বিজ্ঞাপন

হত্যার বিচার চাওয়ার সাহসও করেননি মৌলভী সৈয়দের সহযোদ্ধারা

August 11, 2020 | 6:52 pm

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট

চট্টগ্রাম ব্যুরো: পঁচাত্তরে স্বাধীনতার মহান স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নৃশংসভাবে হত্যার প্রতিবাদে একাত্তরের তিন গেরিলা যোদ্ধার নেতৃত্বে চট্টগ্রামে আন্দোলন-সংগ্রাম গড়ে শুরু হয়েছিল। এরা হলেন— মৌলভী সৈয়দ আহমদ, এস এম ইউসুফ ও এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী। পঁচাত্তরের পটপরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত তৎকালীন সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের রোষানলে পড়তে হয়েছিল তাদের। এদের মধ্যে চরম খেসারত দিতে হয়েছে মৌলভী সৈয়দকে। বন্দি অবস্থায় অকথ্য নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন, একপর্যায়ে মৃত্যুও হয়।

বিজ্ঞাপন

মঙ্গলবার (১১ আগস্ট) মৌলভী সৈয়দের মৃত্যুদিবস। তার সহযোদ্ধারা বলেছেন, সেদিন বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট এমন ছিল যে মৌলভী সৈয়দের পরিবার ও সহযোদ্ধারা এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের বিচারও চাইতে পারেননি। মুজিববিহীন বাংলাদেশে দুঃসহ পরিস্থিতিতে বিচার চাওয়ার কথা কেউ কল্পনায়ও আনতে পারেননি। সামরিক শাসনের বিদায় হয়েছে, দেশে গণতন্ত্র ফিরেছে। কিন্তু একজন অকুতোভয় যোদ্ধাকে হত্যার বিচার হয়নি, এই মর্মবেদনা নিয়ে বেঁচে আছেন তার সহযোদ্ধাদের অনেকেই।

চট্টগ্রামের বাঁশখালীর প্রত্যন্ত অঞ্চলে মাদ্রাসা থেকে আলেম পাশ করে মৌলভী সৈয়দ শহরে এসে সিটি কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন। ছাত্রলীগের রাজনীতিতে যুক্ত হয়েছিলেন নেতৃত্বের কাতারে।  ১৯৭১ সালের মার্চে ‘জয় বাংলা স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী’ গঠিত হয়েছিল, যার নেতৃত্বে ছিলেন মৌলভী সৈয়দ ও এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী (সাবেক মেয়র)। মৌলভী সৈয়দ একাত্তরে নৌকমান্ডোদের দুঃসাহসিক অপারেশন জ্যাকপটের অন্যতম কমান্ডার ছিলেন। গেরিলা কমান্ডার হিসেবে রনাঙ্গনে ছিল তার বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর মৌলভী সৈয়দ, এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীরা মিলে যে প্রতিরোধ সংগ্রামের পরিকল্পনা নেন, তাদের সঙ্গে ছিলেন তৎকালীন ছাত্রলীগ নেতা সৈয়দ মাহমুদুল ইসলামও, পরে তিনি চট্টগ্রাম মহানগর যুবলীগের আহ্বায়ক হয়েছিলেন। ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সেই সময়ের কথা সারাবাংলার কাছে তুলে ধরেছেন তিনি

বিজ্ঞাপন

মাহমুদুল ইসলাম বলেন, ‘আমি সিটি কলেজে পড়তাম। সৈয়দ ভাইয়ের শিষ্য ছিলাম। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর সৈয়দ ভাই-মহিউদ্দিন ভাইয়েরা আমাদের বললেন, আমরা প্রতিশোধ নেব। সশস্ত্র প্রতিরোধ সংগ্রামের পরিকল্পনা ছিল। প্রথমে এস এম ইউসুফ, এরপর মৌলভী সৈয়দ ও মহিউদ্দিন ভাই ভারতে যান। আমরা ছাত্রলীগের বেশ কয়েকজনও সৈয়দ ভাইয়ের সঙ্গে যাই। তখন বর্ডার দিয়ে সৈয়দ ভাই, আমরাও প্রায়ই দেশে আসা-যাওয়া করতাম। একবছর পর ১৯৭৬ সালের ৫ নভেম্বর আমরা চট্টগ্রাম শহরের নিউমার্কেট, দামপাড়া খালেক বিল্ডিংসহ কয়েকটি জায়গায় হাতবোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে আমাদের সংগ্রামের কথা জানিয়ে দিই। সেটা ছিল পুরোপুরি সৈয়দ ভাইয়ের পরিকল্পনা। তিনি তখন দেশে ছিলেন।’

মূলত সেই ঘটনার পর শাসকগোষ্ঠীর রোষানলে পড়ার কথা জানিয়ে মাহমুদুল বলেন, ‘তিনটি মামলা হয়। চট্টগ্রাম ষড়যন্ত্র মামলা। সবগুলোই মার্শাল ল’র অধীনে। প্রত্যেক মামলায় সৈয়দ ভাই প্রধান আসামি, মহিউদ্দিন ভাই দ্বিতীয়, এরপরে আমরা। মহিউদ্দিন ভাই ভারতেই ছিলেন। বিস্ফোরণ ঘটানোর সময় সৈয়দ ভাই দেওয়ানহাটে আমাদের বাসায় ছিলেন। তিনি সেখান থেকে বেরিয়ে প্রথমে অজ্ঞাতস্থানে চল যান, পরে কোনোমতে ভারতে চলে যান। সারাশহরে ব্লক রেইড দিয়ে গ্রেফতার অভিযান শুরু করে সেনাবাহিনী। ৭ নভেম্বর আমি, আমার বাবা, আমার ভাই, মামাতো ভাইসহ ছাত্রলীগ-যুবলীগের অনেক নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করে। আমাদের প্রথমে চট্টগ্রাম সেনানিবাসে, পরে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যাওয়া হয়।’

‘সেখানে আমাদের ওপর কিভাবে টর্চার করা হয়েছে, সেটা ভাষায় বলতে পারব না। তখন বয়স কম ছিল, সহ্য করেছি। চোখের সামনে বঙ্গবন্ধুর চেহারা ভেসে উঠত। এখন মাঝে মাঝে সেই নির্যাতনের কথা মনে পড়ে। কয়েকজন সহযোদ্ধাকে তখন হারিয়েছি, হায়রে রাজনীতি!’— কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন সৈয়দ মাহমুদুল ইসলাম।

বিজ্ঞাপন

ভারতে অবস্থানরত মৌলভী সৈয়দ ও এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর নির্দেশে চট্টগ্রাম শহরে ধারাবাহিক আরও কয়েকবার ঝটিকা মিছিল, হাতবোমা বিস্ফোরণসহ নানাভাবে প্রতিরোধ সংগ্রামের কর্মসূচি পালন করা হয় বলে জানান তিনি। তবে ভারতে ক্ষমতার পটপরিবর্তনে তাদের প্রতিরোধ সংগ্রামের পরিকল্পনায় ছেদ পড়ে বলেও তিনি জানিয়েছেন।

‘আমরা তখন জেলে। ভারতে মোরারজী দেশাই ক্ষমতায় আসল। জিয়াউর রহমানের সঙ্গে চুক্তি করলেন তিনি। এরপর সৈয়দ ভাইদের ওপর ভারতের আর্মি নির্যাতন শুরু করল। ময়মনসিংহ বর্ডারের কাছাকাছি এলাকায় সৈয়দ ভাইদের ঘাঁটি ছিল। সেটা একরাতে ইন্ডিয়ান আর্মি ঘিরে ফেলল। সৈয়দ ভাইসহ কয়েকজনকে ধরে ১৯৭৭ সালের ৬ আগস্ট ময়মনসিংহ বর্ডার দিয়ে বাংলাদেশে পুশব্যাক করে ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী। সৈয়দ ভাই গ্রেফতার হলেন। তাকে প্রথমে ময়মনসিংহ ক্যান্টনমেন্টে, এরপর ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে নেওয়া হলো। একজন পুলিশ সুবেদারের মাধ্যমে তিনি আমার মায়ের কাছে কিছু টাকা চেয়ে চিঠি লিখেছিলেন,’— বলেন মাহমুদুল।

১০ আগস্ট যৌথবাহিনীর কয়েকজন সদস্য কারাগারে মাহমুদুলের কাছে যান এবং তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। তিনি বলেন, ‘তখন জানতে পারি, সৈয়দ ভাই গ্রেফতার হয়েছেন। উনাকে অনেক টর্চার করা হয়েছে, তাদের কথাবার্তাই বুঝতে পারি। পরদিন উনাকে মেরে ফেলা হয়। আমরা সৈয়দ ভাইকে হারালাম। সেটাও আমরা কারাগারে বসেই জানতে পারি।’

মৌলভী সৈয়দের এক ভাই মুক্তিযোদ্ধা আলী আশরাফ চলতি বছরের ২৬ জুলাই ৮৫ বছর বয়সে মারা যান। জীবদ্দশায় এক গণমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছিলেন, তার বাবা একরাম সিকদারকে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সেখানে ১২-১৩ জনের লাশ বরফ দিয়ে রাখা হয়েছিল। তার বাবাকে বলা হল ছেলের লাশ খুঁজে নিতে। বাবা একটি একটি লাশ উল্টেপাল্টে মৌলভী সৈয়দের রক্তাক্ত-ক্ষতবিক্ষত লাশ খুঁজে নেন। পরে তার বাবা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। ১৯৮৭ সালে তিনি মারা যান। মৌলভী সৈয়দের মাও প্রায় উন্মাদ অবস্থায় ১৯৯০ সালে মারা যান।

বিজ্ঞাপন

মৌলভী সৈয়দের জীবিত সহযোদ্ধাদের অন্যতম মাহমুদুল ইসলাম বলেন, ‘কোনো শাসকগোষ্ঠী এত নির্মম-নিষ্ঠুর হতে পারে, এটা কল্পনাও করা যায় না। আমাকে গ্রেফতারের পর খবর নিতে আমার মা গিয়েছিলেন তৎকালীন মেজর রবের বাসায়। তিনি আমার মাকে লাথি মেরে ফেলে দিয়েছিলেন। পরিস্থিতি এমন ছিল যে, প্রতিমুহূর্তে মনে হতো আজই বুঝি আমার শেষদিন। পরিবারের সদস্যরা আমাকে জীবিত ফেরত পাবেন ভাবেননি, সবসময় আমার লাশের অপেক্ষায় থাকতেন।’

‘সৈয়দ ভাইয়ের পরিবারের সদস্যরা ছিলেন অসহায়। পুরো পরিবার এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল। বিচার পাওয়া দূরে থাক, সেই দাবিও তাদের পরিবারের মাথায় আসেনি। আমি ১৯৮০ সালে জেল থেকে ছাড়া পাই। তখনও জিয়াউর রহমান ক্ষমতায়। এরপর এরশাদ ক্ষমতায় এলেন। আবার সামরিক শাসন। বিচার কার কাছে চাইব? তারাই বিচার করছে, তারাই ফাঁসি দিচ্ছে, তারাই দণ্ড দিচ্ছে, তারাই মেরে ফেলছে। সব তো তারাই করছে। মৌলভী সৈয়দের হত্যার ঘটনায় মামলা পর্যন্ত হয়নি। যেখানে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার বিচার ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ দিয়ে বন্ধ করে রাখা হয়েছে, সেখানে মৌলভী সৈয়দের হত্যার বিচার চাওয়ার সাহসও আমাদের হয়নি।’

‘সৈয়দ ভাই প্রকৃতই একজন দেশপ্রেমিক ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক ছিলেন। উনাকে আমরা হারিয়েছি। উনার ভাবশিষ্য হিসেবে আমরা যারা এখনও রাজনীতির মাঠে আছি, একটা আক্ষেপ আমাদের আজীবন থেকেই যাবে,’— আবেগাক্রান্ত হয়ে বললেন মাহমুদুল ইসলাম।

সারাবাংলা/আরডি/টিআর

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন