বিজ্ঞাপন

বঙ্গবন্ধু, মানুষ কেমন ছিলেন?

August 1, 2020 | 1:44 pm

হাসান মোরশেদ

চরিত্র নির্মাণ ও চরিত্র হনন রাজনীতির একটি পুরনো কৌশল। রাজনীতির প্রয়োজনে অনেক চরিত্র নির্মিত হয়, রাজনীতির স্বার্থে অনেকের চরিত্র হননের চেষ্টাও করা হয়।

বিজ্ঞাপন

যেমন- বঙ্গবন্ধু পুত্র মুক্তিযোদ্ধা ও তরুণ রাজনীতিবিদ শেখ কামালকে ব্যাংক ডাকাত ও নারী অপহরণকারী হিসেবে প্রচার করা হয়েছে দীর্ঘ সময় ধরে। দীর্ঘ সময় ধরেই এই প্রচারণা বিশ্বাস করেছেন এদেশের বহু মানুষ। জনমানসে ’৭৫ এর নির্মম হত্যাকাণ্ডের গ্রহণযোগ্যতা করার অনেকগুলো প্রকল্পের একটি ছিলো শহীদ শেখ কামালের চরিত্রহনন। পরবর্তীতে বস্তুনিষ্ঠ অনুসন্ধান, তথ্য ও যুক্তির ভিত্তিতে প্রমাণিত হয়েছে এই প্রচারণা সবৈব মিথ্যা।

একইভাবে ’৭৫ এর খুনিদের চরিত্র নির্মাণ করার চেষ্টা করা হয়েছে তদেরকে ‘সূর্য সৈনিক’ আখ্যা দিয়ে। হত্যাকাণ্ডের পর অনেক রাজনীতিবিদের কথায় ও পত্রিকায় এই খুনিদের এভাবে গৌরবান্বিত করার চেষ্টা করা হয়েছে, কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ সে চেষ্টা ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছে।

সরাসরি এরকম চেষ্টার বিপরীতে সূক্ষ্মভাবেও নির্মাণ ও হননের কৌশল ক্রিয়াশীল থাকে। যেমন— বলা হয়, বর্ষীয়ান নেতা মওলানা ভাসানী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক গুরু ছিলেন, বঙ্গবন্ধু তার শিষ্য ছিলেন। এই ধারণা দিয়ে একদিকে মওলানা ভাসানীর চরিত্র নির্মাণ করা হয়, অপরদিকে বঙ্গবন্ধুর চরিত্র হনন করা হয়। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় বঙ্গবন্ধু কখনোই মওলানা ভাসানীর রাজনৈতিক শিষ্য ছিলেন না, ১৯৪৯ এর আগে মওলানা ভাসানির সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর দেখা হওয়ারই কোনো তথ্য নেই। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধু যখন কলকাতায় ছাত্র নেতা, মওলানা ভাসানী তখন আসাম মুসলিম লীগের সভাপতি— বাংলার রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্কহীন। ১৯৪৯ এ যখন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠিত হয়— সভাপতি মওলানা ভাসানী, বঙ্গবন্ধু প্রতিষ্ঠাতা যুগ্ম সম্পাদক। ১৯৫৭ সাল পর্যন্ত আট বছর তারা রাজনৈতিক সহকর্মী মাত্র— এর পর থেকে ১৯৭৫ পর্যন্ত দীর্ঘ আঠারো বছর তারা ভিন্ন রাজনীতির মানুষ, সেই রাজনীতি প্রায়ই বিপরীত মুখী, সাংঘর্ষিক। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক গুরু যদি কেউ থাকেন তিনি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, যদিও পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক অধিকারের প্রশ্নে সোহরাওয়ার্দীর সাথেও কখনো কখনো তার মতবিরোধ হয়েছে। ১৯৬৩ সালে সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একক মহিমায় নিজেকে নিয়ে গেছেন সর্ব্বোচ্চ পর্যায়ে, বাংলার রাজনীতিকেও পৌঁছে দিয়েছেন স্বায়ত্তশাসন থেকে স্বাধিকার হয়ে স্বাধীনতার চূড়ান্ত পরিণতিতে।

বিজ্ঞাপন

বেশ অনেকদিন থেকেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের এক ধরণের চরিত্র নির্মাণের চেষ্টা করা হচ্ছে যা আসলে নির্মাণের নামে হরণ মাত্র। প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করা হচ্ছে— বঙ্গবন্ধু নেতা হিসাবে অনেক বড় মাপের হলেও তিনি যতোটা দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ও কৌশলী ছিলেন, এর চেয়ে বেশি আবেগি ছিলেন।

‘ইমোশনাল এপ্রোচে’ তাকে কাবু করা যেতো। এই চেষ্টায় রসদ যোগাচ্ছে বর্ষীয়ান সাংবাদিক আব্দুল গাফফার চৌধুরীর একটি লেখা। ‘ইতিহাসের রক্ত পলাশ: পনেরই আগস্ট পঁচাত্তর’ বইয়ে তিনি ভুট্টোর একটি উদ্ধৃতি দিয়েছেন যেখানে ভুট্টো বলছেন — সে শেখ মুজিবকে ভয় পায়না, শেখ মুজিবকে ইমোশনালি কাবু করা যায় কিন্তু তার ভয় শেখের পেছনে থাকা ঠাণ্ডা মাথার তাজউদ্দিন।

                   আরও পড়ুন-  তাজউদ্দীনের লিগ্যাসি কোন পথে?

সমস্যা হচ্ছে গাফফার চৌধুরী কথিত ভুট্টোর এই উদ্ধৃতির কোনো ঐতিহাসিক সত্যতা নেই। গাফফার চৌধুরী ছাড়া আর কেউ কি সেটা শুনেছিলেন, পরের দিন কোনো পত্রিকায় কী এরকম কিছু এসেছিলো, ভুট্টোর আরও যেসব জীবনী বা সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়েছে সেসবের কোথাও কি এরকম কোনো কথা আছে? উত্তর হলো- না।

বিজ্ঞাপন

ভুট্টো যদি বলেও থাকে সেটাকে আমরা বেদবাক্য মেনে নিয়ে ভুট্টোর মতো করে বঙ্গবন্ধুকে চিনবো নাকি বঙ্গবন্ধুকে চিনবো আমাদের জন্য তার সারাজীবনের কাজ থেকে? তার দীর্ঘ কর্মবহুল জীবনে কোথাও কি কোনো উদাহরণ আছে যেখানে তাকে ইমোশনাল এপ্রোচে কাবু করা গেছে? তিনি যুক্তির চেয়ে আবেগকে প্রাধান্য দিয়েছেন? তার দূরদৃষ্টির অভাব ছিলো?

মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস তিনি যখন একা, কারাবন্দী, এবং ভুট্টোরই কব্জায় তখন কি ভুট্টো পেরেছিলো তাকে ইমোশনাল এপ্রোচে কাবু করতে? আমরা জানি ১৬ ডিসেম্বরের পর আন্তর্জাতিক চাপে পাকিস্তান যখন তাকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় ভুট্টো তখন তার হাত ধরে আবেদন করেছে— দুই অংশের মধ্যে ন্যুনতম সম্পর্ক রাখতে। ভুট্টো জানতো, সে শেখ মুজিবের কাছ থেকে এই প্রতিশ্রুতি আদায় করতে পারলে সেটা হবে চরম পরাজয়ের মুখে তার বিশাল অর্জন। নয় মাস কারাবন্দী, মানসিক নির্যাতনের শিকার, একা ও যোগাযোগহীন শেখ মুজিবকে সেদিনই ভুট্টো ইমোশনাল এপ্রোচে কাবু করতে পারেনি আর যখন তিনি সাড়ে সাত কোটি মানুষের ম্যান্ডেট নিয়ে তার মানুষদের সাথেই আছেন অবিসংবাদিত নেতা হিসাবে তখন তাকে কাবু করা সম্ভব?

১৯৭১ এর ২৫ মার্চ রাতে তার সহকর্মী তাজউদ্দিন আহমদসহ সকলের অনুরোধ উপেক্ষা করে তিনি একা রয়ে গেছেন। এর আগে ঠিক করে দিয়েছেন চূড়ান্ত পরিস্থিতিতে সহকর্মীরা কে কোথায় যাবেন, কী করবেন। সবাইকে নিরাপদে সরে যাওয়ার পরামর্শ দিয়ে একা থেকে পাকিস্তান সরকারের হাতে বন্দী হওয়া কি তার আবেগী সিদ্ধান্ত নাকি ঠাণ্ডা মাথার যুক্তিযুক্ত, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন সিদ্ধান্ত? ইতিহাস সাক্ষী দেয় এর চেয়ে পরিণত কোনো সিদ্ধান্ত হতে পারেনা। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সফলতার বীজ লুকিয়ে ছিলো এই সিদ্ধান্তে। তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর চূড়ান্ত আক্রমণ পর্যন্ত অপেক্ষা করেছেন, তারপর নিজের ঘর থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা ট্রান্সমিট করেছেন এবং গ্রেফতার হয়েছেন। বিশ্ববাসী দেখেছে— বাঙালী বা বঙ্গবন্ধু বিচ্ছিন্নতাবাদী নয়, তারা আক্রমণের শিকার বলেই আত্মরক্ষার পূর্ণ অধিকার রয়েছে এবং নির্বাচনে পূর্ণ ম্যান্ডেট পাওয়া নেতাকে সরকার তার বাসগৃহ থেকে বন্দী করে হাজার মাইল দূরে বন্দী করে নিয়ে গেছে— তিনি কোথাও পালিয়ে যাননি। বল তখন চলে গেছে পাকিস্তানের গোল পোস্টে।

অতি আবেগী, কম দূরদৃষ্টিসম্পন্ন— এর পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুর আরেকটি চরিত্র নির্মাণ করা হয় তিনি শাসক হিসাবে ব্যর্থ ছিলেন। এই দু’টোর মধ্যে সংযোগ আছে। অতি আবেগী ও অদূরদর্শী কেউ তো শাসক হিসেবে ভালো হতে পারেনা। এই গড়পড়তা কথা যারা বলেন তারা বঙ্গবন্ধুর তিন বছর সাত মাসের শাসনামলের পূর্ণাঙ্গ চিত্র হয় বুঝেন না, না হয় এড়িয়ে যান ইচ্ছে করে। একজন শাসক সফল না ব্যর্থ প্রমাণ করতে হলে বলতে হবে তিনি কার চেয়ে সফল বা ব্যর্থ? একই সঙ্গে বিবেচনায় নিতে হবে সেই সময়ের প্রেক্ষাপট। ১৯৭২-৭৫ কে আজকের সঙ্গে তুলনা করা যাবেনা। যুদ্ধবিধ্বস্ত, শূন্য রিজার্ভ, প্রশাসনিক কাঠামোহীন সময়ে মানুষের হাতে হাতে অস্ত্র, সরকারের বিরুদ্ধে চলমান বিভিন্ন পক্ষের গোপন সশস্ত্র যুদ্ধ, সেই সঙ্গে নানা কেন্দ্রে বিভক্ত আন্তর্জাতিক রাজনীতির টানাপড়েন ও ষড়যন্ত্র।

বিজ্ঞাপন

বঙ্গবন্ধু যদি দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ও দক্ষ প্রশাসক না হতেন— দ্রুততম সময়ে ভারতীয় সেনাবাহিনী যেমন ফিরে যেতো না তেমনি তিন বছরের মধ্যে বাংলাদেশ পৃথিবীর অধিকাংশ রাষ্ট্রের স্বীকৃতি আদায় এবং চীনের ভেটো উপেক্ষা করে জাতিসংঘসহ প্রায় সকল আন্তর্জাতিক সংস্থার সদস্য পদ লাভ করতো না। মন্ত্রীসভা ও আওয়ামী লীগে তার সহকর্মীদের অনেকে আন্তর্জাতিক রাজনীতির প্রেক্ষাপটে নানা মতাদর্শিক শিবিরে বিভক্ত থাকলেও তিনি ঠাণ্ডা মাথায় সবার সঙ্গে সুসম্পর্কের নীতি গ্রহণ করেছিলেন। যুদ্ধ শেষের ছাইভস্ম থেকে তখন রাষ্ট্র নির্মাণের পালা, অভুক্ত মানুষের মুখে খাবার তুলে দেওয়া তখন অগ্রাধিকার। ফিরে আসা এক কোটি শরণার্থী ও ধর্ষিতা নারীদের পুনর্বাসন, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা, পাকিস্তানের বন্দী সাড়ে চার লাখ বাঙ্গালীকে ফিরিয়ে আনা, যুদ্ধে বিধ্বস্ত অবকাঠামো ও যোগাযোগ ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা— যেসব সমস্যা তিনি দক্ষভাবে মোকাবেলা করেছেন পরবর্তীতে বৈধ-অবৈধভাবে ক্ষমতাসীনদের কেউ সেসব সমস্যার মুখোমুখিই হননি। তাহলে কিসের ভিত্তিতে শাসক হিসাবে তার সফলতা ও ব্যর্থতার মূল্যায়ন?

এমনও বলা হয় তিনি নাকি ফিরে এসে তাজউদ্দিন আহমদের কাছে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে কিছু জানতে চাননি, এর সপক্ষে আবার উদাহরণ— তিনি একবারও মুজিবনগর যাননি। মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে না জেনেই মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা, নির্যাতিত নারীদের পুনর্বাসন, শহীদ পরিবারগুলোকে ব্যক্তিগত চিঠি ও দু’হাজার টাকার চেক পাঠানোর ব্যবস্থা করে ফেলেছিলেন? তার এই সময়ের প্রতিদিনের কার্যতালিকা দেখলেই বুঝা যায় কী ভয়ংকর ব্যস্ত সময় তাকে কাটাতে হয়েছে। রাষ্ট্র নির্মাণের পাশাপাশি তাকে ছুটে যেতে হয়েছে দেশের নানা প্রত্যন্ত অঞ্চলে— বন্যাসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিপর্যস্ত মানুষের কাছে, যুদ্ধে সর্বহারা মানুষকে সাহস জোগাতে। মুজিব নগর পরিদর্শন তার অগ্রাধিকারে না থাকা অন্যায় কিছু ছিলো না।

বঙ্গবন্ধুর চরিত্রায়নে আরেকটি বৈশিষ্ট্য নির্মিত হয়— তিনি স্বজনপ্রীতি করতেন। এরকম সরল ধারণা বাজারজাত করা হয় যে, শহীদ শেখ ফজলুল হক মনি ও খন্দকার মোশতাক আহমদের যৌথ চক্রান্তে শহীদ তাজউদ্দিন আহমদকে মন্ত্রীসভা থেকে সরিয়ে দেওয়ায় ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ড ঘটে। এই সরলীকরণে একদিকে যেমন একাধিকজনের চরিত্র হনন করা হয় তেমনি ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ডের  গুরুত্ব ও অবনমন করা হয়।

শহীদ শেখ ফজলুল হক মনি বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে হলেও তিনি নিজ বৈশিষ্ট্যেই উজ্জ্বল ছিলেন। ১৯৬২ এর ছাত্র আন্দোলন, ছয় দফা আন্দোলনের অন্যতম রূপকার তিনি, মুক্তিযুদ্ধের শক্তিশালী গেরিলা বাহিনী বিএলএফ এর শীর্ষ কমান্ডার। স্বাধীনতার আগে থেকেই তিনি লেখক সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে মুক্তিযুদ্ধের পরিচালনা পদ্ধতি নিয়ে শহীদ তাজউদ্দিন আহমদের সঙ্গে মত পার্থক্য ছিলো তার। এই পার্থক্য নীতিগত এবং স্পষ্টত: গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল হিসাবে আওয়ামী লীগের মধ্যে এই চর্চা ছিলো। শহীদ শেখ মণির মত পার্থক্য কখনোই খন্দকার মুশতাকের মতো ষড়যন্ত্র ছিলোনা। শেখ মনি মুজিব নগর সরকারের কেউ ছিলেন না কিন্তু খন্দকার মুশতাক সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকা অবস্থাতেই গোপন ষড়যন্ত্র করেছিলো। শেখ মণি এবং খন্দকার মোশতাকের রাজনৈতিক মতাদর্শ ছিলো সম্পূর্ণ ভিন্ন। শেখ মনি সোচ্চার ছিলেন আমেরিকার বিরুদ্ধে, মুশতাক ছিলো আমেরিকার চর। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার আগে খুনিরা হত্যা করেছে শেখ মনিকে তার স্ত্রী ও এক সন্তানসহ। কেবল তাজউদ্দিন আহমদের বিরোধিতার সূত্র ধরে শহীদ শেখ মণিকে খন্দকার মোশতাকের সাথের ষড়যন্ত্রকারী হিসাবে চিহ্নিত করার চেয়ে জঘন্য মিথ্যাচার কিছু হতে পারেনা।

বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে মন্ত্রীসভা থেকে শহীদ তাজউদ্দিন আহমদের পদত্যাগ নিয়ে আলোচনা, সমালোচনা, পর্যবেক্ষণ থাকতেই পারে কিন্তু এর মাধ্যমে শেখ মনি বা খন্দকারের মোশতাকের বঙ্গবন্ধুকে প্রভাবিত করার গল্পের কোনো ভিত্তি নেই। আমাদের জানা প্রয়োজন— প্রবাসী সরকারে খন্দকার মোশতাক পররাষ্ট্রের পাশাপাশি আইন ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রীও ছিলো। ইরানে গিয়ে আমেরিকার পরামর্শে পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেডারেশনের চক্রান্ত ভারত সরকারের কাছে ফাঁস হয়ে গেলে মুশতাককে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পদ থেকে নিষ্ক্রিয় করা হয় কিন্তু প্রবাসী সরকারে সে আইন ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী হিসাবেই রয়ে যায়। বঙ্গবন্ধু ফিরে আসার আগে ১৯৭২ এর জানুয়ারি ১ তারিখে মুশতাক আবার পদত্যাগের নাটক করে, তখন মন্ত্রীসভার পক্ষ থেকে পত্রিকায় বিবৃতি দিয়ে জানানো হয়— সদ্য স্বাধীন দেশের মন্ত্রীসভায় খন্দকার মুশতাকের উপস্থিতি ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। তাজউদ্দিন আহমদ তখনো প্রধানমন্ত্রী, বঙ্গবন্ধু তখনো ফিরে আসেননি। বরং বঙ্গবন্ধু ফিরে আসার পর তাকে আইন ও সংসদ মন্ত্রীকে থেকে সরিয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ে বহাল করেন।

আমাদের আরও ভাবার সুযোগ আছে— ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ড কোনো স্থানীয় চক্রান্ত নয়, এটি একটি আন্তর্জাতিক রাজনীতির অংশ। বঙ্গবন্ধুর মতো সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী জাতীয়তাবাদী নেতাদেরকে তখন একের পর এক হত্যা করা হয়েছে— হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন আলেন্দে, সুকর্ণ। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সমীকরণ মেলাতে গেলে এইসব হত্যাকাণ্ড , সে সময়ের আন্তর্জাতিক রাজনীতির গতিধারা বুঝতে হবে। সিনেমার স্ক্রিপ্টের মতো সরল গল্পে জটিল রাজনৈতিক সমীকরণ মেলানো যায়না।

বহু রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের সূতিকাগার এই জনপদে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক চূড়ান্ত সম্মিলন। জন-সম্পৃক্ততা, জনপ্রিয়তায় যেমন তিনি সকলকে ছাড়িয়ে তেমনি রাজনৈতিক বিচক্ষণতা, দূরদর্শিতা এবং রাষ্ট্রনায়কোচিত দক্ষতায়ও তিনি অনন্য। তার আবেগ মানবিক গুণের পরিচায়ক, অদূরদর্শিতা নয়। সে সময়ের গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক নেতাদের কেউ কেউ তার সহকর্মী ও অনুগামী ছিলেন, কেউ কেউ বিরোধী ছিলেন কিন্তু কেউই তার ‘গাইড এন্ড ফিলোসফার’ ছিলেন না। তার রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রনৈতিক অর্জন পেছনে থেকে কারও তৈরি করে দেওয়া নয় বরং তার আলোতেই বাকীরা আলোকিত হয়েছেন।

বঙ্গবন্ধু অতিমানব কেউ ছিলেন না। দীর্ঘ বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবন এবং ব্যক্তি মানুষ হিসাবে তিনি যেমন ছিলেন— সে সবের নিশ্চয় আলোচনা, পর্যালোচনা, সমালোচনা হবে। কিন্তু ভিত্তিহীন, যুক্তিহীন, প্রমাণহীন কথাবার্তা ও স্মৃতিচারণের নামে যদি তার চরিত্রহননের চেষ্টা করা হয় তবে তা রাজনৈতিক কর্মকৌশল হিসেবেই বিবেচনা করতে হবে। বাংলাদেশ বিরোধী, মুক্তিযুদ্ধবিরোধী চক্র বহু বছর ধরেই এই কর্মকৌশল প্রয়োগ করছে সচেতন ভাবেই। এরা নিজেরা এ ধরণের প্রচারণা যেমন চালায় তেমনি নিজেদের বৃত্তের বাইরে একই উদ্দেশ্যের কিছু পেলে সেটারও প্রচারের দায়িত্ব নেয়। যেমন শারমিন আহমদ এর লেখা ‘নেতা ও পিতা’ এবং সিমিন হোসেন রিমি সম্পাদিত ‘তাজউদ্দিন আহমদ: আলোকের অনন্তধারা’ বই দুটি ওই শিবির থেকে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়। দু’টি বইয়েই বঙ্গবন্ধুর সহকর্মী শহীদ তাজউদ্দিন আহমদের স্মৃতিচারণের পাশাপাশি অপ্রাসঙ্গিকভাবে বঙ্গবন্ধুকে আবেগী, অদূরদর্শী, আদর্শ বিচ্যুত বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

রাজনৈতিক জ্ঞান, বোধ ও ইতিহাস সম্পর্কে সচেতন না হলে এমন অনেকের এই কর্মকৌশলের শিকার হবার আশঙ্কা রয়েছে, আদতে হয়তো যারা বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশবিরোধী নয়।

লেখক: লেখক  ও গবেষক
hasan_murshed@hotmail.com

সারাবাংলা/আইই

Tags: , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন