঘাতকের নাম হেপাটাইটিস। শুনতে অবাক লাগলেও সত্য যে, বিশ্বব্যাপী প্রতি ১২ জনের একজন হেপাটাইটিস ‘বি’ বা ‘সি’ ভাইরাসে আক্রান্ত। আক্রান্ত ব্যক্তিদের অনেকেই জানেন না, তাদের শরীরে এই ভাইরাস আছে কি না কিংবা থাকলেও তা কী অবস্থায় আছে। না জানার কারণে আক্রান্ত ব্যক্তি ধীরে ধীরে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।

বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস আজ। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশেও দিবসটি পালিত হচ্ছে। ২০১০ সালে এই দিনটিকে বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস ঘোষনা করে ওয়ার্ল্ড হেলথ অ্যাসেম্বলি। চলতি বছরে দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘হেপাটাইটিস নির্মূলে আসুন খুঁজি, লক্ষ্য অজানা রোগী’। অন্যান্যবারের মতো এবারও দিবসটি পালনে ব্যাপক আয়োজন না থাকলেও ভার্চুয়াল সভা-সেমিনারের কর্মসূচি রয়েছে বিভিন্ন সংস্থার।

বিশেষজ্ঞরা জানান, দেশে প্রায় এক কোটি মানুষের বিভিন্ন টাইপের হেপাটাইটিস থাকলেও ৯০ শতাংশই তা জানতে পারেন না। যারা জানতে পারেন তাদের ও চিকিৎসা সুবিধা বাংলাদেশে খুবই কম। বাংলাদেশের প্রায় পাঁচ কোটি লিভার রোগীর চিকিৎসায় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক রয়েছেন প্রায় ১০০ জন, যাদের বেশিরভাগই ঢাকায় থাকেন। ফলে সারা দেশে লিভার রোগে আক্রান্তদের চিকিৎসা অনেকটাই দুরূহ। অথচ একটু সচেতন হলেই ভয়ংকর এই রোগ থেকে সহজেই দূরে থাকা যায়।

বিজ্ঞাপন

বৈজ্ঞানিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলাদেশে পাঁচ থেকে ছয় কোটি মানুষ হেপাটাইটিস ‘বি’ ভাইরাসে সংক্রমিত। তাদের মধ্যে ৮০ লাখ থেকে এক কোটি লোক ক্রনিক হেপাটাইটিস ‘বি’তে আক্রান্ত। আর এ দেশে হেপাটাইটিস ‘সি’ ভাইরাসে সংক্রমিত লোকের সংখ্যা প্রায় এক কোটি। এসব আক্রান্ত রোগীর অনেকেই জীবনের কোনো এক পর্যায়ে লিভার সিরোসিস বা লিভার ক্যান্সারের মতো মারাত্মক রোগের ঝুঁকিতে আছে। এছাড়া দেশে প্রায় ২৯ হাজার লোক প্রতিবছর হেপাটাইটিস ‘বি’ ও ‘সি’ ভাইরাসজনিত লিভার সিরোসিস অথবা লিভার ক্যান্সারে মৃত্যুবরণ করে। প্রকাশিত বৈজ্ঞানিক তথ্য অনুযায়ী শুধু হেপাটাইটিস ‘বি’ ভাইরাসে আক্রান্ত এ দেশের ১০ শতাংশ লোকের চিকিৎসা ব্যয় বছরে প্রায় ছয় হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ এককথায় হেপাটাইটিস ‘বি’ ও ‘সি’ বাংলাদেশের স্বাস্থ্য, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে খুবই বড় ধরনের সমস্যা।

ধারণা করা হচ্ছে, আগামী কয়েকবছরে এই মারণব্যাধি পৃথিবীতে আরো ভয়াবহ আকার ধারণ করবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, প্রতিবছর হেপাটাইটিসে আক্রান্ত হয়ে গড়ে ১৪ লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয়। বিশ্বে অন্তত ৪০০ মিলিয়ন মানুষ এই রোগে আক্রান্ত। তাদের অনেকেই জানেন না, তাদের শরীরে বাসা বেঁধেছে ছোঁয়াচে মারণব্যাধি। সংক্রামক হেপাটাইটিস থেকে লিভার সিরোসিস বা লিভার ক্যান্সারের মতো রোগও হতে পারে।

কয়েকটি কারণ ছাড়া হেপাটাইটিস মূলত হয় যকৃত বা লিভারে ভাইরাসের সংক্রমণের ফলে। হেপাটাইটিস এ, বি, সি, ডি এবং ই- এই পাঁচটি ভাইরাস চিহ্নিত করা গেছে। হেপাটাইটিস- এ এবং ই সংক্রমিত হয় দূষিত খাদ্য ও পানীয় গ্রহনের মাধ্যমে। আর হেপাটাইটিস- বি, সি এবং ডি সংক্রমিত হয় রক্তের মাধ্যমে। যকৃতের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ রক্তের লোহিত রক্তকণিকার আয়ুষ্কাল শেষ হলে তার অন্তর্গত হলুদ রঙের বিলিরুবিনকে দেহ থেকে নিষ্কাশিত করা। হেপাটাইটিসের ফলে যকৃতের স্বাভাবিক কাজ ব্যাহত হওয়ার জন্য রক্তে বিলিরুবিনের পরিমাণ বেড়ে দেহ হলদেটে হয়ে যায়।

বিজ্ঞাপন

ইতিহাস বলছে, হেপাটাইটিস বিষয়টি প্রথম পাওয়া যায় তিন হাজার বছর আগে সুমেরীয় সভ্যতায়। সেখানে পোড়ামাটির ফলকে পাওয়া গিয়েছিল জন্ডিস রোগের বর্ণনা। চিকিৎসাবিজ্ঞানের জনক হিপোক্রেটিসই প্রথম ৪০০ খ্রিস্টপূর্বে হেপাটাইটিসের নিখুঁত বর্ণনা দিয়েছেন। ১৮৬১ সালে আমেরিকার গৃহযুদ্ধে হেপাটাইটিসে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৫২ হাজার এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হেপাটাইটিসের বলি হন এক কোটি ষাট লক্ষ মানুষ।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত হেপাটাইটিসের কারণ বিজ্ঞানীদের কাছে ছিলো অজানা। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে এসে হেপাটাইটিস বিষয়ে বিস্তর পর্যালোচনা ও গবেষণা হয়। ১৯৬৩ সালে হেপাটাইটিস-বি ভাইরাস আবিষ্কার করেন জেনেটিক বিজ্ঞানী বারুচ স্যামুয়েল ব্লুমবার্গ। তিনি বিভিন্ন অসুখের জিনগত সংবেদনশীলতা পরীক্ষা করছিলেন। কাকতালীয়ভাবে এক অস্ট্রেলীয় আদিবাসীর রক্ত পরীক্ষার সূত্রে আবিষ্কার করে ফেলেন হেপাটাইটিস-বি ভাইরাস। নাম দিয়েছিলেন অস্ট্রেলিয়ান অ্যান্টিজেন। তার দুই বছর পরে মাইক্রোবায়োলজিস্ট মিলম্যানের সাথে যুক্ত হয়ে আবিষ্কার করেন হেপাটাইটিস বি-এর ভ্যাকসিন। হেপাটাইটিস-এ, হেপাটাইটিস-ডি, হেপাটাইটিস-সি এবং হেপাটাইটিস-ই ভাইরাস আবিষ্কৃত হয় যথাক্রমে ১৯৭০, ১৯৭৭, ১৯৮৯ এবং ১৯৯০ সালে। ব্লুমবার্গ তার আবিষ্কারের জন্য ১৯৭৬ সালে নোবেল পুরস্কার পান। এরপর ২০১০ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার উদ্যোগে চিকিৎসক ব্লুমবার্গের জন্মদিন ২৮ জুলাই বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

দিবস পালিত হলেও আমাদের দেশে হেপাটাইটিস ‘বি’ ও ‘সি’ ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের জন্য সুখবর খুব একটা নেই। সবচেয়ে বড় হতাশার জায়গাটা হচ্ছে এই যে এখন পর্যন্ত হেপাটাইটিস ‘বি’ ও ‘সি’ ভাইরাসে আক্রান্ত ১০ শতাংশ মানুষও জানে না তারা এই ভাইরাসগুলোতে আক্রান্ত। এরই মধ্যে সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোলের অন্যতম লক্ষ্য হিসেবে ২০৩০ সালের মধ্যে হেপাটাইটিস ‘বি’ ও ‘সি’ ভাইরাস নির্মূলের টার্গেট নির্ধারণ করা হয়েছে।

আজ এই কোভিড-১৯ প্রেক্ষাপটে এই দিবসের গুরুত্ব অনেক বেশি। কভিড আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে যে এটি দেখা যায় না, ছোঁয়া যায় না—এমন অদৃশ্য ভাইরাস কিভাবে গোটা পৃথিবীকে থমকে দিতে পারে। রাতারাতি কিভাবে বদলে যেতে পারে আমাদের জীবনযাত্রা। কোভিড সংক্রমণে এই দেশে এ পর্যন্ত আমরা আড়াই হাজারের কিছু বেশি মানুষকে হারিয়েছি। অথচ হেপাটাইটিস ‘বি’ ও ‘সি’ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে প্রতিবছর শুধু বাংলাদেশে মৃত্যুবরণ করে আরো অনেক বেশি মানুষ। বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবসের মূল প্রতিপাদ্যই হচ্ছে এই রোগগুলো সম্পর্কে ব্যাপক জনসচেতনতা সৃষ্টি এবং পাশাপাশি সরকারি ও বেসরকারি খাতের ঘনিষ্ঠ সহযোগিতার মাধ্যমে ভাইরাস দুটিকে পৃথিবী থেকে পাকাপাকিভাবে বিদায় করা। আর আমাদের তা করতে হবে শুধু এসডিজি গোল অর্জনের তাগিদ থেকে নয়, বরং নিজেদের তাগিদেও। তা না হলে কোভিডের চেয়েও বড় কোনো দুর্যোগ যে আসবে না, তা কেউই নিশ্চিত করে বলতে পারে না।

বিজ্ঞাপন

লেখক: গবেষক, উন্নয়নকর্মী

সারাবাংলা/এসবিডিই

প্রিয় পাঠক, লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই ঠিকানায় -
sarabangla.muktomot@gmail.com

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত মতামত ও লেখার দায় লেখকের একান্তই নিজস্ব, এর সাথে সারাবাংলার সম্পাদকীয় নীতিমালা সম্পর্কিত নয়। সারাবাংলা ডটনেট সকল মতাদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তবে মুক্তমতে প্রকাশিত লেখার দায় সারাবাংলার নয়।

Tags:

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন