বিজ্ঞাপন

হাওরে ট্রলারডুবি: ৮ জন একই পরিবারের, শোকস্তব্ধ ২ গ্রাম

August 6, 2020 | 12:42 am

ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট

ময়মনসিংহ ও নেত্রকোনা: স্বজন হারানোর শোকে মূহ্যমান ময়মনসিংহ সদরের চরসিরতা কোনাপাড়া ও চর খরিচা গ্রাম। নেত্রকোনার হাওরে ট্রলারডুবির ঘটনায় যে ১৭টি প্রাণ ঝরেছে, সবাই ছিলেন এই দুই গ্রামেরই বাসিন্দা। তবে তারা সবাই আবার ছিলেন কোনাপাড়া গ্রামের মারকাজুল সুন্নাহ মাদরাসার শিক্ষক-ছাত্র। এর মধ্যে কোনাপাড়া গ্রামের এক পরিবারেরই সদস্য রয়েছেন আট জন!

বিজ্ঞাপন

বুধবার (৫ আগস্ট) দুপুরে নেত্রকোনার মদনের হাওরে রাজালীকান্দা এলাকায় ৪৮ জন যাত্রী নিয়ে ডুবে যায় একটি ট্রলার। এ দুর্ঘটনায় ১৭ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়।

ট্রলারডুবির খবর কোনাপাড়া ও চরখরিচায় পৌঁছালেই শুরু হয় স্বজনহারাদের মাতম। বুকফাটা আর্তনাদ আর আহাজারিতে ভারী হয়ে ওঠে কয়েক গ্রামের বাতাস।

আরও পড়ুন- নেত্রকোনায় হাওর দেখতে গিয়ে প্রাণ গেল ১৭ জনের

বিজ্ঞাপন

যে ১৭ জন মারা গেছেন রাজালীকান্দা হাওরে, তাদের মধ্যে মারকাজুল সুন্নাহ মাদরাসার মুহতামিম মাওলানা মাহফুজুর রহমানসহ তার পরিবারের আট সদস্য মারা গেছেন। তার দুই ছেলে আসিফ (১৫) ও মাহবুব (১২), ভাগ্নে রেজাউল (১৫), ভাতিজা জোবায়ের (২০) ও জোনায়েদ(১৭), ভাতিজি লুবনা (১৩) ও জুলফা (৭)— সবাই এখন কেবলই স্মৃতি। পুরো বাড়িজুড়ে এখন কেবলই আহাজারি।

মাহফুজুর রহমানের আরেক ভাতিজা আনিস বলেন, চাচা পরিবারের ৯ জন সদস্যকে নিয়ে আনন্দ ভ্রমণে গিয়েছিলেন। তাদের মধ্যে আট জনই লাশ হয়ে ফিরেছেন। এই শোক সহ্য করার মতো ক্ষমতা আমাদের কারও নেই।

মাওলানা মাহফুজুরের পাশের বাড়িতেই থাকতেন মাদরাসা শিক্ষক মাওলানা আজাহার আলী। তিনিও পরিবারের কয়েকজন সদস্যকে নিয়ে গিয়েছিলেন হাওর ভ্রমণে। তিনি আর বেঁচে ফেরেননি। মারা গেছেন তার ভাতিজা ব্যবসায়ী জাহিদ। আনিস বলেন, মাওলানা আজাহারের চার মাস বয়সী একটি শিশু সন্তান রয়েছে। এতিম এই শিশুর কী হবে, তা কেউ ভাবতেই পারছেন না। পাশাপাশি দুইটি বাড়ি শোকে পাথর হয়ে গেছে।

বিজ্ঞাপন

কেবল এই দুই বাড়ি নয়, শোকে স্তব্ধ কোনাপাড়া আর চর খরিচা— দুইটি গ্রামই। মাওলানা মাহফুজুর আর তার প্রতিবেশী মাওলানা আজহারের পরিবারের ১০ জনের বাইরে বাকি সবাইও যে এই দুই গ্রামেরই। মৃত বাকিরা হলেন— শফিকুর রহমান (৪০), হামিদুল (৩৫), জহিরুল ইসলাম (৩৫), সামায়ান (২০), ইসা মিয়া (৪০), সাইফুল ইসলাম রতন (৩০), রাকিব (২০) ও মুজাহিদ মিয়া (১৭)।

স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান আবু সাইদ জানান, বুধবার সকাল ৭টার দিকে কোনাপাড়া ও চর খরিচা থেকে মাদরাসা শিক্ষক ও তাদের পরিবারের সদস্য মিলিয়ে ৪৮ জন নৌভ্রমণে যান নেত্রকোনার মদনের তেলিখালি মাদরাসা পরিচালকের আমন্ত্রণে। কিন্তু তখন যে জানত, দুপুরের আগেই এই আনন্দ পরিণত হবে বিষাদে!

ইউপি চেয়ারম্যান জানান, এমন দুর্ঘটনার সংবাদে গ্রাম দুইটি শোকে পাথর হয়ে গেছে। কেউই চোখের নিমিষে এমন ১৭ জনের প্রাণহানি মেনে নিতে পারছে না। মৃতদের পরিবারগুলোর জন্য কোনো ধরনের সহায়তা প্রয়োজন হলে তার ব্যবস্থা করা হবে বলে জানান তিনি।

বিজ্ঞাপন

যেভাবে ট্রলারডুবি

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নেত্রকোনার মদনের তেলিখালি মাদরাসা পরিচালক মাওলানা শফিকুর রহমানের আমন্ত্রণে নৌপথে আনন্দ ভ্রমণে যাচ্ছিলেন মারকাজুল সুন্নাহ মাদরাসার মুহতামিম (পরিচালক), শিক্ষক-শিক্ষার্থী। তাদের সঙ্গে মুহতামিম ও শিক্ষকদের পরিবারের সদস্যরাও ছিলেন। মদনে পৌঁছে উচিতপুর ঘাট থেকে তারা ভ্রমণ শুরু করেন। গন্তব্য ছিল গোবিন্দশ্রী।

স্থানীয়রা বলছেন, উচিতপুরের এই হাওর এলাকাটি স্থানীয়ভাবে মিনি কক্সবাজার হিসেবে পরিচিত। সেখানেই ভ্রমণে এসেছিলেন ময়মনসিংহের মারকাজুল সুন্নাহ মাদরাসার শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। বর্ষাকাল হলেও হাওরে খুব বেশি পানি ছিল না। তবে প্রবল বাতাস ছিল। বাতাসের তোড়েই হয়তো তাদের ট্রলারটি ডুবে যায়।

হাওরে মাছ ধরার কাজে নিয়োজিত নৌকাগুলো এই ট্রলারের আশপাশে ছুটে আসে। দ্রুত খবর দেওয়া হয় স্থানীয় ফায়ার সার্ভিসকেও। শুরু হয় উদ্ধার তৎপরতা। নৌকার যাত্রীদের মধ্যে ৩০ জন সাঁতরে আশপাশের নৌকায় উঠতে সমর্থ হন। কিন্তু বাকি ১৮ জন উঠতে পারেননি। পরে ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরী দল, পুলিশ ও স্থানীয়দের তৎপরতায় ১৭ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। রাতেও শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত একজন নিখোঁজ ছিলেন।

মরদেহ হস্তান্তর রাতেই

মর্মান্তিক এই দুর্ঘটনার খবর পেয়ে উদ্ধার তৎপরতা চলাকালীন ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন নেত্রকোনার পুলিশ সুপার আকবর আলী মুন্সি, মদনের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বুলবুল আহমেদ তালুকদারসহ স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।

মৃতদের স্বজন ও নেত্রকোনা উপজেলা প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রাতের মধ্যেই মরদেহগুলো স্বজনদের কাছে হস্তান্তরের প্রক্রিয়া শেষ করার চেষ্টা করা হবে।

পরে মদন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. রমিজুল হক জানান, মৃতদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। তাদের কাছে রাতের মধ্যেই মরদেহ হস্তান্তরের চেষ্টা করা হবে। ওসি জানান, মরদেহ বহন ও দাফনের জন্য মৃত প্রত্যেকের পরিবারকে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে আর্থিক সহায়তাও করা হচ্ছে।

সারাবাংলা/টিআর

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন