বিজ্ঞাপন

বন্যা ও ধানের বাড়তি দামের ‘অজুহাত’, হঠাৎ অস্থির চালের বাজার

August 20, 2020 | 8:12 pm

রমেন দাশ গুপ্ত, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট

চট্টগ্রাম ব্যুরো: ঈদুল আজহার পর থেকে বন্দরনগরী চট্টগ্রামের পাইকারি ও খুচরা বাজারে চালের দাম বাড়তে শুরু করেছে। বস্তাপ্রতি (৫০ কেজি) চালের দাম গত দুই সপ্তাহের মধ্যে পাইকারিতে বেড়েছে ২০০ থেকে ২৫০ টাকা, আর খুচরায় বেড়েছে কমপক্ষে ৩০০ টাকা। ধান-চালের পর্যাপ্ত মজুত থাকার পরও দামের এই ঊর্ধ্বগতি ঠেকাতে আড়ত ও খুচরা বাজারে অভিযান চালিয়েছে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন।

বিজ্ঞাপন

পাইকারি বিক্রেতা ও চালকল মালিকরা বলছেন, মাঠ পর্যায়ে কৃষকদের কাছে মজুত থাকা ধানের দাম বাড়তি থাকায় এবং উত্তরাঞ্চলে বন্যার কারণে সরবরাহে সংকট হওয়ায় চালের দাম বাড়ছে। তবে অনুসন্ধানে জানা গেছে, চালকল মালিক ও পাইকারি বিক্রেতাদের সিন্ডিকেট সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ ছাড়াই ঈদুল আজহার পর থেকে বাড়তি দামে প্রায় সব ধরনের চাল বিক্রি শুরু করেছেন।

চট্টগ্রাম নগরীতে চালের পাইকারি বাজার আছে দু’টি— চাক্তাই ও পাহাড়তলী। বৃহস্পতিবার (২০ আগস্ট) বাজার ঘুরে জানা গেছে, স্বর্ণা সিদ্ধ ৫০ কেজির বস্তা বিক্রি হচ্ছে ২২৬০ থেকে ২২৬৫ টাকায়। কোরবানির ঈদের আগে এই চালের দাম ছিল দুই হাজার টাকার নিচে। বেতি আতপ বিক্রি হচ্ছে ৫০ কেজির বস্তা ২০০ টাকায়। দাম বেড়েছে ২০০ টাকা। নাজিরশাইল সিদ্ধ ২৫ কেজির বস্তা কোরবানির ঈদের আগে ১২৮০ টাকায় বিক্রি হলেও বৃহস্পতিবার বিক্রি হচ্ছে ১৪৮০ টাকায়। মিনিকেট আতপ ২৫০ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ২২৫০ টাকায়। দিনাজপুরী পাইজাম ২০০ টাকা বেড়ে ২৬০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। মোটা সিদ্ধ চাল ১৬০০-১৭০০ টাকায় বিক্রি হতো, সেটাও ২০০ টাকা বেড়েছে। চিনিগুড়া চালের বস্তা ৩০০০ টাকা থেকে ৪৭০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, তবে এর দাম বাড়েনি।

চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের টিম বাজারে গিয়ে ৫০ কেজি বস্তার ইরি আতপ চালের ক্রয়মূল্য ১৭৯০ টাকা ও বিক্রয়মূল্য ১৮২০ টাকা, দেশি বেতি চালের ক্রয়মূল্য ১৮৫০ টাকা ও বিক্রয়মূল্য ১৯০০ টাকা, ২৫ কেজি বস্তার পাইজাম চালের ক্রয়মূল্য ১১০০ টাকা ও বিক্রি ১১৫০ টাকা, চিনিগুড়া চাল ২২০০ টাকা, জিরাশাইল চাল ২৪৫০ টাকা, বালাম সিদ্ধ চাল ১৮০০ টাকা দরে বিক্রির বিষয়টি দেখেছে।

বিজ্ঞাপন

বন্দরনগরীতে পাইকারি চালের বাজার পরিদর্শন করেছে জেলা প্রশাসন

তবে পাইকারি বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জেলা প্রশাসনের টিমের কাছে যে দামের তালিকা বড় বড় পাইকারি বিক্রেতারা দিয়েছেন, বাজারে এর চেয়ে বেশি দামে চাল বিক্রি হচ্ছে।

নগরীর চাক্তাইয়ে চালের বাজার পরিদর্শনে যাওয়া চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. আলী হাসান সারাবাংলাকে বলেন, ‘আড়তে ও বাজারে চালের কোনো ক্রাইসিস নেই। এরপরও দাম বাড়ছে। মূল্যতালিকায় যা লেখা হচ্ছে, বাস্তবে এর চেয়ে বেশি দামে চাল বিক্রির প্রমাণ পেয়েছি। চালের বাড়তি দামের বিষয়টি জানতে চাইলে পাইকারি বিক্রেতারা বলেছেন, নওগাঁ-দিনাজপুরসহ উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় বন্যা পরিস্থিতির কারণে চট্টগ্রামে চাল আসছে না। সেজন্য দাম বেড়েছে। বন্যা পরিস্থিতির কারণে চাল আসতে না পারলেও চট্টগ্রামে পর্যাপ্ত চাল মজুত দেখেছি। এরপরও বাড়তি দাম নেওয়া নিয়ে আমরা ব্যবসায়ীদের সতর্ক করেছি। কোনোভাবেই যেন চালের বাজারকে পরিকল্পিতভাবে অস্থির করা না হয়, সে বিষয়ে বলা হয়েছে।’

এবারের বন্যায় দেশের অন্তত ৩১টি জেলা প্লাবিত হয়েছে। বন্যা পূর্বাভাস কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, গত ২৬ জুন থেকে বন্যা শুরু হয়। এরপর ১১ জুলাই থেকে দ্বিতীয় দফায় পানি বাড়ে এবং ২১ জুলাই থেকে তৃতীয় দফায় পানি বাড়তে শুরু করে। দেশের মোট ৩১ শতাংশ এলাকা পানিতে প্লাবিত হয়। তবে আগস্টের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে পরিস্থিতির উন্নতি হতে শুরু করেছে।

বিজ্ঞাপন

চলমান বন্যার কারণে চালের সরবরাহ সংকটের কথা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে তুলে ধরলেও বাজার অস্থির হওয়ার জন্য কৃষকদের কাছে মজুত ধানের বাড়তি দামকেও কারণ হিসেবে টানছেন ব্যবসায়ীরা।

চাক্তাই চাল ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক ওমর আজম সারাবাংলাকে বলেন, ‘চালের বাজার কোরবানির ঈদের পর থেকেই বাড়তি। এর মূল কারণটা ধানের দাম বাড়তি। ঈদের আগে যে ধান মণপ্রতি ৯২০ টাকা থেকে ৯২৫ টাকায় বিক্রি হতো, সেটা এখন ১০৩০ টাকা হয়েছে। দুই মণ ধান প্রসেসিং করে ৫০ কেজি চাল পাওয়া যায়। ফলে ৫০ কেজির একবস্তা চালে বাড়তি পড়ছে ২০০ টাকা। এরপর বন্যার কারণে নিচু অঞ্চল থেকে জেলা সদরে ধান আসতে পারছে না। সেজন্য বাজারে ধানের দাম বাড়ছে। তবে চট্টগ্রামের বাজারে চালের কোনো ক্রাইসিস নেই। ধানের দামের কারণেই চালের দামও বাড়ছে।’

চট্টগ্রাম জেলা রাইস মিল মালিক সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক স্বপন কুমার সাহা সারাবাংলাকে বলেন, ‘কৃষকরা মিল মালিকদের কাছে ধান বিক্রি করছে না। সরকার ধানের দাম যা দিচ্ছে, তাতে কৃষক সন্তুষ্ট। ‍কৃষক ভাবছে, ধান মজুত করে রেখে যদি সরকারের কাছে বিক্রি করা যায়, তাহলে লাভ। এখন কৃষকদের কাছে বোরো মৌসুমের ধান আছে। আমি রোজার ঈদের আগে মণপ্রতি ৯৩০ টাকায় কিনেছি। সেটা এখন ১০৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বন্যার খুব বেশি এফেক্ট বাজারে পড়েনি।’

চাক্তাইয়ের চালের পাইকারি বাজারের ছোট বিক্রেতারা আড়তদার, বড় পাইকারি ব্যবসায়ী ও চালকল মালিকদের এসব অজুহাত মানতে নারাজ। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন পাইকারি বিক্রেতা সারাবাংলাকে বলেন, ‘ধানের দাম বাড়তি কিংবা বন্যা— এগুলো অজুহাত। চট্টগ্রামে তো সেভাবে রাইস মিল থেকে চাল আসে না। এবার ধানের দাম মণপ্রতি ১০-২০ টাকা হেরফের হয়েছে। বন্যার কারণে উত্তরাঞ্চল থেকে চাল সরবরাহ সাময়িক সমস্যা হচ্ছে। কিন্তু চাক্তাই ও পাহাড়তলীর অন্তত ২০ জন বড় ব্যবসায়ীর আড়তে যে চাল আছে, তাতে আরও তিন মাস নির্বিঘ্নে চলবে। এর মধ্যে নতুন ধান উঠে যাবে। মূলত নতুন ধান আসার আগে এই বড় ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটটা চালের দাম বাড়িয়ে দিয়ে কিছু মুনাফা নিয়ে যাচ্ছে।’

বিজ্ঞাপন

নগরীর কাজির দেউড়ি বাজারের খুচরা প্রতিষ্ঠান ফয়েজ স্টোরের মালিক মোহাম্মদ জসীম সারাবাংলাকে বলেন, ‘মিনিকেট, জিরাশাইল, নাজিরশাইল, কাটারি আতপ বস্তাপ্রতি ১০০ টাকা থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। যেগুলোর কোয়ালিটি ভালো কিন্তু চাহিদা কম, সেগুলোর দাম একটু কম আছে। বাকি সবগুলোর দাম বেড়েছে। কোরবানির ঈদের পর পাইকারিতে দাম বাড়ানো হয়েছে। এরপর খুচরায়ও বেড়েছে। আমাদের তো চালের বস্তার দামের সঙ্গে লেবার আর ট্রান্সপোর্ট খরচও যোগ করতে হয়।’

এদিকে চাক্তাইয়ে গিয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে টাঙানো চালের মূল্যতালিকা ও বিক্রয়মূল্যে হেরফের পেয়েছেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. আলী হাসান। তিনি সেখানে তাৎক্ষণিক ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান পরিচালনা করেন। কারসাজির বিষয়টি প্রমাণ হওয়ায় মেসার্স বাবুল ট্রেডার্সকে ১০ হাজার টাকা এবং মেসার্স সাদ ট্রেডার্সকে ১০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।

সারাবাংলা/আরডি/টিআর

Tags: , , , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন