বিজ্ঞাপন

সম্পত্তিতে সমান অধিকার কবে পাবে নারী?

August 12, 2020 | 6:02 pm

তিথি চক্রবর্তী, ফিচার রাইটার

একজন নারীর মাথা উঁচু করে চলার জন্য তার নিজস্ব সম্পত্তি থাকার বিকল্প নাই। এতে তার পারিবারিক ও সামাজিক অবস্থান শক্ত হয়। কিন্তু যুগ যুগ ধরেই নারীর নিজস্ব সম্পত্তি অর্জনে রয়েছে নানা বাধা। নিজেরা আয় করলেও অধিকাংশ নারী নিজের নামে সম্পত্তি কেনা তো দূরের কথা, অনেকের ইচ্ছামতো খরচের অধিকারও নাই। অধিকাংশ নারী এখনও আয় করেন না বা আয় বৈষম্যের শিকার। এ ছাড়াও মা-বাবার সম্পত্তি পাওয়ার ক্ষেত্রে রয়েছে ব্যাপক বৈষম্য। এদেশে সাধারণত উত্তরাধিকারসূত্রে ছেলেরাই সম্পত্তি পেয়ে থাকে। মুসলিম নারীরা বাবার সম্পত্তির ভাগ পেলেও সামাজিক প্রথা বিবেচনা করে সেই সম্পত্তি ভাইদের দিয়ে দেন। অর্থাৎ, রাষ্ট্র ও ধর্ম অধিকার দিলেও সমাজের কটু কথার ভয়ে অনেক নারী প্রয়োজন সত্ত্বেও বাবার সম্পত্তি নেন না। এভাবে সম্পত্তি বঞ্চিত নারীরা পরিবার, রাষ্ট্র ও সমাজে পিছিয়ে থাকেন।

বিজ্ঞাপন

আবার প্রচলিত আইনি ব্যবস্থার মধ্যেই আছে নারীর বঞ্চিত হওয়ার প্রেক্ষাপট। এই বঞ্চনা সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে এবং বৈষম্যকে আরও জোরালো করেছে। অবস্থা এমন যে, প্রাপ্য অধিকারটুকু পেতেও নানা হয়রানির শিকার হতে হয় নারীকে। সামাজিক, ধর্মীয় বিশ্বাস ও চর্চার মধ্য দিয়ে নারীর বঞ্চনা সমাজে প্রতিষ্ঠিত। নারীকে অবদমন করার প্রক্রিয়া রাজনীতি, অর্থনীতি, আইন, সংস্কৃতি কিংবা ধর্মীয়- সকল দিক থেকেই এই সমাজে চালু রয়েছে। প্রত্যেক ধর্মে প্রচলিত পারিবারিক আইন বৈষম্যমূলক। প্রাপ্যটুকু পেতেও নানাধরনের সমস্যার মুখে পড়তে হয় নারীকে। আসুন দেখে নেই উত্তরাধিকার আইন সম্পর্কে কোন ধর্মে কী বলা হয়েছে।

মুসলিম পারিবারিক আইন
ইসলামে বাবা-মা ও স্বামীর সম্পত্তিতে নারীর অধিকার দেওয়া হয়েছে। নারী পায় পুরুষের অর্ধেক পরিমাণ সম্পত্তি। স্বামীর সম্পত্তির ওপরও মেয়েদের ভাগ আছে। স্বামী সন্তান রেখে মারা গেলে স্ত্রী পায় ৮ ভাগের ১ ভাগ। আর সন্তান না রেখে মারা গেলে ৪ ভাগের ১ ভাগ।

হিন্দু উত্তোরাধিকার আইন বৈষম্যমূলক
হিন্দু আইনে নারীকে ন্যূনতম সম্পত্তির অধিকার দেওয়া হয়নি। বাবা বা স্বামীর সম্পত্তিতে মেয়েদের কোন অধিকার নেই। মেয়েকে বিয়ের সময় যে উপহার (স্ত্রীধন) দেওয়া হয় সেটিই মেয়ের সম্পত্তি হিসেবে গণ্য হয়। শুধু তাই নয়, বিয়ে বিচ্ছেদ বলে হিন্দু আইনে কিছু নেই। স্বামী-স্ত্রীর মতের অমিল হলে দুজন আলাদা থাকতে পারে কিন্তু কিছুতেই বিচ্ছেদ নয়। বিয়ে মানেই নারীকে স্বামীর কাছে সমর্পিত হতে হবে। প্রচলিত হিন্দু আইন অনুযায়ী হিন্দু নারীরা কিছু শর্ত সাপেক্ষে সম্পত্তির মালিক হন।

বিজ্ঞাপন

বৌদ্ধ ধর্মেও নারী অধঃস্তন
বৌদ্ধ সমাজ সাধারণত হিন্দু আইন মেনে চলে। তাদের আলাদা কোন আইন নেই। এজন্য বৌদ্ধ ধর্মেও নারীরা সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত। বিয়ে বিচ্ছেদেরও উপায় নেই।

খ্রিষ্টান ধর্মে সম্পত্তিতে সমানাধিকার
খ্রিষ্টান ধর্মে সম্পত্তিতে বাবার সম্পত্তিতে মেয়েরা সমান অধিকার পায়। আবার স্বামীর সম্পত্তিতেও স্ত্রীর অধিকার আছে। এই ধর্মে বিয়ের ক্ষেত্রে রেজিষ্ট্রেশন প্রথা চালু আছে। এখানে চার্চের ভূমিকাই প্রধান।

নির্দিষ্ট কাঠামো নেই ক্ষুদ্র জাতিসত্তার নারীদের 
ক্ষুদ্র জাতিসত্তার নারীর বেলায় সম্পত্তির হিসাব-নিকাশ চলে নিজস্ব প্রথাগত নিয়মে। মাতৃপ্রধান সমাজব্যবস্থায় নারীরা বাবা ও স্বামীর সম্পত্তি পায়। যেমন গারো ও খাসিয়া নারীরা সম্পত্তির উত্তরাধিকার পায়। আর চাকমাদের মধ্যে পুত্র না থাকলেই কেবল কন্যারা উত্তরাধিকার হয়।

বিজ্ঞাপন

হিন্দু, বৌদ্ধ কিংবা আদিবাসী নারীদের সম্পত্তির অধিকারের তুলনায় মুসলিম পারিবারিক আইন কিছুটা কম বৈষম্যমূলক। তবে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া সম্পত্তি বেশিরভাগ নারীই নিতে পারেন না। সম্পত্তি না নেওয়ার পেছেনে কারণগুলো হলো-
– সম্পত্তি নিলে বাবা ও ভাইদের সাথে সম্পর্ক খারাপ হবে
– ছেলেই যেহেতু বাবা-মাকে দেখবে, তাই ছেলে একটু বেশি সম্পত্তি পাবে 
– বাবা কিংবা ভাইয়ের আপত্তিতে সম্পত্তি নিলে সংসারে সুখ আসে না, এমন ধারণার প্রচার
– মেয়ের ভালো ঘরে বিয়ে হয়েছে, সম্পত্তির কী দরকার
– স্বামীর সম্পত্তির কিছু অংশ মেয়ে তো পাবেই, বাবার সম্পত্তি তাই লাগবে না

তাই ইসলাম ধর্মে বাবার সম্পত্তির কিছু অংশ মেয়েরা পেলেও তা পেতে ভোগান্তির শেষ নেই। যেন সম্পত্তিটা মেয়েদের ক্ষেত্রে পাওনা নয়, একরকম ‘করুণা’। কথা হচ্ছিল গৃহিণী সেলিনা রহমানের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘বাবার সম্পত্তি একেবারে কম না। কিন্তু আমার তিন ভাই সেগুলো ভোগ করছে। আমার স্বামী সরকারি চাকুরিজীবী। সংসারে আর্থিক সমস্যা নেই। বাবা বেঁচে থাকতে সম্পত্তি ভাগ করে দেননি। তাই বাবার মৃত্যুর পর ভাইদের সাথে সম্পত্তি নিয়ে আলাপ করতে লজ্জাবোধ হয়।’

হিন্দু নারী প্রমিলা সরকার জানান, বিয়ের সময় তার বাবা ৩ ভরি গহনা ও হাতে সামান্য কিছু টাকা দিয়েছিলেন। সেটুকুই সম্বল। এ্রর বাইরে তিনি কিছুই পাননি। তারা দুই ভাই ও এক বোন। বাবা বা স্বামী কারও সম্পত্তিই তিনি দাবি করতে পারেন না। কারণ সেই অধিকারই তার নেই।

আসুন দেখে নেই সব নাগরিকের সমান অধিকার রক্ষার ধারক সংবিধানে এ সম্পর্কে কি লেখা আছে-  সংবিধানের ধারা ২৮ এর অনুচ্ছেদ ১ অনুযায়ী, ‘কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষভেদে বা জন্মস্থানের কারণে কোন নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করিবেন না।’ এর অর্থ দাঁড়ায়, সামাজিক-অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক ও মতাদর্শিক ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের মধ্যে বৈষম্য রাষ্ট্রীয়ভাবে অবৈধ। অথচ বাস্তবতা পুরোপুরি ভিন্ন। সংবিধানের সঙ্গে বিরোধ রেখে উত্তরাধিকার ও সন্তানের ওপর কর্তৃত্বের বিষয়টি বিভিন্ন ধর্মের আইন দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। তাই সংবিধান ও প্রচলিত আইনের প্রয়োগ- এই দুটি বিষয়ের মেলবন্ধন নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়।

বিজ্ঞাপন

এই অবস্থা বিদ্যমান থাকলে সংবিধানে সকল নাগরিকের সমান অধিকার রক্ষার অঙ্গিকার অর্থহীন হয়ে পড়ে কী না জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন এন্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের প্রভাষক গুলে জান্নাত বলেন, ‘কিছু ধর্মে মেয়েরা সম্পত্তির অধিকার পেলেও সম্পত্তি ভোগ ও ব্যবহারের ক্ষেত্রে চরম বৈষম্য লক্ষ্য করা যায়। বাবা বা স্বামীর সম্পত্তি মেয়েকে দিলেও পুরুষদের মতো সম্পত্তি ভোগের ক্ষেত্রে নারীর স্বাধীনতা নেই। যেমন সম্পত্তি বিক্রি, বন্টনসহ নানা ক্ষেত্রে বৈষম্য আছে। সম্পত্তির এই অধিকারহীনতা থাকার পেছনে ‘আইনের ফাঁকফোকর’কে দায়ী।’

তিনি বলেন, নারীর ক্ষমতায়ন অনেক ক্ষেত্রে হচ্ছে। তবে সম্পত্তির অধিকারে বৈষম্য রেখে পরিপূর্ণ ক্ষমতায়ন সম্ভব না। নারীর আয়ের পথ বা অর্থনৈতিক স্বাধীনতার জন্য দরকার সম্পত্তির অধিকার। তিনি আরও বলেন, অভিন্ন পারিবারিক আইনের প্রতি রাষ্ট্রীয়ভাবে গুরুত্বারোপ করা হচ্ছে না। এক্ষেত্রে বড় কারণ হলো, ধর্মীয় অনুভূতি ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা। আমাদের দেশে ধর্ম একটি বড় ব্যাপার। যেমন: বাল্যবিবাহ নিয়ে অনেক আলোচনা হচ্ছে। বিবাহের বয়সও নির্ধারণ করে দেওয়া হলো। তবে এই আইনের শেষেও একটি কথা আছে, ‘অভিভাবক চাইলে ভিন্ন কিছু হতে পারে’। এভাবে আইনের ফাঁক রেখেই দেওয়া হয়।
অভিভাবকরাও অনেকসময় মেয়েকে সম্পত্তির ভাগ দিতে চায় না। এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, প্রচলিত সমাজের চিন্তাধারা অনুযায়ী শেষ বয়সে বাবা-মায়ের দায়িত্ব ছেলেরাই নেয়। আবার মেয়েরা সম্পত্তি চাইতে সংকোচবোধ করে। ভাবে, সম্পত্তি চাইলে আর ওই বাড়িতে তার অধিকার থাকবে না। একারণে মেয়েরা তাদের পাওনা দাবি করতে পারে না।’

সম্পত্তিতে নারীর সমান অধিকার প্রসঙ্গে জানতে চাইলে গুলে জান্নাত বলেন, ‘সম্পত্তিতে নারীর প্রতি বৈষম্য দূর করার জন্য অভিন্ন পারিবারিক আইন থাকা দরকার। আর রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে এ ব্যাপারে উদ্যোগ নেওয়া দরকার। মেয়েরা এখন অনেক এগিয়ে গেছে। অন্য অনেক মৌলিক অধিকারের মতো সম্পত্তিও নারীর অন্যতম মৌলিক অধিকার। আর সম্পত্তির অধিকার পেলে নারী যেন তা নিজের মতো ভোগ ও ব্যবহার করতে পারে সেই উদ্যোগ নিতে হবে।’

সিডও সনদের সংরক্ষিত দুটি ধারায় কী আছে
জাতিসংঘ কর্তৃক ১৯৮১ সালের ৩ সেপ্টেম্বর সিডও সনদ বা নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য নিরসন সনদ গৃহীত হয়। এই সনদকে বল হয় উওম্যান’স বিল অব র‌্যাবিটস। এতে ৩০ টি ধারা রয়েছে। ১ থেকে ১৬ নম্বর ধারা পর্যন্ত নারী-পুরুষের সমতা সংক্রান্ত নীতিমালা বর্ণনা করা হয়েছে।

সিডও সনদের ২ ও ১৬ নম্বর ধারা আমাদের দেশে অনুমোদন করা হয়নি। ২ নম্বর ধারায় বলা আছে, নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য নিরসনে শরিক দেশগুলো আইনগত ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেবে এবং আইনের সংস্কার করবে। ১৬.১ (গ) ধারায় বিবাহ এবং বিবাহবিচ্ছেদের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমান অধিকার ও দায়িত্বের কথা বলা আছে।

এই দুটি ধারা অনুমোদন না করার পেছনে রাষ্ট্রের যুক্তি হলো, এদেশের বেশিরভাগ মানুষ ইসলাম ধর্মের অনুসারী। ধর্মীয় অনুশাসন মেনে তালাক ও সম্পত্তি বন্টন হয়। সিডও সনদের সম্পূর্ণ অনুমোদন দিলে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানতে পারে। এর কারণ জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক অর্পিতা শামস্ মিজান বলেন, ‘সকল মানুষের জন্য রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে একরকম নিয়ম আর পারিবারিক ক্ষেত্রে আরেক ধরনের নিয়ম চালু আছে। অর্থাৎ সরকারি নিয়মের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষ ধনী বা গরীবে পার্থক্য নেই। যেমন: একজন নারীর গাড়ি কিনতে গেলে ভ্যাট যা দিতে হবে, একজন পুরুষেরও তাই দিতে হবে। তবে পারিবারিক ও উত্তরাধিকার আইন একেক ধর্মে একেকরকম।’

অভিন্ন পারিবারিক আইনের ব্যাপারে এই শিক্ষক বলেন, ‘আমাদের দেশের অনেক ঘটনাগুলোই ধর্মকে কেন্দ্র করে। যেমন ৪৭ এর দেশভাগ বড় একটি ঘটনা যেখানে ধর্মীয় ব্যাপারটি প্রধান ছিল। ধর্মের কারণে সংখ্যাগরিষ্ঠ ও সংখ্যালঘুদের ব্যাপারটি সামনে থাকে। সমান অধিকারের কথা আসলে সংখ্যালঘুরা মনে করে, পরিবর্তন হলে আমাদের ধর্ম নষ্ট হতে পারে। আবার সংখ্যায় যারা বেশি তারা মনে করে, তাদের ওপর নেতিবাচক কিছু আসবে কিনা। এমন নানা ভাবনা থেকে অভিন্ন পারিবারিক আইন করা সম্ভব হচ্ছে না।’

তিনি বলেন, ‘অনেকেই মনে করেন মেয়েদের সমান সম্পত্তি দিলে তা শরীয়ত মোতাবেক ঠিক হয়না। অথচ বিষয়টি মোটেও ঠিক না। কারণ মুসলিম আইনে বলা আছে, ছেলেরা মেয়েদের অর্ধেক সম্পত্তি পাবে। তবে বাবা চাইলে ছেলে মেয়েকে সমান সম্পত্তি দিতে পারে। ধর্ম ও রাজনীতি দুটো বিষয়ই এক্ষেত্রে জড়িত। আমার মতে এসকল সমস্যার সমাধানের উপায় হলো, প্রতিটি ধর্মীয় আইনে নারী-পুরুষের বৈষম্য কমানো যেতে পারে।’

সিডও সনদ প্রসঙ্গে অর্পিতা শামস্ মিজান বলেন, নারীর বৈষম্য নিরসনের জন্য আনা সিডও সনদের মূল দুটি ধারা অনুমোদন না দেওয়া সমর্থনযোগ্য নয়। আন্তর্জাতিক আইনে সাক্ষর না দেওয়াকে উৎসাহিত করা মোটেও উচিত না। এতে আইনের মূল আবেদনটিই নষ্ট হয়। এক্ষেত্রে বলা হচ্ছে, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানবে। আমি মনে করি, সম্পত্তিতে নারীদের সমান অধিকার নিয়ে ভুল বোঝাবুঝি আছে। মিসর এবং আলজেরিয়া মুসলিম রাষ্ট্র। এই দুটি রাষ্ট্রও সম্পত্তিতে নারী-পুরুষের সমান ভাগ দিয়েছে। ধর্মীয় দিক থেকে তাদের কোন সমস্যা হচ্ছে না। শরীয়তের বাইরেও ব্যাপারটি চলে গেল না।’

হিন্দুধর্মের ব্যাপারটি নিয়ে তিনি বলেন, বৃটিশ আমলে হিন্দুদের উত্তরাধিকার একটি আইন ছিল। অবিবাহিত নারী বাবার সম্পত্তির একটি অংশ পাবে। আর বিবাহিত নারীর যদি ছেলে থাকে তাহলে সেই ছেলে সম্পত্তির কিছু অংশ পাবে। স্বাধীনতার পর ভারত এই আইন পরিবর্তন করে। বাবার সম্পত্তিতে ছেলে ও মেয়ের সমান ভাগ এবং স্বামীর সম্পত্তিতেও স্ত্রীর অধিকার আছে। কিন্তু আমাদের দেশে হিন্দু আইন সংস্কার হয়নি। ফলে সম্পত্তিতে নারীর সমান অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি।

সম্পত্তিতে ছেলে-মেয়ের সমান অধিকার

সম্পত্তির অধিকার ছাড়া নারীর এগিয়ে যাওয়া বা নারীর ক্ষমতায়ন সম্ভব কিনা জানতে চাইলে অর্পিতা বলেন, সম্পত্তিতে সমান অধিকার না পাওয়া মানেই অর্থনৈতিক দিক থেকে নারীর পিছিয়ে যাওয়া। যেকোন ক্ষেত্রে পিছিয়ে যাওয়া মানেই সেখান থেকে এগিয়ে যাওয়া কঠিন।

সম্পত্তিতে নারীদের এই বৈষম্য দূর করার জন্য কি ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া উচিত বলে মনে করেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘মেয়েরা যতটুকু সম্পত্তি পায় সেটুকুও অনেক সময় নিতে পারে না। ভাবে, সম্পত্তি চাইলে বাবার বাড়ির সাথে তার সম্পর্ক খারাপ হয়ে যাবে। আরও অনেক কারণে মেয়েরা সম্পত্তি চায় না। এ ধরনের মানসিকতা থেকে মেয়েদের একেবারে বেরিয়ে আসা উচিত বলে আমি মনে করি। ছেলেরা যদি সম্পত্তির অংশীদারিত্ব থেকে পিছিয়ে না যায়, তাহলে মেয়েরা কেন যাবে? মেয়েদের বিয়ের সাথে সম্পত্তির ভাগ ছেড়ে দেওয়া বা আপোষহীন থাকার কোন সুযোগ নাই। নারীকে বুঝতে হবে, এটা তার অধিকার। সে যখন চাইবে তখনই পরিবার তাকে দিতে বাধ্য। এই অধিকার ছেড়ে দেওয়া মোটেও উচিত না।’

প্রাপ্য সম্পত্তি ব্যবহারে নারীর পরাধীনতা বিষয়ে অর্পিতা বলেন, মুসলিম ধর্মে নারী তার সম্পত্তি যে কাউকে দিতে পারে। তবে এক তৃতীয়াংশ সম্পত্তি উইল করলে সম্পত্তির অংশীদার আটজনের সাথে কথা বলতে হয়। আর হিন্দু বিধবা নারী জীবনসত্ত্বায় স্বামীর সম্পত্তি ভোগ করতে পারেন। তিনি মারা গেলে এই সম্পত্তির ভাগ পায় ছেলে, ভাতিজা কিংবা ভাইয়েরা। বিধবা স্ত্রী তার জীবদ্দশায় সম্পত্তি বিক্রি করতে পারেন না। তবে তার স্বামীর যদি কোন ঋণ থাকে অথবা তার অন্ত্যষ্টিক্রিয়া বা শ্রাদ্ধ করার জন্য সম্পত্তি বিক্রি করে ঋণ শোধ করার ক্ষমতা রাখে।

অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে সংবিধানে ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ নির্বিশেষে সমানাধিকারের কথা বলা হলেও নানা কারণে উত্তরাধিকার আইন নারীর উপযোগী করা হচ্ছে না। অথচ,  বাংলাদেশের গত কয়েক দশকের অর্থনৈতিক অগ্রগতির চিত্র বলে নারীরাই উন্নয়নের যাত্রায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। বিভিন্ন পর্যায়ে কাজ করে তারা দেশের অর্থনীতি এগিয়ে নিতে ভূমিকা রাখছেন। তাছাড়া দেখা গেছে নারী শিক্ষিত ও সামর্থ্যবান হলে তারা সন্তানের শিক্ষা ও জীবনমান উন্নয়নে ভূমিকা রাখেন। আর বাবা-মাকে বৃদ্ধ বয়সে ছেলেরা দেখবে বলে যে ধারণা সমাজে প্রচলিত তাও ভ্রান্ত বলেই প্রমাণিত হয়েছে। কারণ, একজন স্বাবলম্বী নারী তার বাবা-মায়ের দায়িত্ব নিচ্ছেন হাসিমুখেই। তাই ছেলে সন্তানকে বেশি সম্পত্তি দেওয়ার এই যুক্তি আর প্রযোজ্য নয়। নারীর চলার পথ মসৃণ করতে রাষ্ট্র উত্তরাধিকার আইন সংশোধনে উদ্যোগ নেবে বলেই সকলের প্রত্যাশা।

সারাবাংলা/আরএফ

Tags: , , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন