বিজ্ঞাপন

‘দ্বিধাহীন মুক্তিযোদ্ধা’ লতিফুলের বিদায়

July 29, 2020 | 5:24 pm

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট

চট্টগ্রাম ব্যুরো: একাত্তরের রণাঙ্গনের সম্মুখসারির যোদ্ধা অবসরপ্রাপ্ত মেজর লতিফুল আলম চৌধুরী মারা গেছেন, যিনি পরবর্তীতেও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নিয়ে আলোচিত ছিলেন। তার মৃত্যুতে শোকের ছায়া নেমে এসেছে চট্টগ্রামে।

বিজ্ঞাপন

পঁচাত্তরে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও জাতীয় চার নেতাকে হত্যার পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে প্রতিবাদী অবস্থান নিয়ে আলোচিত ছিলেন এই সেনা কর্মকর্তা। তার ঘনিষ্ঠজনদের মতে, এজন্য পঁচাত্তর পরবর্তী সামরিক সরকারের আমলে তাকে নানাভাবে নির্যাতিত হতে হয়েছিল। এক ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থানে সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান মারা যাবার পর লতিফুলকে ‘সেনা বিদ্রোহের’ জন্য অভিযুক্ত করে দণ্ড দেওয়া হয়েছিল, যদিও এটি ‘প্রহসনের বিচার’ হিসেবে বর্ণিত হয়েছে বিভিন্ন গবেষকের লেখায়।

চট্টগ্রাম সেনানিবাসে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মঙ্গলবার (২৮ জুলাই) রাত সোয়া একটায় এই মুক্তিযোদ্ধার জীবনাবসান হয়েছে। প্রয়াত লতিফুল আলম চৌধুরীর সহধর্মিণী অধ্যাপক শিরীণ আখতার বর্তমানে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি এক ছেলে ও এক মেয়ে রেখে গেছেন।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর রবিউল হাসান ভূঁইয়া সারাবাংলাকে জানান, লতিফুল আলমের বয়স হয়েছিল ৭১ বছর। গত ১৩ জুলাই তার শরীরে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শনাক্ত হয়। সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে ভর্তির একসপ্তাহ পর করোনা নিগেটিভ আসে। তবে এর মধ্যেই তিনি নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হন। ডায়াবেটিস ও কিডনির সমস্যা ছিল। এছাড়া তিনি স্মৃতিভ্রংশ রোগেও আক্রান্ত ছিলেন।

বিজ্ঞাপন

বুধবার সকাল ১১টায় চট্টগ্রাম সেনানিবাসে তার প্রথম দফা জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। বাদ জোহর নগরীর গরীবউল্লাহ শাহ মাজার প্রাঙ্গণে আরেকদফা জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর প্রথমে সামরিক মর্যাদা ও পরে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সম্মান জানানো হয় প্রয়াত এই মুক্তিযোদ্ধাকে। গরীবউল্লাহ শাহ মাজারেই তাকে দাফন করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রক্টর।

লতিফুল আলম চৌধুরীর পরিবারের ঘনিষ্ঠজন চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘ষাটের দশকে লতিফ ভাই চট্টগ্রাম কলেজে ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তিনি সামনের কাতারের ছাত্রলীগ নেতা ছিলেন। পরে সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। সম্মুখসারিতে থেকে মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। বিভিন্ন অপারেশনে অংশ নিয়েছেন। তবে পঁচাত্তরে জাতির জনককে হত্যার পর লতিফ ভাইকে সামরিক শাসক জিয়া ও এরশাদের রোষানলে পড়ে নানা নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে।’

‘লতিফ ভাই শুধু একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন না, তাকে আমি একজন দ্বিধাহীন মুক্তিযোদ্ধা বলব। পঁচাত্তরের পরে সেনাবাহিনীতে যে ক’জন মুক্তিযোদ্ধা অফিসার বঙ্গবন্ধু হত্যা, জাতীয় চার নেতা হত্যা, ক্যু পাল্টা ক্যু, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন, লতিফ ভাই তাদের মধ্যে অন্যতম বীরসন্তান। এজন্য উনাকে ষড়যন্ত্রের শিকার হতে হয়েছে। জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে উনাকে ফাঁসিয়ে দেওয়া হয়। প্রহসনের বিচারে উনার সাজা হয়। তবে এত নির্যাতনের পরও তিনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে বিন্দুমাত্র আপস করেননি।’ বলেন মফিজুর রহমান

বিজ্ঞাপন

১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রামে এক সেনা অভ্যুত্থানে নিহত হন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। সেই অভ্যুত্থানের পর গঠিত সামরিক আদালতে অন্যতম অভিযুক্ত হিসেবে ১০ বছরের সাজা হয়েছিল লতিফুলের। অভিযুক্তদের পক্ষে আইনি কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করেছিলেন তৎকালীন লে. কর্নেল সৈয়দ মুহাম্মদ ইব্রাহীম, মেজর জেনারেল হিসেবে অবসরে গিয়ে যিনি এখন বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন।

সেই বিচারের বিষয়ে জানতে চাইলে সৈয়দ মুহাম্মদ ইব্রাহীম সারাবাংলাকে বলেন, ‘বিচারটা হয়েছিল বিদ্রোহের, জিয়াউর রহমান হত্যার নয়। একটা বিদ্রোহ হয়েছিল এটা যেমন সত্য, আবার অভিযুক্ত সকলেই যে জড়িত ছিলেন না এটাও সত্য। একটা কঠিন স্পর্শকাতর সময় তখন আমরা পার করেছি। সেখানে বিচার যে শতভাগ নিশ্চিত হয়েছে এটা বলা যাবে না। আবার বিচার হয়নি, এটাও বলা যাবে না। এই ধরনের প্রক্রিয়ায় অনেক নির্দোষ ব্যক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যায়। মেজর লতিফুল ইসলামের সঙ্গে আমার অনেক স্মৃতি। তার স্মৃতির প্রতি আমি গভীর শ্রদ্ধা জানাচ্ছি এবং তার রুহের মাগফেরাত কামনা করছি।’

সামরিক শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ক্ষমতা নেওয়ার পর ১৯৮৩ সালে গ্রেফতার হয়ে লতিফুলের সঙ্গে একই কারাগারে একই কক্ষে ছিলেন সিপিবি, চট্টগ্রাম নগর শাখার সংগঠক অধ্যাপক অশোক সাহা। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘লতিফ ভাই যখন ছাত্রলীগ করতেন তখন থেকে চিনতাম। উনি হৃদয়ে মুক্তিযুদ্ধকে ধারণ করতেন। কারাগারে লতিফ ভাইয়ের সঙ্গে আমার দীর্ঘ আলাপ হয়। উনি আমাকে বলেছিলেন, জিয়াউর রহমান হত্যার পর সেনা বিদ্রোহের অভিযোগে উনাকে ফাঁসানো হয়েছিল। শুধুমাত্র মুক্তিযোদ্ধা অফিসার বলেই উনাকে ষড়যন্ত্রের শিকার হতে হয়েছিল। বাস্তবে তিনি এর সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। আমরা যারা রাজনৈতিক কারণে গ্রেফতার হয়েছিলাম, তাদের কিছুদিন পর ছেড়ে দেওয়া হয়। কিন্তু লতিফ ভাই সাতবছর জেল খেটেছেন। একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে লতিফ ভাইয়ের প্রাপ্য এটা ছিল না! এটা খুবই দুঃখজনক।’

লতিফুল ইসলাম চৌধুরীর মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এছাড়া শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল, চট্টগ্রাম নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন, নগর মহিলা লীগের সভাপতি হাসিনা মহিউদ্দিন গভীর শোক প্রকাশ করেছেন।

বিজ্ঞাপন

সারাবাংলা/আরডি/এমআই

Tags: , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন