বিজ্ঞাপন

‘সবাইকে শেখাই কীভাবে নিজের শরীর পরীক্ষা করতে হবে’

March 8, 2018 | 2:36 pm

[আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে সারাবাংলার আয়োজনে গত ৬ মার্চ ২০১৮ তে অনুষ্ঠিত হয় বিশেষ আড্ডা ‘আমাদের গল্প’। এতে অংশ নেন বিভিন্ন অঙ্গনে খ্যাতি ও প্রতিষ্ঠা পাওয়া সাতজন সফল নারী। তাঁরা তাদের পরিবারে বেড়ে ওঠা, পেশাগত জীবনে পদার্পণ, নানা প্রতিকূলতা পেরিয়ে নিষ্ঠা-একাগ্রতার সঙ্গে কাজ করা, পারিবারিক ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিতে পেশা কিংবা ব্যক্তি জীবনের মূল্যায়নসহ নানা বিষয় আড্ডায় তুলে ধরেন। প্রায় চার ঘণ্টার ওই আড্ডায় অংশগ্রহণকারীরা একে অন্যের প্রশ্নের উত্তর দেন প্রাণখুলে। আড্ডায় তাঁদের বক্তব্য আজ সারাবাংলার পাতায় প্রকাশ করা হল]

বিজ্ঞাপন

।। তাহমিনা গাফফার ।।

২০০২ সালে আমার ব্রেস্ট ক্যানসার ধরা পড়ে।  আর ২০০৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বোম্বের টাটা হসপিটালে অপারেশন হয়।  সকালে অপারেশন হল আর বিকেলের দিকে এনেস্থেশিয়ার ঘোরের মাঝেই বুঝতে পারলাম সুন্দর করে সাজগোজ করা কয়েকজন নারী আমার রুমে ঢুকল।  তাদের আসা যাওয়া বুঝতে পারলেও জিজ্ঞাসা করার শক্তি ছিল না যে ওরা কারা।

আমার স্বামী ওদের সাথে কথা বলেছিলেন। আমার চেতনা ফিরে আসলে দেখি আমার রুমের টেবিলের উপর খুব সুন্দর একটা ফুলের তোড়া রাখা। আমার স্বামীকে জিজ্ঞাসা করি যে ফুল কে দিল। আমাদের তো এখানে কোন আত্মীয়স্বজন নাই। তখন জানলাম যে ক্যানসার রোগীদের একটা সাপোর্ট গ্রুপ এসেছিল আর ফুলও ওরাই এনেছে। ওদের মাঝে এক একজন ক্যানসার অপারেশনের পরে দশ থেকে পনেরো বছর ধরে সুস্থ আছেন। আমার স্বামীর চেহারায় খুশির ঝলক দেখতে পেলাম। কারণ, আমরা তখনও জানতাম না যে ক্যানসার হলে কেউ বাঁচে না। আমি হয়ত বেঁচে থাকব এই আশায় সেই খুশির অশ্রু।

বিজ্ঞাপন

চিকিৎসকরা আমাদের অনেকবার বলেছে যে অপারেশনের পরে ক্যানসার রোগীরা বেঁচে থাকে কিন্তু তখন বিশ্বাস করতে পারিনি। তবুও বেঁচে থাকার ক্ষীণ আশা নিয়েই বোম্বে গিয়েছিলাম অপারেশন করতে।

আসলে হয় কি, চিকিৎসকের চাইতে আমরা বেশি বিশ্বাস করি অন্য মানুষের কথা, বই এর কথা, চলচ্চিত্রের কথা। এখন পর্যন্ত আমি এমন একটা চলচ্চিত্রও দেখিনি যেখানে কোন ক্যানসার রোগী সুস্থ হয়েছে। চলচ্চিত্রে দেখা যায় ক্যানসার রোগীদের আস্তে আস্তে চোখের নীচে কালি পড়ে যাচ্ছে, মারা যাচ্ছে।

 

বিজ্ঞাপন

 

আমি মনে করি চলচ্চিত্র একটি বড় জায়গা। চলচ্চিত্রে যা দেখানো হয় তা চোখের সামনে ভেসে ওঠে, তাই এটি জনগণের আস্থার জায়গা। মানুষ চলচ্চিত্রে যা দেখানো হয় তা বিশ্বাস করে ফেলে। কিন্তু আমি আমার ভাষায় এমন কোন চলচ্চিত্র দেখিনি যেখানে একজন ক্যানসার রোগী সুস্থ হয়েছেন। যাই হোক চলচ্চিত্রে না পেলেও আমি জাহানারা ইমামের লেখা ‘ক্যানসারের সাথে বসবাস’ বইটা পড়লাম।

আসলে এর আগে আমি ক্যানসার বিষয়টাকে ভয় পেতাম। খবরের কাগজে ক্যানসারের কথা আসলে এড়িয়ে যেতাম। এয়ারপোর্ট বা কোথাও ক্যানসার রোগীর জন্য দানবাক্স দেখলে চোখ উলটে নিতাম। ক্যানসার রোগীদেরও ভয় পেতাম। সেই আমি যখন ওনার বইটি পড়ি তারপর আতঙ্কে বারবার করে নিজের মুখ, দাঁত দেখতাম। দন্ত চিকিৎসকের কাছে যেয়ে বার বার বলতাম আমার মুখের ভেতর পরীক্ষা করে দেখে যেন আমার মুখের কোথাও ক্যানসার আছে কিনা। এক পর্যায়ে দাঁতের চিকিৎসকের কাছে যাওয়াই বন্ধ করে দিলাম। কারণ ভাবছিলাম, আমাকে যে করেই হোক এই আতঙ্ক থেকে মুক্তি পেতে হবে। অথচ সেই আমারও জাহানারা ইমারের মত ক্যানসারের সাথে বসবাস শুরু হল।

বিজ্ঞাপন

তো যাই হোক, ফিরে যাই পুরনো কথায়। ফুলের তোড়াটা দেখে আমার মনে হল আমাদের দেশে কেন এরকম কোন গ্রুপ নাই। থাকলে আমিও আমার ক্যানসার ধরা পড়ার সময়টায় মানসিক জোর পেতাম।

সেই যে ব্যাংকক হাসপাতালে চিকিৎসকদের পরীক্ষানিরীক্ষায় লাম্প ধরা পড়ল। বায়োপসি করার পরে সেই লাম্প যে ক্যানসার তাও ধরা পড়ল। ওখানকার চিকিৎসক তখন জিজ্ঞাসা করল আমার স্বামী কী করেন। তিনি একজন সরকারি চাকরিজীবী শুনে বললেন এখানে ঘটিবাটি বিক্রি করেও চিকিৎসা চালাতে পারবেন না। তারপর ওনারাই ভারতের টাটা হাসপাতালে যেতে বললেন। আমি, আমার স্বামী আর আমার ছেলে তিনজন গিয়েছিলাম স্বাস্থ্য পরীক্ষা করাতে। সবাই সুস্থ, মাঝখান দিয়ে আমার ক্যানসার ধরা পড়ল। আর সেবারই জীবনে প্রথমবারের মত বোম্বের টাটা হাসপাতালের নাম শুনলাম।

আজ আমাকে এখানে আনা হয়েছে ক্যানসার সারভাইভার হিসেবে। এটা সত্যিই দারুণ ব্যাপার। আমার যখন ক্যানসার ধরা পড়ে, সেই ২০০২ সালে এসব চিন্তাও করিনি। এখন তো এরকম নানা অনুষ্ঠান হয় আমাদের নিয়ে। ক্যানসার নিয়ে সচেতনতাও বেড়েছে। পেপারে অনেক কথা লেখা হয়, টিভিতে অনেক প্রোগ্রাম হয় ক্যানসার বিষয়ক।

অপারেশনে পরে যে যুদ্ধ শুরু হল তার আসলে কোন তুলনাই নাই। কারও পরিবারে ক্যানসার রোগী থাকলে সে জানে কী রকম সেই যুদ্ধ। কেমো থেরাপির পরে মনে হত সারা শরীরে কেউ আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে। এক মুহূর্তের জন্যও এসি বন্ধ করতে পারতাম না। ভীষণ কষ্ট আর যন্ত্রণার সেই দিনগুলোতে কেউ কেউ আমাকে দেখতে আসার কথা বলত। কেউ কেউ জিজ্ঞাসা করত আমার কী খেতে ইচ্ছা করে। কি যে কঠিন সেই প্রশ্ন। যেকোন সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ বুঝতে পারে কেন সেই প্রশ্ন। আমার বাসায় ঢুকে অনেকে এক গ্লাস পানিও খেতে চাইত না। তারা যে ক্যানসারকে ছোঁয়াচে ভেবে এমন করছে তার সবই বুঝতাম কিন্তু কিছুই বলতে পারতাম না। কিন্তু আমি এরকম আচরণকে তাদের অপরাধ বলিনা। কারণ, এটা যে ছোঁয়াচে না সেটাই তো তারা জানত না। সবাইই সুস্থ থাকতে চায়। তাই বুঝে না বুঝেই এমন করে।

তো যাই হোক, এরকম পরিস্থিতির মধ্যে দিন কাটাতে থাকলাম। একে একে ছয়টা কেমোথেরাপি দেওয়া হল। আমি কারও সাথে স্বাভাবিক হতে পারতাম না। দিনের পর দিন হাসতাম না, কথা বলতাম না। নিজেকে মনে হত ফাঁসির আসামী যে ফাঁসির দড়ি গলায় ওঠার অপেক্ষায় আছে।

অপরাজিতা সোসাইটি এগেইনস্ট ক্যানসার তখন মাত্র নয়জন ক্যানসার রোগীদের অসংগঠিত একটা সংস্থা। এই সংস্থার সদস্যরা নিজেরা নিজেরা চিকিৎসার প্রয়োজনে বোম্বে যাওয়া আসা করত। আসা যাওয়ার পথেই একে অন্যের সাথে পরিচিতি বাড়ে ও ঘনিষ্ট সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সেই নয়জনের সাথে আমিও যুক্ত হলাম। অবাক হয়ে দেখলাম সেই নয়জন হাসে, গল্প করে। শাড়ি কেনে গয়না কেনে। আমি ভাবতাম ওরা শাড়ি কেনে কখন আর পরেই বা কখন। আমিও তখন এই দলের সাথে মিশে মিশে স্বাভাবিক হতে শুরু করলাম। হাসতে লাগলাম, গল্প করতে লাগলাম, পেলাম বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা।

আমার স্বামী আর সন্তানরাও এটা বিশ্বাস করতে শুরু করে যে আমি বেঁচে থাকব। কারণ এতদিন আমার মত আমার পরিবারও আমার বেঁচে থাকার আশা ছেড়ে দিয়েছিল। সেরকম পরিস্থিতি থেকে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসলাম। বেঁচে থাকার সত্যিকার সংগ্রাম যেন তখনই শুরু হল। সেখান থেকে আমরা কাজ শুরু করলাম।

অপরাজিতার সাথে কাজ করতে গিয়ে নানারকম অভিজ্ঞতা হল। অনেক শিক্ষিত পরিবারে দেখলাম চিকিৎসা শেষ না করেই অনেক ক্যানসার আক্রান্ত নারীদের ছেড়ে চলে যাচ্ছে তাদের স্বামীরা। কি অমানবিক একটা ব্যাপার। অপরাজিতায় এসে এরকম বিষয় আমাকে ভীষণভাবে নাড়া দিল। আমি তখন এরকম স্বামীদের বোঝাতে চেষ্টা করলাম যে আমি আজ পর্যন্ত কোন নারীকে দেখিনি তার ক্যানসার আক্রান্ত স্বামীকে ছেড়ে চলে গেছে। আপনি কেন চলে যাবেন। এই অসুখটা তো আপনারও হতে পারত। উনি তো কোথাও থেকে নিয়ে আসেননি এই অসুখ, কোন অভিশাপও নয় এটা। কোন অপরাধের শাস্তিও নয়, এটা একটা অসুখ। আপনার অসুস্থ স্ত্রীকে ছেড়ে যাওয়া আপনার উচিৎ হবে না। এভাবে বুঝিয়ে কতজনকে ঠিক করতে পেরেছি তা জানিনা।

 

 

আবার এমনও অনেক স্বামীকে পেয়েছি যাদের স্তন ক্যানসার আক্রান্ত স্ত্রীরা সারাক্ষণ ভয়ে থাকে তাদের স্বামীরা হয়ত আরেকটা বিয়ে করবে। একবার স্কয়ার হাসপাতালে এমন এক রোগীকে পেলাম যে তার স্বামী কারও সাথে কথা বললেই ভাবছিল যে সে হয়ত বিয়ের কথা বলছে। এমনকি আমিও তার স্বামীর সাথে কথা বললে ক্ষেপে যাচ্ছিল। সে ভাবছিল আমিও হয়ত তাকে কোন পাত্রীর সন্ধান দিচ্ছি। এই যে অবিশ্বাস তা এসেছে ব্রেস্ট ক্যানসারের কারণে নারীটির অঙ্গহানির কারণে। আমি তখন সেই নারীটিকে বোঝাতে সক্ষম হই যে তার স্বামী আমাদের সাথে স্ত্রীর রোগ, চিকিৎসা এসব নিয়েই কথা বলছেন, অন্য কিছু না।

এরকম ছোট ছোট সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে আমরা বিভিন্ন কলেজে যাই, গার্মেন্টস এ যাই নারীদের সচেতন করতে, ক্যানসার কীভাবে নিজে নিজে পরীক্ষা করবে তা শেখাতে।

এতসব করি কারণ আমি মনে করি বেঁচে থাকার একটা দায়বদ্ধতা আছে আমাদের। সেই দায়বদ্ধতা থেকেই মানুষকে ব্রেস্ট ক্যানসার বিষয়ে সচেতন করি। সচেতন করা ছাড়াও আমরা গরীব রোগীদের পাশে অর্থ সাহায্য নিয়ে দাঁড়াতে চেষ্টা করি। আমাদের ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা ছিল বাঁচব কিনা তা ভেবে। কিন্তু সাত আট বছরের শিশুকেও পেয়েছি যে জানেনা একটা কেমোর পরের কেমোটা সে দিতে পারবে কিনা। সে আমাদের দিকে অসহায় চোখে তাকিয়ে থাকে সাহায্যের আশায়। আমরা অপরাজিতার মাধ্যমে যতটুকু পারি গরীব রোগীদের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।

অপরাজিতার প্রত্যেক সদস্য এসব এত কাছ থেকে দেখেছি যে এখন নিজেদের জন্য কিছু কিনতে গেলেও থমকে যাই। মনে হয় এক কেজি আপেলের দামও যদি জোগাড় করতে পারি তাহলে একজন গরীব ক্যানসার রোগীর কাছে পৌঁছে দিতে পারি।

অনেকে বলে যে আমরা কীভাবে এত মানুষের সামনে ব্রেস্ট ক্যানসার বা ইউটেরাস ক্যানসারের কথা বলি। এগুলো চেক করার কথাই বা কীভাবে বলি। আমি তখন বলি যে নারীর স্তন বা ইউটেরাস আছে। একজন নারীকে অবশ্যই শিখতে হবে কীভাবে নিজের শরীর পরীক্ষা করতে হবে যে তার আদৌ ক্যানসার আছে কিনা। কারণ আগে থাকতে ধরা পড়লে সুস্থ থাকার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।

অনেক পরিবার আছে যারা অর্থাভাবে পরীক্ষা নিরীক্ষা বা চিকিৎসা করাতে পারেনা। কিন্তু অনেক স্বচ্ছল পরিবারে এমন নারীও পেয়েছি যারা নিজেরাই পরীক্ষা করাতে চায়না। কাউকে কেউ জোর করে পরীক্ষা করাতে পাঠাবে এমন ভাবা ঠিক না। আমাদের নারীদেরই এগিয়ে আসতে হবে নিজের শরীর পরীক্ষা করতে।

আমি যেমন ভাবতাম আমার কেন ক্যানসার হবে, এত ভালোভাবে থাকার পরেও। চিকিৎসক যখন বলল লাম্প আছে তখন আমিও হাত দিয়ে দেখলাম যে আসলেই আছে। অথচ আমি জানতামই না যে কীভাবে নিজের শরীর পরীক্ষা করে। তাই আমি কোথাও গেলে পাশের নারীটিকে বলি যে আমার ব্রেস্ট ক্যানসার হয়েছিল আর আমি বেঁচেও আছি। তারা অনেকেই অবাক হয়। কিন্তু আমি পিছু হটিনা আর সবাইকে শেখাই কীভাবে নিজের শরীর পরীক্ষা করতে হবে। অনেকে আমাকে ছেলেমেয়ের বিয়ের সময় আমার ক্যানসার লুকোতে বলেছে। আমি লুকোইনি বরং সবার আগেই বলেছি যে আমার ক্যানসার হয়েছিল আর এখন আমি সুস্থ। আমি সবাইকে সচেতন করতেই নিজের ক্যানসারের কথা বলি আর সচেতন করি।

আপনারা সবাই সুস্থ থাকেন, ভালো থাকেন। ধন্যবাদ।


যদি পুরুষ নির্মাতা হতাম, পরিচিতি অনেক বেশি হত

অধিকার আদায়ের জন্যে বলতে গেলে যুদ্ধ করতে হয়েছে

লজ্জা তো আমার না, লজ্জা তো তোদের, সমাজের

নারী নয়, নিজেকে মানুষ হিসেবে ভাবতে পারাটা খুব জরুরি

মেয়েরা এখন আর দাঁতে দাঁত চেপে নির্যাতন সহ্য করে না

মানুষ হতে পেরেছে এমন পুরুষের সংখ্যা খুবই কম

অনুলেখন: রাজনীন ফারজানা

সারাবাংলা/এসএস

 

 

Tags: , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন