Saturday 14 Jun 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

জীবিত মুজিবের চেয়ে মৃত মুজিব অনেক শক্তিশালী


১৪ আগস্ট ২০২০ ০১:১০ | আপডেট: ১৪ আগস্ট ২০২০ ০১:১১
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

আগস্ট মাস, বাঙ্গালী জাতীর জন্য দুঃস্বপ্নের মাস। আগস্ট বাঙ্গালির জীবনে শুধু শোকের নয়; এক অভিশপ্ত মাসও বটে। এটি বাঙ্গালি জাতির

ইতিহাসে কলঙ্কের কালিমালিপ্ত একটি মাস। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙ্গালি ও মহান স্বাধীনতার স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৫
সালের ১৫ আগস্ট কাল রাতে সেনাবাহিনীর কিছু বিপথগামী উচ্ছৃঙ্খল  সদস্যের হাতে সপরিবারে নির্মমভাবে নিহত হোন। সেই সর্বনাশা রাতের
দৃশ্যপট মানসচক্ষে একবার ভেসে উঠলেই শিহরিত হতে হয়। ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়ির সিঁড়িতে জাতির জনকের রক্তাক্ত মৃতদেহ। বাড়ির অন্যত্র ছড়ানো-ছিটানো বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী মহীয়সী নারী বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, জ্যেষ্ঠ পুত্র শেখ কামাল, তার স্ত্রী সুলতানা কামাল, অপর পুত্র শেখ জামাল ও তার স্ত্রী রোজী জামাল, কনিষ্ঠ পুত্র শেখ রাসেল, ভাই শেখ নাসের ও কর্নেল জামিলের নিথর মৃতদেহ।

বিজ্ঞাপন

অন্য বাড়িতে শেখ ফজলুল হক মনি, তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মনি, আবদুর রব সেরনিয়াবাত, শহীদ সেরনিয়াবাত, শিশু বাবু, আরিফ, রিন্টু খানসহ অনেকের লাশ। এ যেন ছিল খুনিদের অদম্য রক্ত-পিপাসা। সেই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে শুধু সরকার বদলই নয়, মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে পাওয়া জাতির অনেক অর্জনকে নস্যাৎ করা হয়েছিল, বদলে দেওয়া হয়েছিল দেশের সংবিধান ও মূলনীতি। সেই শোক, সেই বেদনা, সেই ক্ষোভ বুকে নিয়েই দেশবাসী কাটিয়েছে এই দীর্ঘ সময়। তবে এবার এই আগস্টে অবস্থার কিছুটা পরিবর্তন ঘটেছে।

সেই যে মানুষটি ভালবেসেছিলেন বাঙ্গালী জাতিকে। বীর হতে চাননি শুধু,  ভয় পাননি শহীদ হতে। রক্ত দিয়ে দেশবাসীর ভালোবাসার ঋণ পরিশোধ করতে প্রস্তুত ছিলেন সর্বদা। তাকে কী করে ভুলবে বাঙ্গালী? সেই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। সিঁড়িতে পরে আছে বাঙ্গালী জাতীর প্রাণপ্রিয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর
রহমানের রক্তমাখা নিথর দেহ। সিঁড়ি গড়িয়ে রক্ত চলে গেছে বাহির আঙ্গিনায়। মহান সেই নেতার রক্ত শোধা মাটিতে মিশে গেছে। তা ভুলে কী করে বাঙ্গালী?

তিনি তো শুধু প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতি ছিলেন না, ছিলেন না দল বিশেষের প্রধান। দীর্ঘ দিবস, দীর্ঘ রজনী ঝড়-মেঘ ইতিহাসের পথে আমাদের যাত্রায় তিনি ছিলেন সঙ্গী, পথপ্রদর্শক। তাকে ভুলব কেমন করে? তাকে কী ভুলা যায় কখনো? তাইতো ইতিহাসের এই মহানায়কের উদ্দেশে কবি লিখেছিলেন, “যতদিন রবে পদ্মা, মেঘনা, গৌরী, যমুনা বহমান, ততদিন রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান”।

যিনি আমাদের এক দেশমাতৃকা উপহার দিলেন সেই তাকেই কতো না নির্মমভাবে হত্যা করা হলো। শুধু তই নয় হত্যাকারীরা তার কবর তিন মাস পর্যন্ত পাহারাও দিয়েছে। সেখানে কাউকে যেতে দেওয়া হয়নি। এমনকি দীর্ঘদিন বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের ছবি এদেশে নিষিদ্ধ ছিল। বঙ্গবন্ধুর কবর দেখতে না দেওয়া, তার হত্যার ছবি প্রকাশে নিষেধাজ্ঞার মূল কারণ ঘৃণ্য হন্তারক ওই সামরিক শাসকরা তাতে ভয় পেতো। তাদের ভয়টা ছিল এখানেই যে, তারা নিশ্চিত জানতো জীবিত বঙ্গবন্ধুর চেয়ে মৃত বঙ্গবন্ধু অনেক বেশী শক্তিশালী। তারা আরও জানতো সে সময় এসব ছবি প্রকাশ পেলে কোন কিছুতেই বাঙ্গালীকে দাবিয়ে রাখা যাবে না।

বঙ্গবন্ধু হত্যার কলঙ্ক কোনোদিন ঘুচবার নয়, তাকে এভাবে হারানোর বেদনার কোনো উপশম নেই। তারপরও সান্ত্বনা এটুকু যে, জাতির জনকের হত্যাকাণ্ডের বিচার হয়েছে এবং খুনিদের অন্তত পাঁচ জনের ফাঁসি হয়েছে। যে আত্মস্বীকৃত হত্যাকারীরা জাতির জনককে হত্যার কথা দম্ভের সঙ্গে বলে বেড়াতো, এই আগস্টে তারা নিজেদের অপরাধের সমুচিত শাস্তি মাথায় নিয়ে ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে।

তবে বাংলাদেশে লম্বা একটি সময় এই বিশ্বের জঘন্যতম এই হত্যাকাণ্ডের বিচার হচ্ছিল না। বিচারের নামে চলছিল প্রহসন। একটি ঘৃণ্যমহল জাতীর জনকের হত্যার বিচার হউক তা চাইছিল না বলেই বিলম্বিত হচ্ছিলো বারবার। তাদের হেলাফেলায় অনেক সময় গড়িয়ে গেল। একে একে কেটে
গেল কয়েক যুগ। সময় অনেক গড়ালেও এ জাতি তাদের জনকের হত্যার বিচার পেয়েছে। এটাই বড় আত্মতৃপ্তির। হত্যাকারীদের ফাঁসির বিষয় নিয়ে যারা এতদিন অতৃপ্ত ছিলেন তারা এখন তৃপ্তির ঢেকোর তুলছেন। এদের সাথে আমি আজ সুখ অনুভব করছি।

কী নিষ্ঠুর ইতিহাস। যিনি জাতির জন্ম দিলেন, যার জন্ম না হলে এদেশের জন্মই হতো না,  সেই জাতির জনককে কি নিষ্ঠুর ভাবেই না হত্যা করা হলো। জাতীর জনকের বাসভবনে রক্তের বন্যা বইয়ে দেয়া হলো সেদিন। শিশু রাসেলের কান্না আর আকুতিও ওদের হৃদয় স্পর্শ করেনি। আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার ছোট বোন রেহানা ছাড়া বঙ্গবন্ধু পরিবারের কেউই বেঁচে নেই। পঁচাত্তরের আগস্টে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে তার সরকারকে উৎখাত করা হয়েছিল। আজ তার হাতে গড়া দলই জনগণের ভোটে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত। শুধু তাই নয়, দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে পঁচাত্তর পরবর্তী সামরিক শাসন অবৈধ ঘোষিত হয়েছে। জেনারেল জিয়া পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধান বদল করেছিলেন, রাষ্ট্রীয় মূলনীতি পরিবর্তন করেছিলেন, ধর্মনিরপেক্ষতা বাতিল করেছিলেন। আদালত সেই পঞ্চম সংশোধনী বাতিল করেছে। ফলে রাষ্ট্র ও রাজনীতিতে ধর্মনিরপেক্ষতার ধারা পুনরুজ্জীবনের পথ সুগম হয়েছে।

স্বাধীনতাবিরোধী কুচক্রী মহল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করে ইতিহাস থেকে তার নাম মুছে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু তাদের সে ষড়যন্ত্র সফল হয়নি। শিশু-কিশোর-যুবকসহ সব বয়সী মানুষের মাঝে আজ বঙ্গবন্ধুর জীবন দর্শনের প্রভাব প্রবাহিত হচ্ছে। জীবিত মুজিবের চেয়েও মৃত মুজিব এখন অনেক বেশি শক্তিশালী। বঙ্গবন্ধু ছিলেন মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা সংগ্রামের এক বিশাল প্রতীক এবং নিরন্তর প্রেরণার উৎস। এইসব উপাদানের সমন্বয়েই বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস এবং এই ইতিহাসে সবচেয়ে উজ্জ্বল এবং সর্বোচ্চ স্থানটি যে বঙ্গবন্ধুর যুক্তিবাদী, বিচারশীল এবং ইতিহাসবোধসম্পন্ন সকল মানুষই এটা স্বীকার করবেন। এ ব্যাপারে বিতর্কের কোন অবকাশ নেই। কিন্তু তবুও কিছু লোক বিতর্ক তুলেছেন। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা মহানায়ক বঙ্গবন্ধুর হত্যা দিবসকে ‘জাতীয় শোক দিবস’ হিসেবে পালনের সরকারি সিদ্ধান্তকে ক্ষমতার জোরে অন্যায়ভাবে বাতিলও করে দিয়েছেন। তাদের এই সিদ্ধান্ত ছিল অদূরদর্শী, জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার বিরোধী এবং ইতিহাসকে অস্বীকার করার নামান্তর।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী নানা অস্বাভাবিক ঘটনা প্রবাহের স্রোতে এই দিনটিকে ১৯৭৫ পরবর্তীকাল থেকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। রাজনৈতিক নানা
স্বার্থ, স্বাধীনতা বিরোধীদের চক্রান্ত এবং কিছু লোকের রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষের কারণে এটি সম্ভব হয়নি। কিন্তু ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে যখন এই দিনকে জাতীয় শোক দিবস হিসেবে ঘোষণা করলো তখন সকল গণতান্ত্রিক, ইতিহাসবোধ সম্পন্ন ও শুভবুদ্ধি দ্বারা পরিচালিত দলের মানুষরা এটা মেনে নেওয়া উচিত ছিল। কারণ বঙ্গবন্ধু ছিলেন বাংলাদেশ আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেতা। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি প্রায় সিকি শতাব্দী সংগ্রাম করেছেন, জেল-জুলুম সহ্য করেছেন এবং তারই ফলে মানুষের মনে তার চিন্তা-চেতনা গভীরভাবে প্রভাব ফেলে এবং ধাপে ধাপে সময়োপযোগী
সিদ্ধান্ত ও নির্দেশনার মাধ্যমে তিনি বাংলাদেশ আন্দোলনকে রাজনৈতিক সংগ্রামের চূড়ান্ত পর্যায়ে উন্নীত করেন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একটি নাম, একটি ইতিহাস। বাঙ্গালির ইতিহাসে শ্রেষ্ঠ সন্তান তিনি। তার জীবন ছিল সংগ্রামমুখর। সংগ্রামের মধ্যেই তিনি
বড় হয়েছিলেন। তার জন্ম তৎকালীন বৃহত্তর ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার টুঙ্গীপাড়ায়। ছাত্রাবস্থায় তিনি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। বাহান্নর ভাষা আন্দোলন, ’৫৪-এর যুক্তফ্রন্টের সরকার গঠন, কপ, পিডিপি’র আন্দোলনে বঙ্গবন্ধু সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা
সংগ্রামে মহানায়ক হিসাবে ’৭০-এর নির্বাচনে অংশ নিয়ে তিনি আওয়ামী লীগকে এদেশের গণমানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীকে পরিণত করেন।

অবিসংবাদিত এই নেতার জীবন চলার পথ ছিল কণ্টকাকীর্ণ। পাকিস্তানের সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক আন্দোলন গড়ে তুলে ’৬০-এর দশক থেকেই তিনি বাঙ্গালি জাতীয়তাবাদের অগ্রনায়কে পরিণত হন। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ লাখো মানুষের উপস্থিতিতে ঢাকার তৎকালীন ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু বজ্রদৃপ্ত কণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম, মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম’। তারই বজ্র ঘোষণায় উদ্দীপ্ত, উজ্জীবিত জাতি স্বাধীনতার মূলমন্ত্র ধারণ করে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। অদম্য সাহস ও  আত্মত্যাগ, সাংগঠনিক শক্তি নিজের বাঙালীসত্তার গভীর অনুরণন উপলব্ধি করেছিলেন তিনি। দেশবাসীকেও তেমনি অনুপ্রাণিত করেছিলেন সেই সত্তার জাগরণ ঘটাতে। দেশ ও মানুষের প্রতি ভালোবাসা থেকে এক মোহনীয় স্বপ্ন রচনা করেছিলেন তিনি ধীরে ধীরে, সেই স্বপ্ন সফল করার আহ্বান জানিয়েছিলেন সকলের প্রতি। কী বিপুল সাড়া তিনি পেয়েছিলেন, তার পরিচয় তো আমরা স্বচক্ষে দেখেছি। ১৯৭১ সালে যেভাবে তিনি অসহযোগ আন্দোলন সংগঠিত করেছিলেন, তাতে বিম্মিত হয়েছিল সারা বিশ্ব।  বাংলাদেশের এই আন্দোলনের মধ্যদিয়ে জাতিতে যে ঐক্য, যে শৃঙ্খলা, যে দুর্জয় সংকল্পের পরিচয় পাওয়া গিয়েছিল তার তুলনা হয় না। তারপর সেই ৭ই মার্চের ভাষণ যে শুনেছে সে ভাষণ তারই শরীরে বয়ে গেছে বিদ্যুৎপ্রবাহ।

বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে আন্তরিকতার বন্ধন গড়ে উঠেছিল বলেই  শত্রু দেশে বন্দী থাকা সত্ত্বেও মুক্তিযুদ্ধে তার প্রেরণা ছিল সক্রিয়। বন্দীদশা থেকে মুক্তিলাভ করে দেশে প্রত্যাবর্তন করেই তিনি বলেছিলেন যদি দেশবাসী খাবার না পায়, যুবকরা চাকরি বা কাজ না পায়, তাহলে স্বাধীনতা ব্যর্থ হয়ে যাবে; পূর্ণ হবে না। এই ছিল তার স্বপ্নেরই অংশ। সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের আগেই তাকে সপরিবারে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেওয়া হলো। এরপর গড়িয়ে গেছে বহু বছর।

বাংলাদেশের উন্নয়ন দেখছি কিন্তু দেশটাতে মানসিকতায় পরিবর্তন দেখছিনা। অর্থলোভ কতক মানুষকে অন্ধ করে দিয়েছে। দুর্নীতিতে আচ্ছন্ন দেশ। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ গড়তে আমাদের সকলকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। এই জায়গা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতেই হবে।

লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট ও গবেষক

বঙ্গবন্ধু

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর