বিজ্ঞাপন

‘আমার হাত বান্ধিবি, পা বান্ধিবি’ ও একজন দেব গৌতমের ‘গানে ফেরা’

August 6, 2020 | 9:44 am

আশীষ সেনগুপ্ত

অনলাইন গানের জগতে এই মুহূর্তে বেশ আলোচিত একটি নাম দেব গৌতম। তার গাওয়া ‘আমার হাত বান্ধিবি, পা বান্ধিবি, মন বান্ধিবি কেমনে’ গানটি এখন ঘুরে বেড়াচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে, নজর কাড়ছে সবারই। গত কয়েকদিনে কয়েক লাখ ভিউ, হাজার হাজার শেয়ার, লাইক ও কমেন্ট পড়ছে তার এই গানকে কেন্দ্র করে। দিনে দিনে গানটির জনপ্রিয়তা বাড়ছেই। কিন্তু কে এই দেব গৌতম? কী তার পরিচয়? সংগীতের সঙ্গে তার সম্পর্কটাই বা কতটা নিবিড়?

বিজ্ঞাপন

হালে গান গেয়ে জনপ্রিয় হয়ে উঠলেও দেব গৌতম বরাবরই গানের মানুষ। সুরকার ও সংগীত পরিচালক হিসেবে কাজ করছেন দীর্ঘদিন ধরে। যেহেতু দু’টি কাজই অন্তরালের, ফলে স্বাভাবিকভাবেই সংগীতের সঙ্গে অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িয়ে থাকলেও সেভাবে আলোচনায় আসেননি। এবারের এই করোনাকালে ঘরবন্দি সময়টায় নেপথ্যের কারিগর এসেছেন সামনে, তাতেই বাজিমাত।

অনলাইনের অলিগলি পেরিয়ে শেষ পর্যন্ত যোগাযোগ হলো দেব গৌতমের সঙ্গে। ভার্চুয়াল মাধ্যমে কথাও হলো সারাবাংলার সঙ্গে। জানালেন, জন্ম ও নিবাস পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগনা জেলার নৈহাটিতে। তবে পূর্বপুরুষরা সবাই বাংলাদেশের। দেব গৌতম বলেন, ‘মা-বাবা দু’জনেই পূর্ব বাংলার। ষাটের দশকে উনারা এ দেশে (ভারত) চলে আসেন। আমার বড় দুই ভাইয়ের জন্মও ওখানে (বাংলাদেশ)।’

বিজ্ঞাপন

বাড়িতে গানের আবহের মধ্য দিয়েই বড় হয়েছেন দেব গৌতম। যদিও ছবি আঁকার প্রতিই তার আগ্রহ বেশি ছিল। একটা সময় ক্যালিগ্রাফি করতেন। কিন্তু গানটাকেই মনেপ্রাণে গ্রহণ করেছেন তিনি। বললেন, ‘বাবা পেশায় চিকিৎসক ছিলেন, কিন্তু সারাদিন গান-বাজনা নিয়ে থাকতেই ভীষণ পছন্দ করতেন। পাশাপাশি যাত্রা এবং নাটকের সঙ্গেও সম্পৃক্ত ছিলেন। ফলে ছোটবেলা থেকেই আমার মধ্যেও এই একই নেশা। পড়ালেখার ফাঁকে গান নিয়ে থাকতেই ভাল লাগত। এরপর কখন যে এটা আমার পেশা হয়ে গেল, আমি নিজেও বুঝতে পারিনি। আমি আজ পর্যন্ত মিউজিক ছাড়া আর কিছুই করিনি। জীবনে কখনোই কোনো চাকরি বা অন্য কিছু করার চেষ্টাও করিনি। আর এখন গানই আমার সবকিছু।’

হঠাৎ গায়ক হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠা দেব গৌতমের গানের জগতে তার যাত্রা সুরকার ও সংগীতায়োজক হিসেবে। ২০০০ সালে তার প্রথম সুর করা গানে কণ্ঠ দিয়েছিলেন বাবুল সুপ্রিয়। এরপর অরুন্ধতি হোম চৌধুরী, সৈকত মিত্রসহ (কিংবদন্তী শিল্পী শ্যামল মিত্রের ছেলে) অনেকেই তার সুরে গেয়েছেন। পরিচালক শতরূপা সান্যালের হাত ধরে চলচ্চিত্রেও কাজ করার সুযোগ পেয়েছেন। সুর করেছেন অভিজিৎ গুহ ও সুদেষ্ণা রায়ের ‘জবরদখল’ ছবিতেও। লকডাউনের আগে একটি ছবির কাজ শুরুও করেছিলেন, কিন্তু করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে এখন সেটি থেমে আছে।

বিজ্ঞাপন

নেপথ্যে থেকে বেশ ভালোই কাজ করছিলেন দেব গৌতম। কিন্তু হঠাৎ করেই ভার্চুয়াল মিডিয়ায় তার সরব উপস্থিতি কেন! একজন সুরকার, সংগীতায়োজক থেকে গায়ক দেব গৌতমের আত্মপ্রকাশ কিভাবে?

জানতে চাইলে বললেন, ‘ব্যাপারটা খুবই মজার। লকডাউন না হলে শিল্পী হিসেবে হয়তো আমাকে কেউ চিনতই না। লকডাউন শুরু হলো, আমি বাড়িতে বসে থাকলাম, হাতে কোনো কাজ নেই। আমার বাড়িতে ছোট্ট একটা রেকর্ডিং স্টুডিও আছে, যেখানে আমি টুকটাক রেকর্ডিংয়ের কাজ করি। একদিন হঠাৎ মনে হলো— একটা গান রেকর্ড করে সোস্যাল মিডিয়ায় দিয়ে দেখি। প্রথমেই ভুপিন্দার সিংয়ের একটা গান রেকর্ড করে দিলাম। দেখলাম ১০ হাজার ভিউ হলো। বেশ ভালো লাগলো। শ্যামল মিত্রের একটা গান গেয়ে ফেসবুকে দিলাম। এটাও অনেক ভিউ হলো। অর্থাৎ অনেক মানুষ দেখছেন। বেশ উৎসাহ পেলাম। এরপর বলা যায় এক-দু’দিন পরপরই ফেসবুক আর ইউটিউব চ্যানেলে একে একে গান দিতে থাকলাম।’

গৌতমের প্রতিটি গানই সমাদৃত হয়েছে। তবে ব্যাপক সাড়া পেলেন ‘আমার হাত বান্ধিবি পা বান্ধিবি’ গানটিতে। ‘ভাইরাল’ হওয়া এই গানটি সম্পর্কে বলতে গিয়ে বেশ আবেগতাড়িত হয়ে পড়লেন দেব গৌতম। বললেন, ‘এটা আমার খুবই প্রিয় একটা গান। একদিন মনে হলো এই গানটা গাই। দোতারা ও হারমোনিয়াম সঙ্গে নিয়ে গাইলাম। ভাবতেই পারিনি এতটা সাড়া পাব। গানটা প্রথমে আমার পেজে ২৫ হাজার ভিউ হলো। এদিকে তমাল দাশ নামে একজন আমার পেজ থেকে গানটা নিয়ে তার নিজের পেজে শেয়ার দিলেন। সেখানে দেখলাম মুহূর্তেই প্রায় এক লাখ ৬০ হাজার ভিউ হয়ে গেল। এরপর আমি আবার আমার চ্যানেলে দিলাম, সেখানে এখনো পর্যন্ত প্রায় সাড়ে চার লাখ ভিউ হয়েছে।’

বিজ্ঞাপন

এই গানটি যে ভাইরাল হয়েছে, সেই খবরটি বাংলাদেশ থেকেই পেয়েছিলেন দেব গৌতম। বললেন, ‘এটা যে ভাইরাল হয়ে গেছে, সেটা আমি জানতামই না। বাংলাদেশ থেকে একজন ফোন করে বললেন গানটি ভাইরাল হয়েছে। উনি আমাকে সেই লিংকটা পাঠালেন। দেখলাম সেখানে প্রায় ৯ লাখ ভিউ। এরপর আমেরিকা থেকে এক ভদ্রলোক শেয়ার করলেন, তার ওখানে প্রায় চার লাখ ভিউ। এভাবে বিভিন্ন লিংক মিলিয়ে ৩০ লাখ ভিউ ছাড়িয়ে গেল। কিছুদিন আগেও আমার ইউটিউব চ্যানেলের সাবস্ক্রাইবার ছিল মাত্র তিন জন, এখন সেটা সাড়ে ১৫ হাজার ছাড়িয়ে গেছে!’

‘আমার হাত বান্ধিবি পা বান্ধিবি’ গানটি নিয়ে প্রতিনিয়তই শুভেচ্ছা বার্তা পাচ্ছেন দেব গৌতম। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তো বটেই, শ্রোতারা ফোন করেও তাদের মনের অনুভূতি জানাচ্ছেন। প্রশংসা করেছেন বড় মাপের শিল্পীরাও। দেব গৌতম বললেন, “গানটা প্রকাশ পাওয়ার পর থেকে প্রতিদিনই প্রচুর ফোন পাই। একদিন নচিকেতা ফোন করে বললেন, ‘তোর এই গানটা মনের ভেতর গিয়ে লাগে। শুনতে শুনতে কেমন জানি হয়ে যাই।’ ফোন করেছিলেন শিবাজি চট্টোপাধ্যায়ও। বললেন, ‘তোর গায়কি মন ছুঁয়ে গেছে।’ তাদের এই কথাগুলোই আমার এগিয়ে চলার পাথেয়।”

তবে কি করোনা আর লকডাউনের কারণেই গায়ক ‘দেব গৌতম’কে শ্রোতারা পেল? প্রশ্ন শুনে হেসে ফেললেন। বললেন, “সত্যিই তাই। পুরো ব্যাপারটাই কেমন জানি মিরাকল। গানের সুর আর অ্যারেজমেন্টের ব্যস্ততায় আমার গায়কি সত্তাটা হারিয়ে গিয়েছিল। আগে আমি গায়ক, তারপর সুরকার— এটা ভুলেই গিয়েছিলাম। এই সত্তাটা আমাকে ফিরিয়ে দিলো করোনাকালীন লকডাউন। এই দুঃসময়টা অনেকের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু আমার জন্য পজেটিভ হয়ে দেখা দিলো। ভাবতেই অবাক লাগে, লকডাউন না হলে আমি হয়তো কখনোই এভাবে গান গাইতাম না। কেউ জানতেও পারত না আমি গান গাইতে পারি। লকডাউনের এই কয়েকমাসে প্রায় ২০/২৫টা গান গেয়ে ফেললাম। বিশ্বের বিভিন্ন জায়গা থেকে বাঙালিরা ফোন করে তাদের ভালোলাগার কথাগুলো বলেন। তাদের একটাই কথা, ‘এতদিন কই ছিলেন? কেন লুকিয়ে ছিলেন?’ ওদের কী করে বুঝাই, লুকিয়ে ছিলাম না, মিউজিকের কাজ নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম। আসলে গানের নেপথ্যে যিনি কাজ করেন, তাকে তো নেপথ্যেই থাকতেই হয়।”

মেলোডিয়াস গানের প্রতি ভীষণ দুর্বলতা গৌতমের। নিজেকে একজন মূলধারার শিল্পীই মনে করেন তিনি। বললেন, ‘ছোটবেলা থেকে মূল ঘরানাতেই গান শিখেছি। সেটা আমার হৃদয়ে গেঁথে গেছে। সেটাকেই বয়ে নিয়ে যেতে চাই। ইদানীং গানের মধ্যে কেমন একটা পাগলামি ভাবের চল শুরু হয়েছে। আমি সেটা একদমই নিতে পারি না। হৃদয়গ্রাহী কোনো সুর নেই, কবিতার মতো গাইছে— এসব আমাকে টানে না। আমি বড় হয়েছি ভালো গান শুনে। মেহেদি হাসান, শ্যামল মিত্রের গান যেমন ভালোবাসি, তেমনি আবার ভালোবাসি আব্বাসউদ্দিন, শাহ আব্দুল করিমের গান। আমি ক্লাসিক্যাল ঘরানায় গান শিখেছি ঠিকই, কিন্তু মেলোডিয়াস যেকোনো গানই গাইতে ভালোবাসি। সেটা গজল, ঠুমরি, বৈঠকি বা ভজন— যাই হোক না কেন। সময়ের ভালো গানগুলোর সঙ্গে থাকতে চাই।’

শ্রোতাদের ভালোবাসা পেয়ে তাদের প্রতি দায়বদ্ধতাও অনুভব করছেন তিনি। সে কারণেই গায়ক হিসেবে যে যাত্রা শুরু করেছেন, আগামী দিনেও তা নিয়মিতই থাকবে বলে জানালেন। বললেন, ‘একটা অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন কাটাচ্ছি। আদৌ এর থেকে মুক্তি পাবো কি না, জানি না। একদিন হয়তো সবকিছুই আগের মতো হয়ে যাবে। তার জন্য আমাদের ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে হবে। তবে গান গাওয়াটা যেহেতু শুরু করেছি, আগামী দিনগুলোতেও সেটা নিয়মিত চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করব। শ্রোতারা আমাকে এত ভালোবেসেছে, এতটা আপন করে নিয়েছে, তাদের অবজ্ঞা করি কোন অধিকারে! সুর সৃষ্টির কাজ যেটা এতদিন করেছি, সেটা চলবে। তবে গান গাওয়াটাকেই বেশি প্রাধান্য দেবো। একটা সময় ছিল, গানটা সেভাবে গাওয়া হতো না। এটা হয়তো ঈশ্বরের আশীর্বাদ— আমাকে গানেই ফিরিয়ে নিলেন। অনেক দূরে সরে গিয়েছিলাম, আবার তিনি গানের পথেই আমাকে এগিয়ে দিলেন।’

গানের জগতে চলতে গিয়ে সহযোগিতা পাচ্ছেন সহধর্মিণী চন্দ্রানী চট্টোপাধ্যায়ের কাছ থেকেও। তার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বললেন, “আমার সাম্প্রতিক গাওয়া ‘তোমার শ্রাবণ ভেজার আগে আমার শ্রাবণ ভিজো’ গানটি ওরই লেখা। চন্দ্রানীর লেখা বেশ কয়েকটা গানে আমি সুর করেছি। অনেকেই গেয়েছেন। ওর সহযোগিতা পাচ্ছি বলেই গান নিয়ে সারাদিনই ডুবে থাকতে পারি।”

গান আর তার শিল্পী হয়ে ওঠার গল্প শুনতে শুনতে রাত গভীর হয়। শেষ হয়ে আসে আড্ডা। সবশেষে জানালেন, বাংলাদেশে আসার ভীষণ ইচ্ছা তার। বললেন, ‘আগেই বলেছি, আমার মা-বাবা দু’জনেই বাংলাদেশের। তাই একটা নাড়ির টান সবসময় অনুভব করি। একটা ব্যাপার বুঝতে পারি, বাংলাদেশের মানুষ গানটাকে সত্যিই ভীষণ ভালোবাসে। প্রচুর ফোন পাই। লকডাউনের পরপরই ওখানে যাওয়ার জন্য অনেকেই বলে রেখেছেন। হয়তো যাব, যেতে চাই।’

সারাবাংলা/এএসজি/টিআর

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন