বিজ্ঞাপন

আসছে ব্রি হাইব্রিড-৭, হেক্টরে ফলন ৭ টন

March 10, 2018 | 8:29 am

এমদাদুল হক তুহিন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট

বিজ্ঞাপন

গাজীপুর থেকে ফিরে: চলতি বছরে নতুন ৫টি ধানের জাত উদ্ভাবনের লক্ষ্য রয়েছে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিটিউটের (ব্রি) বিজ্ঞানীদের। সে লক্ষ্যে এগিয়ে চলছে গবেষণা। আর দ্রুত সময়ের মধ্যেই আলোর মুখ দেখতে যাচ্ছে ধানের নতুন আরও একটি জাত। আউশ মৌসুমে চাষাবাদের উপযোগী ‘ব্রি হাইব্রিড-৭’ নামের ওই জাতে গড় ফলন হবে ৭ টন। যেখানে বর্তমানে হেক্টর প্রতি ধানের গড় ফলন সর্বোচ্চ ৪ টন। তবে বিজ্ঞানীদের আশাবাদ ভবিষ্যতে তাদের উদ্ভাবিত জাতগুলো ১০ টন পর্যন্ত ফলন দিতে সক্ষম হবে। ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের একাধিক বিজ্ঞানীর সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) মহাপরিচালক ড. মো. শাহজাহান কবীর সারাবাংলাকে বলেন, ‘আউশের জন্য আমরা প্রথমবারের মতো হাইব্রিড জাতের ধান ছাড় করতে যাচ্ছি। আগামী আউশ মৌসুমে অর্থাৎ এপ্রিলে আমরা ট্রায়াল দেব। আর চলতি বছরের অক্টোবর-নভেম্বরের দিকে আমরা জাতটি ছাড় করতে পারবো।’ তিনি বলেন, ‘এখন পর্যন্ত আউশের যে জাতগুলো আছে এর উৎপাদন ৫ টন থেকে সাড়ে ৫ টন। আমরা আশা করছি এই জাতটি ৭ টন পর্যন্ত ফলন দিতে সক্ষম হবে। হাইব্রিডে সাধারণত অ্যামাইলোজ কম থাকে, তবে নতুন জাতটিতে অ্যামাইলোজের পরিমাণ বেশ ভালো। এর ভাত চিকন এবং দেখতে খুব সুন্দর।’

বিজ্ঞাপন

ব্রি হাইব্রিড-৭: উদ্ভাবন হতে যাওয়া এই জাতটির জীবনকাল হবে ১০৫ দিন। সারাদেশের আউশ আবাদী অঞ্চলগুলোতে নতুন এই জাতের ধান চাষাবাদ করা যাবে। এ জাতের ধান থেকে হওয়া চালে অ্যামাইলোজের পরিমাণ হবে ২৩ শতাংশের উপরে।

ব্রি হাইব্রিড বিভাগের প্রধান ড. জামিল হাসান সারাবাংলাকে বলেন, এটি আউশের জন্য সরকারি পর্যায়ে প্রথম হাইব্রিড জাতের ধান। জাতটি উদ্ভাবনের মূল লক্ষ্য হচ্ছে এটি চাষাবাদ করলে পানি কম লাগবে। ক্রমাগত পানির স্তর নিচে নামার প্রতিবন্ধকতা মোকাবেলায় আউশের জন্য এ জাত নিয়ে কাজ চলছে। তিনি জানান, জাতটি চলতি বছরে ছাড় করা সম্ভব হলেও ২০১৯ সালের আউশ মৌসুমে কৃষকের মাঠে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে।

একই ধরনের তথ্য জানিয়ে ব্রি মহাপরিচালক ড. শাহজাহান কবীর বলেন, ২০১৯ সালের আউশ মৌসুমে এই জাতটি কৃষকের মাঠে যাবে। আমরা যতো তাড়াতাড়ি বীজ উৎপাদন করতে পারবো, জাতটি ততো দ্রুত মাঠে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে।

বিজ্ঞাপন

এদিকে, ক্রমাগত পানির স্তর নিচে নামায় সেচনির্ভর বোরো চাষাবাদে কখনও সখনও হিমশিম খেতে হচ্ছে কৃষকের। প্রতিবন্ধকতা মোকাবেলায় সরকার যেমন বোরোর উপর নির্ভরশীলতা কমাতে চায় তেমনি অঞ্চল ভিত্তিতে বোরোর বহুমুখীকরণেও জোর দেয়া হচ্ছে। বোরোর চাষাবাদ উত্তরাঞ্চল থেকে দক্ষিণাঞ্চলে প্রসারিত করার চিন্তা রয়েছে। বেশ কয়েক বছর ধরেই কৃষিমন্ত্রীর বক্তব্যেও এসব কথা উঠে আসছে। ফলে চলতি বছরে বোরোর নতুন জাত উদ্ভাবনের চেয়ে আউশের জাত উদ্ভাবনই প্রাধান্য পাচ্ছে।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, ‘প্রকৃতি নির্ভর চাষাবাদই’ চলতি বছরের গবেষণায় প্রধান্য পাবে। আর সে লক্ষ্যেই উদ্ভাবিত হবে নতুন নতুন জাত।

জানা গেছে, পূর্বে আউশ মৌসুমে দেশিয় জাতই ছিল বীজের অন্যতম ভান্ডার। ব্রি’র বিজ্ঞানীরা বলছেন, ধীরে ধীরে সেই স্থান দখল করে নিচ্ছে ব্রি উদ্ভাবিত জাতগুলো। ২০০৬-০৭ অর্থবছরে দেশে যে পরিমাণ আউশ আবাদ হয়েছিল সেখানে বীজ হিসেবে ব্রি উদ্ভাবিত জাতগুলোর ব্যবহার ছিল ২১ শতাংশ। তবে সর্বশেষ আউশ মৌসুমে রোপনকৃত ৬৭ শতাংশ জাতই ব্রি উদ্ভাবিত।

বিজ্ঞাপন

এ প্রসঙ্গে ব্রি মহাপরিচালক ড. মো. শাহজাহান কবীর সারাবাংলাকে বলেন, ‘গত বছর আমরা আউশের নতুন তিনটি জাত উদ্ভাবন করেছি। আমরা প্রতি বছরই আউশের দুই থেকে তিনটি জাত দিতে পারবো। আগে শুধু উৎপাদন বাড়ানোর কথা চিন্তা করা হতো। এখন পানির স্তর নিচে নামা ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলাসহ অন্যান্য বিষয়ও চিন্তা করা হচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘চলতি বছরে নতুন ৫ টি জাত উদ্ভাবনের লক্ষ্যে আমরা কাজ করছি। আউশের জন্য এ বছরই ছাড় হতে যাওয়া ‘ব্রি- হাইব্রিড ৭’ নামের জাতটি হেক্টরে ৭ টন করে ফলন দিবে। তবে ৫ থেকে ৭ বছর পর আমরা এমন জাত উদ্ভাবন করতে পারবো যা হেক্টরে ১০ টন পর্যন্ত ফলন দিতে সক্ষম।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আউশের প্রচলিত জাত বিআর-২৬ এর পরিবর্তক জাত উদ্ভাবনেও প্রায় সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে বিজ্ঞানীরা।’ জানালেন, বাজারে মিনিকেটে চালের চাহিদা বিবেচনায় চিকন ধানের জাত উদ্ভাবনের লক্ষ্যও রয়েছে তাদের।

সবুজ আর ফুলে সজ্জিত ব্রি প্রাঙ্গণ: ৭৬ হেক্টর জমির উপর গাজীপুরের ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট। এর পুরোটাই সবুজ আর ফুলে ফুলে সজ্জিত। মূল ফটক পেরিয়ে ভেতরে ঢুকতেই গ্রামের আবহে হৃদয়ে দোল খায় সতেজতা। একই সাথে চোখের পলকে অনুভব করা যায় কৃষকের ভবিষ্যতও।

বি’র পুরো প্রাঙ্গণটি কয়েকটি ব্লকে বিভক্ত। প্রতিটি ব্লকেই রয়েছে ছোট ছোট প্ল্যান্ট। এসব প্লান্টের কোথাও রোপন করা হচ্ছে ধানের চারা। আবার কোথাওবা দেয়া হচ্ছে নিড়ুনি। শ্রমিকেরা কাজ করছে ভাগে ভাগে। সেখানে সকাল গড়িয়ে বিকেল পর্যন্ত মানুষের হাত চলছে ধানের গোছায়। কোন কোন প্লান্টে শোভা পাচ্ছে মিথেন পরিমাপক যন্ত্র। ধান ক্ষেত থেকে কিভাবে মিথেন নি:সরণ হয় এই যন্ত্রটি দিয়ে তা পরিমাপ করা হয়।

ব্রি’র বিভিন্ন ব্লকে পরীক্ষা করা হয় মাটির লবণাক্ততা। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সংগ্রহ করে আনা হয়েছে নানা গুণের মাটি। মাটির গুনাগুণ ও পরিবেশের সাথে ধানের জাতের যে গভীর সম্পৃক্ততা তা নির্ণয় করতে এখানের মাঠের কোথাও লাঙল চলে না।

সয়েল সায়েন্স বিভাগের হয়ে বিভিন্ন প্লান্ট দেখার দায়িত্বে থাকা আমজাদ হোসেন সারাবাংলাকে জানান, এখানের অধিকাংশ শ্রমিক চুক্তিভিত্তিক, যারা এসেছেন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে। আর কোনো কোনো প্লান্টে কাজ চলে প্রকল্পের আওতায়। তবে অধিকাংশই সরাসরি ব্রি’র তত্ত্বাবধানে। কুড়িগ্রামের এক শ্রমিক বলছিলেন, ব্রি’র মাঠে কাজে তার দিনে আয় ৪০০ টাকা।

মাঠের কাজের বাইরেও কতো কাজ তার শেষ নেই। ধানের নমুনা সংগ্রহ থেকে শুরু হয়ে ল্যাবে চলে দিনের পর দিন পরীক্ষা। কোনো কোনো জাত উদ্ভাবনে ১৫ থেকে ২০ বছর পর্যন্ত সময় লেগে যায়। তবে বিজ্ঞানীরা নাছোরবান্দা। থেমে থাকে না। এগিয়ে চলে তাদের গবেষণা। সকল প্রতিবন্ধকতাকে তুড়ি দেয়াই তাদের লক্ষ্য। কোন একটি রোগ দেখা দিলে সেই রোগ প্রতিরোধী জাত উদ্ভাবনে জোর চেষ্টা চালিয়ে যান তারা। আর তাদের সফলতায় আশার আলো দেখে দেশের মানুষ। তবে পদোন্নতিসহ কর্মক্ষেত্রে বিজ্ঞানীদের রয়েছে নানাবিধ সমস্যা।

জানতে চাইল ব্রি মহাপরিচালক ড. মো. শাহজাহান কবীর বলেন, ‘১২ বছর পর্যন্ত বিজ্ঞানীদের একই পদে বহাল থাকতে হয়। পদ নেই তাদের পদোন্নতি দেয়া যায় না। আবার ৬০ বছর বয়সেই বিজ্ঞানীদের অবসরে যেতে হয়। একজন বিজ্ঞানী বা গবেষক মৃত্যুর আগ পর্যন্ত দেশকে দেয়ার সক্ষমতা রাখে। অথচ তারা যথন পরিপক্ক হয়ে উঠে তখনই তাদের অবসরে পাঠিয়ে দেয়া হয়। এটা জাতি হিসেবে আমাদের দুর্ভাগ্য। তবে বর্তমান সরকার বিজ্ঞানীদের অবসরে যাওয়ার বয়স সীমা ৬৫ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে যা এখন জাতীয় দাবি।’

সারাবাংলা/ইএইচটি/টিএম

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন