বিজ্ঞাপন

আমার দেখা ২১ আগস্ট: ১৬ বছর পরও ভুলতে পারি না সেই স্মৃতি

August 21, 2020 | 6:06 pm

মীর আব্দুল আলীম

আগস্ট মাস বাঙালি জাতির জন্য অত্যন্ত বেদনার মাস। এই মাসেই জাতি হারিয়েছিল তার জাতির পিতাকে। ১৬ বছর আগে ২০০৪ সালের এই দিনে ২৩, বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে বিকেল ৫টা ২২ মিনিট বাঙালি জাতি প্রত্যক্ষ করে আরও একটি ঘৃণ্য হত্যাকাণ্ড । প্রকাশ্য দিবালোকে হাজার হাজার জনতার মধ্যে মুহুর্মুহু গ্রেনেড হামলা হয়। হত্যাকান্ডের মূল টার্গেট ছিলেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা।

বিজ্ঞাপন

হত্যাকারীরা সেদিন অবস্থান নেয় গণতন্ত্র, মানবাধিকার, অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরুদ্ধে। শেখ হাসিনা, গণতন্ত্র, মানবাধিকার, অসাম্প্রদায়িকতা ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে অবস্থা নেয় বলে তাকে বারবার হত্যাকারীদের আক্রমণের শিকার হতে হয়েছে। গ্রেনেড হামলার দিন ‘জয়বাংলা জয়বঙ্গবন্ধু’ বলে যখনই বক্তব্য শেষ করছিলেন তখনই ঘাতকের একের পর এক গ্রেনেড ছুটে আসছিল তার ট্রাকের দিকে। সৃষ্টিকর্তার অশেষ রহমতে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা মানব বর্ম তৈরি করে রক্ষা করেছিল তাদের প্রিয় নেত্রীকে। ব্যক্তিগত নিরাপত্তাকর্মী মাহবুব মঞ্চ থেকে গ্রেনেড আর গুলির মধ্য দিয়ে গাড়িতে তুলে দিতেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। নেত্রীকে বাঁচিয়ে পালন করে গেছে তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব। অসংখ্য মানুষ লাশ হয়ে, আহত হয়ে পড়ে ছিল মঞ্চের চারপাশে।

সেদিনের ঘটনা আমার খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছিল বলে ভুলতে পারি না সেই স্মৃতি। ঢাকা মেডিকেলে কান্নার আহাজারিতে বাতাস ভারি হয়ে উঠেছিল। যে হৃদয়বিদারক দৃশ্যের সৃষ্টি হয়েছিল তা কেউ না দেখলে তাকে বোঝানো যাবে না। গ্রেনেডের আঘাতে মৃত্যু পথযাত্রী তবুও নিজের কথা না বলে প্রিয় নেত্রীর কী অবস্থা জানতে চেয়েছেন। সবার একই কথা নেত্রীর কী অবস্থা? তার কোনো অসুবিধা হয়নি তো? হামলায় আইভি রহমানসহ ২৪ জন নিহত, ৩৩৮ জন আহত হয়েছিল। শেখ হাসিনা আহত না হলেও গ্রেনেডের আঘাতে শ্রবণযন্ত্রের মারাত্মক ক্ষতি হয়েছিল। গ্রেনেড হামলার পর পিচঢালা পথে পড়ে আছে অসংখ্য নিথর দেহ। অঙ্গ হারিয়ে অনেকে কাতরাচ্ছে। সড়কে বয়ে গেছে রক্তবন্যা। এসময় সবার একটাই প্রশ্ন, নেত্রীর কি অবস্থা। আপার কোনো অসুবিধা হয়নি তো? বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বাঁচাতে গিয়ে প্রাণ হারান তার দেহরক্ষীও। এ হামলার কারণ সবারই জানা। এ হামলা কেবল শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করে দেওয়ার জন্যই করা হয়েছিলো।

সেদিন বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে সমাবেশে প্রধান অতিথি ছিলেন আওয়ামী লীগের সভানেত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। সমাবেশ শেষে সন্ত্রাসবিরোধী মিছিল হওয়ার কথা। তাই আলাদা মঞ্চ তৈরি না করে আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে একটি ট্রাককে মঞ্চ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। বিকাল ৫টা ২২ মিনিটে শেখ হাসিনার বক্তৃতা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বিকট শব্দে খই ফোটার মতো একের পর এক গ্রেনেড বিস্ফোরণ। বিস্ফোরণ ঘটানো গ্রেনেড, বোমা আর গুলির শব্দ, বিচ্ছিন্ন হাত, পা ও দেহ, রাজপথে তাজা রক্ত, হাজার হাজার মানুষের ভয়ার্ত ছোটাছুটি সব মিলিয়ে মুহূর্তেই বঙ্গবন্ধু এভিনিউ পরিণত হয় এক মৃত্যু উপত্যকায়। সেদিন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে লক্ষ্য করে ছোড়া হয় ৬ টি গ্রেনেড। লাশের মিছিলে স্বজনদের আহাজারি আর আহতদের চিৎকারে ভারি হয়ে ওঠে রাজধানীর পরিবেশ। প্রায় শ্রবনশক্তি হারিয়ে প্রাণে রক্ষা পান গণতন্ত্রের মানস কন্যা শেখ হাসিনা।

বিজ্ঞাপন

সেদিন একটি বিষয় স্পষ্ট ছিল আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যা করে তার দলকে নেতৃত্বশূন্য করার লক্ষ্যে বর্বরতম সেই হামলা চালানো হয়েছিল। নির্মম হামলার ঘটনায় শেখ হাসিনা ভাগ্যক্রমে প্রাণে বেঁচে গেলেও আওয়ামী লীগের ত্যাগী নেত্রী আইভি রহমানসহ ২৪ জন নিরপরাধ মানুষকে জীবন দিতে হয়েছে। হামলায় শত শত মানুষ মারাত্মক জখম হন, চিরজীবনের জন্য পঙ্গুত্ব বরণ করেন। ঘটনার পর এতগুলো বছর পার হলেও সেই হামলায় ব্যবহৃত আর্জেস গ্রেনেডের উৎস, এর জোগানদাতা, পরিকল্পনাকারী এবং হামলার নেপথ্য কারিগরদের চিহ্নিত করা যায়নি। শেখ হাসিনাকে হত্যা করে কেউ লাভবান হতে চেয়েছিল কিনা কিংবা হামলার পেছনে প্রভাবশালী কাদের হাত ছিল তার কিছুই বের করা সম্ভব হয়নি। স্বজন হারানোর ব্যথা ভুলতে পারেনি পরিবারগুলো। গ্রেনেড হামলার ১৬ বছর পেরিয়ে গেলেও তারা কোনো বিচার পাননি।

শেখ হাসিনা বহুবার মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়েছেন। শেখ হাসিনাকে এতো আঘাত করেও কেউ তার অবস্থান থেকে একবিন্দু সরাতে পারেনি । মৃত্যুভয়ে তিনি পিছিয়ে যাননি। তবে আওয়ামী লীগের কর্মীদের মনে রাখতে হবে শেখ হাসিনার জীবনই সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। এ মাসেই জাতি হারিয়েছিল তার রাষ্ট্রের পিতাকে। এ মাসেই প্রাণ কেড়ে নিতে চেয়েছিল জাতির জনকের কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। আল্লাহর অশেষ রহমতে তিনি বেঁচে যান। সেদিনের দুঃসহ স্মৃতি ও শরীরে অসংখ্য স্পিন্টার নিয়ে বেঁচে আছেন আওয়ামী লীগের শত শত নেতাকর্মী। প্রশ্ন হলো ঘটনার ১৬ বছর পরও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কতটা নিরাপদ?

সিআইডি’র তদন্তে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী শেখ হাসিনাকে হত্যা ও আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করতে হুজি নেতা মুফতি আবদুল হান্নান গ্রেনেড হামলার প্রথম পরিকল্পনাকারী। তিনি রাজধানীর পশ্চিম বাড্ডায় সংগঠনের নেতা কাজলের বাসায় অন্যদের নিয়ে ২০০৪ সালের ১৯ আগস্ট সন্ধ্যায় বৈঠক করেন। পরদিন সকালে ঐ বাসায় আবার বৈঠক করে পরিকল্পনা চূড়ান্ত করা হয়। একই দিন বিকালে কাজল ও জান্দাল বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে গিয়ে এলাকা রেকি করে। এরপর সন্ধ্যায় মুফতি হান্নান, মওলানা তাহের, তাজউদ্দিন, কাজল ও জান্দাল তৎকালীন উপমন্ত্রী আব্দুস সালাম পিন্টুর ধানমন্ডির সরকারি বাসায় বৈঠক করেন। পিন্টুর ভাই তাজউদ্দিন হামলা পরে প্রশাসনিক সহায়তার আশ্বাস দিয়ে জান্দাল ও কাজলের কাছে ১৫টি গ্রেনেড দেন। তাজউদ্দিন এই বলে আরও নিশ্চয়তা দিয়েছিলেন, হামলার ঘটনা ভিন্নখাতে চলে যাবে। আর এ কাজটি বড় ভাই (পিন্টু) করে দিবেন। আবদুস সালাম দিয়েছিলেন ২০ হাজার টাকা। একুশে আগস্ট সকালে বাড্ডায় কাজলের বাসায় আক্রমণের জন্য নির্বাচিত ব্যক্তিরা একত্র হয়। সবাই একসঙ্গে জোহরের নামাজ পড়ে দুপুরের খাবার খায়। তারপর সবার উদ্দেশে মওলানা সাইদ জিহাদ বিষয়ক বয়ান করেন। মুফতি হান্নান হামলার জন্য ১৫টি গ্রেনেড দেন। আছরের নামাজের সময় সবাই যার যার মতো গিয়ে গোলাপ শাহ মাজারের কাছে মসজিদে মিলিত হয়। সেখান থেকে তারা সমাবেশ মঞ্চ হিসাবে ব্যবহৃত ট্রাকটির তিন দিকে অবস্থান নেয়। শেখ হাসিনার বক্তব্য শেষ হওয়ার পর ট্রাকে তৈরি মঞ্চে গ্রেনেড আক্রমণ করা হয়। এরপর তারা সমাবেশে উপস্থিত লোকদের সঙ্গে মিশে গা ঢাকা দেয়।

বিজ্ঞাপন

আমরা সবাই ভালো করেই বুঝতে পারি, যে হত্যা ও ক্যুর রাজনীতি বঙ্গবন্ধুর ঘাতকরা ও তাদের মদদদাতারা শুরু করেছিল তা এখনো অব্যাহত আছে। তাদের এখন একমাত্র টার্গেট শেখ হাসিনা। হত্যাকারীদের অনুসারীরা এখনোও আমাদের আশপাশে, প্রশাসনযন্ত্রের মধ্যে ঘাপটি মেরে আছে। আওয়ামী লীগকে বুদ্ধিমত্তা ও কৌশল দিয়ে তা প্রতিহত করতে হবে। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার সঙ্গে অনেক খারাপ মানুষ সম্পৃক্ত ছিল। সেদিন ঘাতকরা আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বহীন করতে চেয়েছিল। সৃষ্টিকর্তার অপার মহিমায় সে যাত্রায় রক্ষা পাওয়া গেছে। এই ঘৃণ্য হামলার সঙ্গে যুক্ত তাদের খুঁজে বের করা প্রয়োজন। এখনো এই ঘাতকরা শেখ হাসিনার দিকে বন্দুক তাক করে আছে। এদের সমূলে উৎপাটনের এখনই সময়।

প্রকৃত দোষী এবং প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদদাতাদের খুঁজে বের করতে হবে। বাংলাদেশ থেকে জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদ নির্মূল করতে হবে । যাতে তাদের মতো আর কাউকে স্বজন হারাতে না হয়, স্বজন হারানোর ব্যথায় কাঁদতে না হয়, কোনো স্বামীকে স্ত্রী হত্যার, স্ত্রীকে স্বামী হত্যার বিচারের জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরতে না হয়, সন্তানের লাশের মতো পৃথিবীর সবচেয়ে ভারী জিনিস পিতার কাঁধে বহন না করতে হয়।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট

বিজ্ঞাপন

সারাবাংলা/আরএফ

Tags: , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন