বিজ্ঞাপন

আপিল শুনানির জন্য অগ্রাধিকার পাবে ২১ আগস্ট মামলা

August 21, 2020 | 8:29 am

আব্দুল জাব্বার খান, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: ১৬ বছর আগে ইতিহাসের অন্যতম বর্বরোচিত এক হামলার সাক্ষী হয় বাংলাদেশ। ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের এই দিনটিতে তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগের এক সন্ত্রাসবিরোধী জনসভাই কেঁপে উঠেছিল গ্রেনেডের আঘাতে। বিরোধী দলীয় নেতা শেখ হাসিনার মঞ্চ লক্ষ্য করে ছুঁড়ে দেওয়া সে গ্রেনেডের আঘাত থেকে শেখ হাসিনা রক্ষা পেয়েছিলেন দলীয় নেতাকর্মীদের তৈরি মানবঢালে, তবে প্রাণ হারিয়েছিলেন দলের ২৪ জন নেতাকর্মী। আহত হয়েছিলেন আওয়ামী লীগের শত শত নেতাকর্মীসহ হাজারও মানুষ। গ্রেনেডের বিকট শব্দ কেড়ে নিয়েছে শেখ হাসিনার একটি কানের শ্রবণশক্তি।

বিজ্ঞাপন

নারকীয় সে হামলার ঘটনায় দায়ের করা মামলায় বিচারিক আদালতের বিচারকাজ শেষ হয়েছে ঘটনার ১৪ বছর পর। ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর ঘটনার সময়কার বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর ও সাবেক উপমন্ত্রী আব্দুস সালাম পিন্টুসহ ১৯ জনের মৃত্যুদণ্ড দেন আদালত। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও খালেদা জিয়ার সাবেক রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরীসহ ১৯ জনকে দেওয়া হয় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড।

উচ্চ আদালতে বর্তমানে আপিল পর্যায়ে রয়েছে মামলাটি। মামলাটি শুনানির জন্য এরই মধ্যে সরকারি ছাপাখানা বিজি প্রেস থেকে পেপারবুক প্রস্তুত হয়ে এসেছে। প্রধান বিচারপতি বেঞ্চ নির্ধারণ করে দিলেই মামলাটির শুনানি শুরু হবে। আর রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল জানিয়েছেন, এই মামলার ডেথ রেফারেন্সসহ আসামিদের করা আপিল আবেদন শুনানির জন্য অগ্রাধিকারভিত্তিতে উদ্যোগ নেওয়া হবে।

২১ আগস্ট মামলার বিষয়ে জানতে চাইলে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সারাবাংলাকে বলেন, ২১ আগস্ট মামলায় নিম্ন আদালত যাদের সাজা দিয়েছেন, আসামিরা এখানে আপিল করেছেন। এছাড়া ডেথ রেফারেন্স আছে। নিয়মিত আদালত শুরু হলেই অগ্রাধিকারভিত্তিতে আবেদন করে এই মামলা শুনানির চেষ্টা করব।

বিজ্ঞাপন

আরও পড়ুন-

ভার্চুয়াল আদালতেও মামলাটির কাজ এগিয়ে যেতে পারে বলে মনে করেন অ্যাটর্নি জেনারেল। তিনি বলেন, এটি বড় একটি মামলা। সেহেতু এটি ভার্চুয়াল আদালতে শুনানি করতেও কোনো অসুবিধা হবে না। কারণ এরই মধ্যে বেশ কয়েকটি মামলা আমরা ভার্চুয়ালি নিষ্পত্তি করেছি। এ মামলায় কাগজপত্রের বিষয় রয়েছে। জজ সাহেবদের হাতে যেই পেপারবুক থাকবে, আমাদের কাছেও সেই একই পেপারবুক থাকবে। তবে একজন আসামি ধরার পরে সেই ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে কী কী হয়েছিল, সেই আদেশগুলো অনেক সময় দরকার হয়। এ ক্ষেত্রে কিছু সমস্যা হতে পারে। সে ক্ষেত্রেও প্রয়োজন হলে ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টের আদেশগুলো দিয়ে আলাদা একটি পেপারবুক তৈরি করে নেব।

মামলার সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের বিশেষ কর্মকর্তা ব্যারিস্টার সাইফুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, ২১ আগস্ট মামলার পেপারবুক গত ১৬ আগস্ট আমাদের কাছে এসে পৌঁছেছে। দুই মামলায় মোট ২০ হাজার পাঁচশ পৃষ্ঠার মোট ১ হাজার ৮০টি পেপারবুক এসেছে। তার মধ্যে গ্রেনেড হত্যা মামলায় সাড়ে ১০ হাজার পৃষ্ঠার ১৩ ভলিউমে মোট ৫৮৫ টি পেপারবুক। এ মামলায় আপিল ২২টি, জেল আপিল ১২টি।

বিজ্ঞাপন

এদিকে, ওই হামলার ঘটনায় বিস্ফোরক আইনের মামলায় ১১ ভলিউমে ১০ হাজার পৃষ্ঠার মোট ৪৯৫টি পেপার বুক এসেছে। এর মধ্যে ১৭টি আপিল ও ১২টি জেল আপিল। সাইফুর রহমান বলেন, এখন পেপারবুক যাছাই-বাছাইয়ের কাজ চলছে। সব প্রস্তুতি শেষ করে প্রধান বিচারপতির কাছে সবকিছু উপস্থাপন করা হবে। বিধি মোতাবেক তিনি মামলার শুনানির জন্য ব্যবস্থা নেবেন। পলাতক আসামি থাকলে তাদের জন্য State Defence Lawyer নিয়োগ করা হবে বলেও তিনি জানান।

ঘটনার ১৪ বছর পর ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর চাঞ্চল্যকর এ মামলার রায় দেন বিচারিক আদালত। রায়ে সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর ও বিএনপি নেতা আবদুস সালাম পিন্টুসহ ১৯ জনের মৃত্যুদণ্ড দেন। একইসঙ্গে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান (বর্তমানে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান) তারেক রহমানসহ ১৯ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। আরও ১১ জন আসামিকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়া হয়। এরপর গত বছরের ২৭ নভেম্বর দুই মামলার রায়সহ প্রায় ৩৭ হাজার ৩৮৫ পৃষ্ঠার নথি হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় এসে পৌঁছায়। এরপর এ মামলার পেপারবুক তৈরি করার নির্দেশ দেন প্রধান বিচারপতি।

২০১৯ সালের ১৩ জানুয়ারি বহুল আলোচিত এই মামলার আপিল ও ডেথ রেফারেন্স শুনানির জন্য গ্রহণ করেন বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মোস্তাফিজুর রহমানের হাইকোর্ট বেঞ্চ। পরবর্তী সময়ে এ মামলায় পেপারবুক তৈরির নির্দেশনা দেওয়া হয়।

বিজ্ঞাপন

রায় ঘোষণার পর সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. লুৎফুজ্জামান বাবরকে আদালত থেকে কারাগারে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে

এ ছাড়া গত বছরের ২১ জানুয়ারি বিচারপতি শেখ আব্দুল আউয়াল ও বিচারপতি ভীষ্মদেব চক্রবর্তীর হাইকোর্ট বেঞ্চ থেকে এ মামলায় দুই বছরের দণ্ডপ্রাপ্ত সাবেক দুই আইজিপি শহুদুল হক ও আশরাফুল হুদা জামিন নিয়ে নেন। এখন ৪৪ আসামির আপিল আবেদন শুনানির জন্য অপেক্ষমাণ রয়েছে।

মামলার বিবরণে বলা ঞয়, ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সমাবেশে ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। অল্পের জন্য ওই হামলা থেকে প্রাণে বেঁচে যান বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি, তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা। তবে হামলায় আওয়ামী লীগের মহিলা বিষয়ক সম্পাদক, সাবেক রাষ্ট্রপতি (প্রয়াত) জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভী রহমানসহ ২৪ জন নিহত হন। আহত হন দলের তিন শতাধিক নেতাকর্মী। ঘটনার পরদিন মতিঝিল থানার উপপরিদর্শক (এসআই) ফারুক আহমেদ বাদী হয়ে মামলা করেন।

তদন্ত শেষে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ২০০৮ সালের ১১ জুন দেওয়া অভিযোগপত্রে বিএনপি নেতা আবদুস সালাম পিন্টু, তার ভাই মাওলানা তাজউদ্দিন ও হুজি নেতা মুফতি আব্দুল হান্নানসহ ২২ জনকে আসামি করা হয়। তখন জানা যায়, শেখ হাসিনাকে হত্যা করতে হামলার ছক করা হয়েছিল। পাকিস্তান থেকে এসেছিল হামলায় ব্যবহৃত আর্জেস গ্রেনেড।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনের পর অধিকতর তদন্তের নির্দেশ দেন আদালত। দুই বছর তদন্তের পর ৩০ জন আসামিকে ২০১১ সালের ৩ জুলাই সম্পূরক অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়। এর ফলে এ মামলায় মোট আসামির সংখ্যা হয় ৫২। দীর্ঘ বিচার প্রক্রিয়া শেষে বিচারক ৪৯ জনকে সাজা দেন।

এই মামলায় গ্রেনেড নিক্ষেপ ও বিস্ফোরণ ঘটিয়ে এবং এই অপরাধে সহায়তা করে হত্যার অভিযোগে মৃত্যুদণ্ডের সাজা পাওয়া আসামিরা হলেন— আলহাজ্ব মাওলানা মো. তাজউদ্দিন, মো. লুৎফুজ্জামান বাবর, অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আব্দুর রহিম, মো. আব্দুস সালাম পিন্টু, হানিফ পরিবহনের মালিক মো. হানিফ, মাওলানা আব্দুস সালাম, মোহাম্মদ আব্দুল মাজেদ ভাট ওরফে মো. ইউসুফ ভাট, আব্দুল মালেক ওরফে গোলাম মোহাম্মদ ওরফে জি. এম, মাওলানা শওকত ওসমান ওরফে শেখ ফরিদ, মহিবুল্লাহ ওরফে মফিজুর রহমান ওরফে অভি, মাওলানা আবু সাঈদ ওরফে ডা. জাফর, আবুল কালাম আজাদ ওরফে বুলবুল, মো. জাহাঙ্গীর আলম, হাফেজ মাওলানা আবু তাহের, হোসাইন আহম্মেদ তামিম, মঈন উদ্দিন শেখ ওরফে মুফতি মঈন ওরফে কাজা ওরফে আবু জানদাল ওরফে মাসুম বিল্লাহ, মো. রফিকুল ইসলাম ওরফে সবুজ ওরফে খালিদ সাইফুল্লাহ ওরফে শামিম ওরফে রাশেদ ও মো. উজ্জল ওরফে রতন। পরিকল্পনা ও অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে হত্যা করার অভিযোগে দণ্ডবিধির ৩০২/১২০খ/৩৪ ধারায় দোষী সাব্যস্ত করে তাদের মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত ফাঁসিতে ঝুলিয়ে রাখার নির্দেশ দেওয়ার পাশাপাশি প্রত্যেককে এক লাখ টাকা করে জরিমানা করেন আদালত।

রায়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ পাওয়া আসামিরা হলেন— তারেক রহমান ওরফে তারেক জিয়া, হারিছ চৌধুরী, শাহাদাৎ উল্লাহ ওরফে জুয়েল, মাওলানা আব্দুর রউফ ওরফে আবু ওমর আবু হোমাইরা ওরফে পীর সাহেব, মাওলানা সাব্বির আহমেদ ওরফে আব্দুল হান্নান সাব্বির, আরিফ হাসান ওরফে সুমন ওরফে আব্দুর রাজ্জাক, হাফেজ মাওলানা ইয়াহিয়া, আবু বকর ওরফে হাফেজ সেলিম হাওলাদার, মো. আরিফুল ইসলাম ওরফে আরিফ, মুহিবুল মুত্তাকিন ওরফে মুত্তাকিন, আনিসুল মুরছালিন ওরফে মুরছালিন, লিটন ওরফে মাওলানা লিটন, মো. খলিল, জাহাঙ্গীর আলম বদর, মো. ইকবাল, কাজী শাহ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদ, মুফতি শফিকুর রহমান, মুফতি আব্দুল হাই ও রাতুল আহমেদ বাবু ওরফে রাতুল বাবু। তাদের দণ্ডবিধির ৩০২/১২০খ/৩৪ ধারায় দোষী সাব্যস্ত করে যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়ার পাশাপাশি প্রত্যেককে ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানা, অনাদায়ে আরও এক বছর সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

এ ছাড়া পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজি) মো. আশরাফুল হুদা ও শহুদুল হক, বিএনপি চেয়ারপারসন ও তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার ভাগ্নে লেফটেন্যান্ট কমান্ডার (অব.) সাইফুল ইসলাম ডিউক, লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) সাইফুল ইসলাম জোয়ার্দ্দার, ডিজিএফআইয়ের মেজর জেনারেল (অব.) এটিএম আমিন, ডিএমপির সাবেক উপকমিশনার (দক্ষিণ) খান সাঈদ হাসান, আরেক সাবেক উপকমিশনার (পূর্ব) ওবায়দুর রহমান খান, সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক খোদা বক্স চৌধুরী, সিআইডির সাবেক বিশেষ সুপার মো. রুহুল আমিন, সাবেক এএসপি আবদুর রশিদ, সাবেক এএসপি মুন্সি আতিকুর রহমানকে দুই বছর করে কারাদণ্ড ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও ছয় মাস করে সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়। আরেকটি ধারায় খোদা বক্স চৌধুরী, রুহুল আমিন, আবদুর রশিদ ও মুন্সি আতিকুর রহমানকে তিন বছর করে কারাদণ্ড ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও ছয় মাস করে কারাদণ্ড দেন আদালত।

সারাবাংলা/এজেডকে/টিআর

Tags: , , , , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন