বিজ্ঞাপন

ইআরপিপি প্রকল্পে স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য নন-মেডিকেল মাস্ক!

August 25, 2020 | 7:26 pm

সৈকত ভৌমিক, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) প্রতিরোধে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে জরুরিভিত্তিতে অনুমোদন দেওয়া হয় ‘ইমার্জেন্সি রেসপন্স অ্যান্ড প্যানডেমিক প্রিপেয়ার্ডনেস’ (ইআরপিপি) প্রকল্প। সারাদেশের চিকিৎসকসহ স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্য সুরক্ষা সরঞ্জাম সরবরাহসহ করোনা মোকাবিলার সক্ষমতা বাড়াতে শুরু হয় প্রকল্পটির কার্যক্রম। কিন্তু শুরু থেকেই এই প্রকল্পের আওতায় বিভিন্ন কেনকাটা নিয়ে উঠেছে প্রশ্ন। এবারে এই প্রকল্পের আওতায় চিকিৎসকসহ স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য নন-মেডিকেল মাস্ক সরবরাহের অভিযোগ উঠেছে সিম করপোরেশন নামে একটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে।

বিজ্ঞাপন

সারাবাংলার অনুসন্ধানে জানা গেছে, মাস্ক সরবারাহের ক্ষেত্রে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর থেকেও নেওয়া হয়নি অনাপত্তিপত্র। এমনকি প্রকল্পের আওতায় পণ্য যাচাই কমিটির যে অনুমোদন নিতে হয়, সেই অনুমোদনও নেই সিম করপোরেশনের। অথচ এরই মধ্যে প্রকল্পের সঙ্গে চুক্তির ৯০ শতাংশ টাকা তুলে নিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।

এদিকে, সিম করপোরেশনের মানহীন ও নন-মেডিকেল গ্রেডের মাস্ক সরবরাহের বিষয়টি দৃষ্টিগোচর হয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীরও। প্রতিষ্ঠানটির মহাখালী অফিসে মঙ্গলবার (২৫ আগস্ট) অভিযান শুরু করেছে র‌্যাব।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের কোনো ধরনের অনুমোদন ছাড়াই ইআরপিপি প্রকল্পে দুই লাখ ১০ হাজার পিস কেএন৯৫ মাস্ক সরবরাহ করেছে সিম করপোরেশন। দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করার জন্য প্রকল্পের আওতায় প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে চুক্তি করা হয় গত ১৮ এপ্রিল। তবে তাদের মাস্কের মান যাচাই প্রক্রিয়াতে ছিল না কোনো স্বচ্ছতা।

বিজ্ঞাপন

ইআরপিপি প্রকল্পের আরও যত অনিয়ম-

অধিদফতরের গ্যারেজে বিশ্বব্যাংক প্রকল্পের পিপিই, জানে না স্টোর

স্বাস্থ্য অধিদফতর সূত্র বলছে, বাংলাদেশের কোনো কোম্পানি কেএন৯৫ মাস্ক তৈরি করে না। এই মাস্ক আমদানি করতে হয়। আর মাস্কসহ যেকোনো স্বাস্থ্যসুরক্ষা সরঞ্জাম আমদানি করতে ঔষধ প্রশাসন অধিদফতর (ডিজিডিএ) থেকে অনুমোদন ও অনাপত্তিপত্র নিতে হয় সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানকে। তবে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের মুখপাত্র ও প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক আইয়ুব আলী সারাবাংলাকে বলেন, বিদেশ থেকে কোনো সুরক্ষা সরঞ্জাম আনতে হলে অবশ্যই তাকে অনাপত্তিপত্র নিতে হবে। এই অনাপত্তিপত্র ছাড়া কোনো পণ্য আনা হলে সেটি আইন বহির্ভূত হবে।

ঔষধ প্রশাসন অধিদফতর সূত্র সারাবাংলাকে নিশ্চিত করেছে, সিম করপোরেশন নামের কোনো প্রতিষ্ঠানকে আমদানি করে সরকারি কোনো প্রকল্পে কেএন৯৫ মাস্ক সরবরাহের জন্য কোনো অনাপত্তিপত্র দেওয়া হয়নি।

বিজ্ঞাপন

শুধু তাই নয়, চীনের সিনা (Xina) নামে একটি কোম্পানির তৈরি কেএন৯৫ মাস্ক আমদানি করেছে সিম করপোরেশন। সূত্র বলছে, এফডিএ অনুমোদিত কেএন৯৫ মাস্ক উৎপাদনকারী কোম্পানির তালিকায় এই সিনা কোম্পানির নামই নেই।

এদিকে, ইআরপিপি প্রকল্পের আওতায় যেসব সুরক্ষা সরঞ্জাম বা পণ্য সরবরাহ করা হয়, সেসবের মান যাচাইয়ে ছয় সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছিল। ওই কমিটির আহ্বায়ক স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (সিডিসি) অধ্যাপক ডা. শাহনীলা ফেরদৌসী। তিনি সারাবাংলাকে জানান, এই কমিটি এখন পর্যন্ত এই প্রকল্পের জন্য কোনো পণ্যেরই মান যাচাই করেনি। অর্থাৎ সিম করপোরেশনের সরবরাহ করা মাস্কের মানও যাচাই করা হয়নি।

সিম করপোরেশনের সরবরাহ করা মাস্কের দাম নিয়েও উঠেছে প্রশ্ন। সিম করপোরেশনের প্রতিটি মাস্কের দাম ধরা হয়েছে ৪০০ টাকা। অথচ এই মাস্ক বাজারে ১৫০ থেকে ২০০ টাকার মধ্যে পাওয়া যায়। ফলে এর মাধ্যমে সিম করপোরেশনকে প্রায় চার থেকে পাঁচ কোটি টাকা বাড়তি মুনাফার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

এছাড়া মাস্কের পাশাপাশি এক হাজার ৫৫০টি ইনফ্রারেড থার্মোমিটারসহ প্রকল্পের সঙ্গে তাদের চুক্তির মোট মূল্য ছিল ৯ কোটি ২০ লাখ ৬০ হাজার টাকা। এরই মধ্যে তাদের প্রকল্প খাত থেকে পরিশোধ করা হয়েছে আট কোটি ২৮ লাখ ৫৪ হাজার টাকা, যা মোট চুক্তির টাকার ৯০ শতাংশ।

বিজ্ঞাপন

এ বিষয়ে জানতে সিম করপোরেশনের ম্যানেজিং পার্টনার মো. মোস্তফা মনোয়ার মিমের মোবাইল নম্বরে গত কয়েকদিন ধরে দফায় দফায় কল করা হলেও তিনি সাড়া দেননি।

সিম করপোরেশনের মাস্ক সরবাহে অনিয়ম-অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে সারাবাংলার পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয় ইআরপিপি প্রকল্পের উপপরিচালক ডা. সাইফুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি তাৎক্ষণিকভাবে এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তিনি সময় নিয়ে কথা বলতে চাইলেও পরবর্তী সময়ে আর ফোন ধরেননি। তার কার্যালয়ে গেলেও এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলেননি তিনি।

সিম করপোরেশনের কাছ থেকে মাস্ক কেনার সময় দর যাচাই সম্পর্কিত বিষয়ও জানার চেষ্টা করা হয়। জানা যায়, ৯ এপ্রিল ইআরপিপি প্রকল্পের জরুরি পণ্য ও সেবা কেনার ক্ষেত্রে চার সদস্যের একটি দরপত্র ও প্রস্তাব মূল্যায়ন কমিটি করা হয়। ওই কমিটির সদস্য স্বাস্থ্য অধিদফতরের ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ইনফরমেশন সেন্টারের (এমআইএস) পরিচালক ডা. হাবিবুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘প্রকল্পের আওতায় একটি কমিটি করা হয়েছে। একটি মিটিংয়ে আমি উপস্থিত ছিলাম। কিন্তু সেখানে দরযাচাই সম্পর্কিত কোনো বিষয় ছিল না। তাই এ বিষয়ে আসলে কিছু বলতে পারছি না।’ তার মতোই সংশ্লিষ্ট অন্যরাও এ বিষয়ে কিছু বলতে পারেননি।

নাম প্রকাশ না করার সূত্রে স্বাস্থ্য অধিদফতরের একজন কর্মকর্তা সারাবাংলাকে বলেন, চিকিৎসা খাতে নিয়োজিতদের সুরক্ষা সামগ্রীর মানের সঙ্গে আপস করার সুযোগ নেই। সেক্ষেত্রে অবশ্যই মান যাচাই কমিটির অনুমোদন লাগবে। সেখান থেকে অনুমতি পাওয়ার পরে সিএমএসডি বা প্রকল্প নির্ধারিত স্থানে পৌঁছাবে সুরক্ষা সামগ্রী। কেবল মাস্ক নয়, যেকোনো সুরক্ষা সরঞ্জামের ক্ষেত্রেই একই প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হবে। আর সব প্রক্রিয়ার পর স্টোরের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি মান নিয়ন্ত্রক কমিটির অনুমতিপত্র দেখে নিজে সই করে এসব পণ্য বুঝে নেবেন।

সারাবাংলার অনুসন্ধান বলছে, সিম করপোরেশনের মাস্ক সরবরাহের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের নিয়মই অনুসরণ করা হয়নি। শুধু তাই নয়, সংশ্লিষ্ট প্রায় সবগুলো নিয়ম ভেঙে কোনো অনুমোদন ছাড়াই সিম করপোরেশনের আমদানি করা কেএন৯৫ মাস্কগুলো গত প্রায় তিন মাস ফেলে রাখা হয়েছে প্রকল্পের মহাখালী ডিওএইচএসের একটি অফিসে।

এ বিষয়ে সারাবাংলার পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয় ইআরপিপি প্রকল্পের উপপরিচালক ডা. সাইফুল ইসলামের সঙ্গে। তিনিও ‘পরে কথা বলব’ বলে আর ফোন ধরেননি। অফিসে গেলেও দেখা দেননি তিনি। ইআরপিপি প্রকল্পের পরিচালক ডা. কাজী শামীম হোসেনকেও ফোনে পাওয়া সম্ভব হয়নি। অফিসে গিয়ে দেখা করলে তিনি বলেন, ‘নতুন এসেছেন’ বলে এসব বিষয়ে নিয়ে কিছু বলতে পারছেন না।

প্রকল্প কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, এসআরএস ফ্যাশনস অ্যান্ড ডিজাইন, জাদিদ অটোমোবাইলস, সিম করপোরেশনসহ যেসব প্রতিষ্ঠানকে এপ্রিল-মে মাসে বিভিন্ন সুরক্ষা সরঞ্জাম সরবরাহের কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছিল, সেগুলো নিয়ে কথা বলতে চাইছেন না প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কেউই। প্রকল্পের ‘অনেক কিছু’ই এখন নতুনভাবে বিবেচনা করা হচ্ছে।

এদিকে, ইআরপিপি প্রকল্পের বিভিন্ন চুক্তি ও অনিয়মের অভিযোগ খতিয়ে দেখতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। ওই কমিটির একজন সদস্য সারাবাংলাকে বলেন, ‘তদন্ত শুরু হয়ে গেছে। তদন্তাধীন বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাচ্ছি না।’ নিজের নামও প্রকাশ করতে চাননি তিনি।

করোনা পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে বিশ্বব্যাংকের ৮৫০ কোটি টাকা সহজ শর্তের ঋণ দিয়ে ইআরপিপি প্রকল্পটি হাতে নেয় সরকার। ১৯ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশেষ ব্যবস্থায় প্রকল্পটিতে অনুমোদন দেওয়ার পর ২ জুন প্রকল্পটি একনেকে অনুমোদিত হয়। পরিকল্পনা কমিশনে ২০১৯-২০২০ অর্থবছরের জন্য প্রকল্পটির অনুকূলে ২০৬ কোটি টাকা বরাদ্দের আবেদন জানানো হয়। তিন বছর মেয়াদি এই প্রকল্পটি ২০২০ সালের এপ্রিল মাস থেকে ২০২৩ সালের জুনের মধ্যে বাস্তবায়ন করা হবে।

সারাবাংলা/এসবি/টিআর

Tags: , , , , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন