বিজ্ঞাপন

বিশ্বজুড়ে টিকটক রাজনীতি: তথ্যচুরির ভয়, নাকি চীনা আধিপত্য রোধ?

August 5, 2020 | 10:45 am

মুনীর মমতাজ

বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের সৃজনশীল মানুষগুলো যেন নিজেরাই নিজেদের সৃজনশীলতা, বিশেষ দক্ষতা ও গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলো মোবাইল ধারণ ও প্রকাশের সুযোগ পায়— সেই উদ্দেশে যাত্রা শুরু করে চীনভিত্তিক অন্যতম জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম টিকটক।

বিজ্ঞাপন

তবে করোনাভাইরাসের কারণে বিশ্বব্যাপী লকডাউন শুরু হলে মাত্র কয়েক মাসে ভিডিও শেয়ারিং অ্যাপটিও দ্বিগুণ জনপ্রিয়তা লাভ করে। ডাউনলোড সংখ্যায় অনেক জনপ্রিয় অ্যাপসকে পেছনে ফেলে বিশ্বের নবম জনপ্রিয় অ্যাপে পরিণত হয় টিকটক। ‍

টিকটকের বেশকিছু কনটেন্ট মূলধারার গণমাধ্যমের বিষয়বস্তুতেও পরিণত হয়। যেমন করোনাকালীন সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের একটি হাসপাতালে নার্সদের নাচের ভিডিও টিকটকে ব্যাপক ভাইরাল হলে সেটা মূলধারার গণমাধ্যম তথা টেলিভিশনেও সম্প্রচার করা হয়। এছাড়া আইসোলেশন বিষয়ে যুক্তরাজ্যের টেলিভিশনগুলোতে বিজ্ঞাপনও প্রচার করে টিকটক।

আরও পড়ুন-

টিকটকে ‘প্রযুক্তি জাতীয়তাবাদ’

বিজ্ঞাপন

টিকটক কিনে নিতে চায় মাইক্রোসফট

যুক্তরাষ্ট্রে টিকটক বন্ধ করে দেবেন ট্রাম্প

বিজ্ঞাপন

বিশ্বজুড়ে লকডাউন শুরু হলে টিকটকের চাহিদা বেড়ে যায় কয়েকগুণ। শুধু চলতি বছরের এপ্রিল মাসের মধ্যে ৩১৫ মিলিয়ন টিকটক অ্যাপ ডাউনলোড করা হয়। এর কারণও অবশ্য খুব জটিল কিছু না, লকডাউনের একঘেয়েমি, নিয়মিত নিরস-কর্কষ সংবাদের ভিড়ে কিছুটা নাচে-গানে ভরপুর হাস্যরসাত্মক ভিডিও মানুষকে ভিন্ন ধাঁচের বিনোদন দেয় বলেই একঘেয়েমির সময়গুলোতে মানুষ বেশি করে টিকটকে ঝুঁকে পড়ে।

প্রথম দিকে টিকটকে নাচের ভাইরাল ভিডিও, কমেডি চ্যালেঞ্জ, মেকআপ চ্যালেঞ্জ বিষয়ক বিভিন্ন ভিডিও ও ফ্লেয়ার শেয়ার করা হয়। তবে দিনদিন বাড়তে থাকে এর বিষয়বস্তু। যোগ হতে থাকে নানা ধরনের ‘রাজনৈতিক’ কনটেন্টও। অনেকে শুধু টিকটক ব্যবহার করেই হয়ে যাচ্ছেন সেলিব্রেটি। তাদের থাকছে হাজারও ফ্যান-ফলোয়ার।

টিকটক সাম্রাজ্যের উত্থান

অ্যান্ড্রয়েড ও আইওএস মিডিয়া অ্যাপ হিসেবে ২০১৬ সালে টিকটকের যাত্রা শুরু হয়। চীনের দয়িন কোম্পানি এর প্রতিষ্ঠা করে। পরের বছর ২০১৭ সালে বিশ্বের অন্যতম ইন্টারনেট স্টার্টআপ কোম্পানি বাইটড্যান্স অ্যাপটি চীনের বাইরেও ছড়িয়ে দেওয়ার কাজ শুরু করে। মাত্র চার বছরের ব্যবধানে টিকটকের সক্রিয় ব্যবহারকারীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৮০০ মিলিয়নে। এরপর ২০১৮ সালে মিউজিক্যালির সঙ্গে একীভূত হয় অ্যাপটি।

 

বিজ্ঞাপন

যুক্তরাষ্ট্রে টিকটক রাজনীতি

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে লাখ লাখ তরুণ তাদের সৃজনশীলতার প্রকাশ ও বিনোদনের উদ্দেশে টিকটক ব্যবহার করলেও বেশ কিছুদিন ধরে এটাকে ব্যাপকহারে রাজনৈতিক উদ্দেশে ব্যবহার শুরু হয়েছে। এর মাধ্যমে নানা ধরনের রাজনৈতিক প্রচারণা ও ট্রল শেয়ার করা হচ্ছে। যদিও টিকটকের মূল কোম্পানি একে রাজনীতি থেকে দূরে রাখতে চাইছেন। এই পদক্ষেপের অংশ হিসেবে তারা কোনো ধরনের রাজনৈতিক বিজ্ঞাপন প্রচার থেকেও নিজেদের দূরে রেখেছেন।

তবে যুক্তরাজ্যে একজন কৃষ্ণাঙ্গের ওপর পুলিশের বর্বর হামলা ও ‘ব্ল্যাক লাইভ ম্যাটারস’ মুভমেন্ট ছড়িয়ে দিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে টিকটক।

পাশাপাশি টিকটকে রয়েছে অ্যান্টি ট্রাম্প ও প্রো-ট্রাম্প গোষ্ঠী, যারা টিকটকের মাধ্যমে একে অন্যকে নানাভাবে মিম-ট্রলের মাধ্যমে নাস্তানাবুদের চেষ্টা করে। পাশাপাশি নানা সেক্সিস্ট ও কনস্পিরেসি কনটেন্ট ও বাচ্চাদের বন্দুক কালেকশনের নানা কনটেন্টও শেয়ার করা হচ্ছে টিকটকে।

নানা সমালোচন থাকলেও যুক্তরাষ্ট্রের তরুণদের মধ্যে দিনদিন ব্যাপকহারে জনপ্রিয়তা বাড়ছে টিকটকের। এরকমই একটি সময়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ঘোষণা দেন, টিকটক বন্ধ হতে পারে যুক্তরাষ্ট্রে। টিকটক বন্ধের হুমকিতে হতাশ যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকরা। এ বিষয়ে ওয়াশিংটনের দাবি, টিকটকের মাধ্যমে তাদের দেশের গ্রাহকদের তথ্য চীন সরকারের হাতে চলে যাবে।  তবে এ বক্তব্যেকে বাতিল করে দিয়েছে টিকটক কর্তৃপক্ষ।

এছাড়া গত সোমবার (৩ আগস্ট) ট্রাম্প তার এক ভাষণে বলেছেন, যদি মাইক্রোসফট অথবা অন্য কোনো কোম্পানি এটি কিনতে না পারে, তাহলে আগামী সেপ্টেম্বরের মধ্যে সেটা যুক্তরাষ্ট্রে বন্ধ করে দেওয়া হবে। তাছাড়া চলতি সপ্তাহে ট্রাম্প মাইক্রোসফটের প্রধান নির্বাহীকে জানিয়েছেন, যেন টিকটক কিনে নেওয়ার ব্যাপারে তারা চেষ্টা অব্যাহত রাখেন।

বিশ্ববিখ্যাত টেক জায়ান্ট মাইক্রোসফট জানিয়েছে তারা যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডে পরিচালনা করতে টিকটক কিনে নেওয়ার জন্য তাদের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাবে।

এক ব্লগপোস্টে মাইক্রোসফট জানিয়েছে, খুব শিগগিরই টিকটকের মাদার কোম্পানি বাইটড্যান্সের সঙ্গে আলোচনা হতে যাচ্ছে। এটা মাত্র কয়েক সপ্তাহের ব্যাপার এবং ১৫ সেপ্টেম্বরের আগেই সেটা হবে।’

ভারতের টিকটক কূটনীতি

টিকটকের পাশাপাশি চীনের আরও ৫৮টি জনপ্রিয় ভিডিও শেয়ারিং অ্যাপ নিষিদ্ধ করেছে ভারত সরকার। এর মধ্যে টিকটক ছাড়াও তাদের আরও দুটি জনপ্রিয় অ্যাপ হলো ভিভা ভিডিও ও হ্যালো অ্যাপ। এই তিনটি অ্যাপ নিষিদ্ধ হয়ে যাওয়ায় সব মিলিয়ে কমপক্ষে ৬ বিলিয়ন ডলার ক্ষতির আশঙ্কা করছে সংস্থাটি।

ভারতে ৫৯টি চাইনিজ অ্যাপকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে কেন্দ্রীয় সরকার জানায় ওই অ্যাপগুলি দেশের সার্বভৌমত্ব, অখণ্ডতা, দেশের সুরক্ষার জন্য ক্ষতিকারক। সেকারণেই ওই অ্যাপগুলিকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তি আইনে নিষেধাজ্ঞাও জারি করা হয়েছে অ্যাপগুলোর ওপর।

এই ঘটনাকে ভারতীয়দের নিজস্ব অ্যাপ তৈরির জন্য ‘দারুণ সুযোগ’ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

তবে মনে করা হচ্ছে, গালওয়ান উপত্যকায় চিনা সেনার আক্রমণে ২০ জন ভারতীয় জওয়ান শহিদ হওয়ার পরেই ওই দেশের অর্থনৈতিক কাঠামোর ওপর আঘাত হানতেই চীনা অ্যাপগুলো নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এছাড়াও ভারত জুড়ে চিনা দ্রব্য বর্জনেরও দাবি উঠেছে।

তবে বাইটড্যান্স সংস্থাটির পক্ষ থেকে বারবার করে এই কথা বলা হচ্ছে, টিকটক ব্যবহারকারীদের তথ্যের গোপনীয়তা রক্ষায় বরাবর জোর দিয়ে যাচ্ছে। কোনোভাবেই ভারতীয়দের ব্যক্তিগত তথ্য ফাঁস হয়ে যায়নি। ভারতে যেভাবে রাতারাতি ৫৯টি চাইনিজ অ্যাপ্লিকেশনকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে, সেই সিদ্ধান্তকে নজিরবিহীন বলেও উল্লেখ করে বাইটড্যান্স।

বিদেশে সর্বাধিক জনপ্রিয় চীনা অ্যাপ হিসাবে নিজের জায়গা করে নেওয়া টিকটকের ওপর এটা একটা বিশাল আঘাত সরকারের এই সিদ্ধান্ত। চীনের বাইরে যে যে দেশে টিকটকের ভালো ব্যবসা হচ্ছিল তার মধ্যে অন্যতম ভারত। চলতি বছরের প্রথম ৩ মাসে ভারতে টিকটক অ্যাপটি ৬১১ মিলিয়ন বার ডাউনলোড হয়েছে, যা সারাবিশ্বের মোট ডাউনলোডের ৩০ দশমিক৩ শতাংশের কাছাকাছি।

এদিকে ভারতে টিকটকসহ বাইটড্যান্স সংস্থার তিনটি জনপ্রিয় অ্যাপ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বহু ভারতীয়ও কাজ হারানোর মুখে। এই সংস্থার অধীনে ভারতের প্রায় ২ হাজারেরও বেশি কর্মী কাজ করতেন।

টিকটক সম্পর্কে কয়েকটি তথ্য

সারাবিশ্বে টিকটকের রয়েছে ৮০০ মিলিয়ন সক্রিয় ব্যবহারকারী। ফেসবুক ইউটিউবের পর টিকটিক বিশ্বের নবম জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। এমনকি টুইটার, লিংকডইন, স্নাপচ্যাট ও পিন্টারেস্টের চেয়েও এখন জনপ্রিয় টিকটক। ভারত, চীন ও যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও জাপান, কম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়াতে ব্যাপক জনপ্রিয় টিকটক।

২০১৯ সালে টিকটক অ্যাপটি ইনস্টলেশন সংখ্যায় ১ বিলিয়ন ছাড়ালেও পরবর্তী ১৮ মাসে সেটা ২ বিলিয়নে পৌঁছে যায়। করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট লকডাউনের সময়ে সবচেয়ে বেশি হারে অ্যাপটি ডাউনলোড করা হয়েছে।

অ্যাপল অ্যাপ স্টোরের সবচেয়ে বেশি ডাউনলোড করা অ্যাপ টিকটক। এর পরেই রয়েছে ইউটিউব, ইনস্টাগ্রাম, ফেসবুক ও স্নাপচ্যাট।

বর্তমান সময়ে তরুণদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা পেয়েছে টিকটক। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে ৪১ শতাংশ টিকটক ব্যাহারকারীর বয়স ১৬ থেকে ২৪ বছরের মধ্যে।

টিকটক ব্যবহারকারী দেশের মধ্যে শীর্ষে রয়েছে ভারত। সেখানে ৬১১ মিলিয়ন টিকটক ব্যবহারকারী রয়েছে। এর পরে চীনে আছে ১৯৬.৬ মিলিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রে ১৬৫ মিলিয়ন ব্যবহারকারী।

একজন ব্যবহারকারী প্রতিদিন গড়ে ৫২ মিনিট সময় টিকটকে ব্যয় করেন।

২০১৯ সালের তথ্য অনুযায়ী বিশ্বের ১৫৫টি দেশে টিকটক ব্যবহারকারী রয়েছে।

প্রায় ৯০ ভাগ টিকটক ব্যবহারকারী সারাদিনে একাধিকবার টিকটক ব্যবহার করে থাকেন।

টিকটকে প্রতিদিন গড়ে ১ বিলিয়ন ভিডিও দেখা হয়

[বিবিসি, গার্ডিয়ান, আল জাজিরা অবলম্বনে]

সারাবাংলা/এমআই/টিআর

Tags: , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন