March 10, 2018 | 6:57 pm
তুহিন সাইফুল, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট ।।
নিজের কাছাকাছি চরিত্রে সবাই অভিনয় করতে পারে, মিষ্টি মিষ্টি হেসে নায়িকাসুলভ একটা আচরণ, হিরোইনকাটিং যেটাকে বলে সেটা করাটা আসলে খুব একটা কষ্টসাধ্য না। যে জীবন আমি দেখিনি, আমার চরিত্র থেকে অনেক দূরের যে চরিত্র, সেগুলো করতে প্রথমদিকে আমার ভালো লাগতো, তারপর এটা আমার কাছে নেশার মতো হয়ে গেছে। আমাদের অভিনয় শিল্পীদের সবচেয়ে বড় পাওয়া কি জানেন? এখানে এক জীবনে বহুজীবন বাঁচা যায়। এটা একটা মাধ্যম যেখানে কখনো বারবনিতার জীবনে অভিনয় করছি, কখনোবা সার্কাস পার্টির এক খিলাড়ির চরিত্রে অভিনয় করছি, কখনো আমি একজন প্রতিবন্ধীর মায়ের ভূমিকায় অভিনয় করছি, কখনো আমি সংগ্রামী নারীর ভূমিকায় অভিনয় করছি, নানান রকম শেডসে অভিনয় করা যায় এখানে। সেখানে যেটা হয়েছে যে এখনো আমার পছন্দগুলো এরকমই আসছে, সবচেয়ে বড় কথা আমার ওপর পরিচালকরা ভরসা করছে। তারা আমাকে এক্সপেরিমেন্টাল মানে যেখানে একটু কাজ করার সুযোগ আছে তেমন চরিত্র অফার করেছে। সেদিক থেকে আমি ভীষন ভাগ্যবান। বাংলাদেশের পরিচালকরা এই বিষয়টা খুব মাথায় রাখে।
কেন? ডুবসাতার যেভাবে বাংলাদেশে আমাকে উপস্থাপন করছে সেটারও তো একটা আলাদা সৌন্দর্য আছে। ডুবসাতার ছবিটি আমার পছন্দের এবং আমার অভিনীত অন্যতম সেরা একটা ছবি। দেখুন, ইমপারফেকশনেরও আলাদা একটা বিউটি আছে। ঋত্বিক কুমার ঘটক যখন ছবি বানাতেন, তখন কিন্তু তিনি গ্রামার ফলো করতেন না। এখানে একটা ক্লোজ আপ, এখানে একটা লংশট, অতিরিক্ত থিয়েট্রিক্যাল অ্যাকটিং, অতিরিক্ত আবেগ, অতিরিক্ত স্ট্রাগল, দেশ ভাগের কষ্ট এগুলো সমস্ত কিছু নিয়ে উনি কিন্তু কোন গ্রামার মানতেন না। ইমপারফেকশনের আলাদা একটা বিউটি আছে। দেখুন, আমাদের দেশটা আলাদা, আমাদের জনপদ আলাদা, আমাদের ভূগোল আলাদা। ওদের হয়তো ইন্টেলেকচুয়াল আছে, আমাদের ভূগোল আছে। আমি বলছিনা আমাদের ইন্টেলেকচুয়াল নেই। আমাদের দেশে মানুষ বেশি, ক্রাইসিস বেশি, তবে আমাদের এখানে যেটা আছে সেটা হচ্ছে প্রফেসনাল আচরণের একটু অভাব আছে। তবুও একটা বিষয় খেয়াল করে দেখবেন যে প্রেমটা কিন্তু বেশি আমাদের ছবিতে পাওয়া যায়। সততাটা বেশি কিন্তু আমাদের ছবিতে পাওয়া যায়। হ্যাঁ, অনেক সময় দিনের শেষে ছবিটা হয়তো ছবি হয়ে উঠে না। বা আমাদের এক্সপেকটেশন পূরণ করতে পারে না। আসলে এটাও ঠিক যে, আমাদের দেশে প্যাকেজিংটা ভালো না। ওদের দেশে প্রথমেই যেটা হয় যে ওরা পুরোটা আগে দেখতে পায়। মানে আগে পুরোটা দেখে তারপর ওই অনুযায়ি তারা সাজায়। আমরা স্বপ্নটা অনেক বড় দেখি কিন্তু আমাদের এক্সিকিউশনে একটু অসুবিধা আছে। গাফিলতিও আছে বলা যায়!
‘বয়স বাড়ার সাথে সাথে…’ কথাটা খুবই ক্লিশে শোনাচ্ছে। আসলে আমি দেখেছি একটা জিনিস যে এই বয়স নিয়ে বাংলাদেশের সাংবাদিক, দর্শক এবং সিনেমায় আমার যে সহকর্মীরা আছেন তাদের একটা সমস্যা আছে। আমি মনে করি অল্প বয়সে, ধরুণ, আঠারো বছর বয়সে একজন নারীকে যে সুন্দর লাগে, মানে যাকে তাকেই আঠারো বছর বয়সে সুন্দর লাগে, কিন্তু আপনার যতো বয়স হবে, অভিজ্ঞতা আসবে, কপালে ভাঁজ পড়বে, সেই আঁকিবুকি, অভিজ্ঞতা নিয়েই কিন্তু সৌন্দর্যটা। আমার কাছে মনে হয়, এটা আরো বেশি সুন্দর। সেটা বিষয় নয়, একটা মানুষ যখন কাজের দিকে ফোকাস করতে থাকে, তখন তার সাথে অন্যান্য যেসব জিনিসগুলো যেগুলো আছে, সেগুলো না এমনি এমনি পিছলে পড়ে যায়। ইটস অল এবাউট কাজ। আমি কত দিন থাকতে পারি… এমন না যে আমি অনেকদিন জোর করে থাকবো, দর্শক যদি অপছন্দ করে, আমি বিরক্ত হয়ে যাই, ডেফিনিটলি আমি তখন আর কাজ করবো না, নতুন কিছুতে নিজের মুক্তি খুঁজবো।
ঢাকা তো আমার শহর। তবে কলকাতা অবশ্যই আমার খুব আপন শহর, আমার কর্মক্ষেত্র। ঢাকা যদি আমার জন্মস্থান হয় ওটা আমার কর্মস্থান। আর এমনিতেই দেখুন কলকাতাকে… আমার একার না এটা আপনারও হয়তো খুব কাছের একটা শহর। আমার মনে হয় বাংলাদেশীদের খুব প্রিয় শহর কলকাতা। আমি সবসময় ক্ল্যাসিক অ্যাপ্রোচটা পছন্দ করি। আমার একটা দুঃখ আছে, কলকাতায় প্রচণ্ডভাবে কলকাতার একটা বৈশিষ্ট্য আছে, তারা খুব নিজের মতো। কিন্তু ঢাকায় না আমরা আমাদের ঐতিহ্য সংরক্ষণ করি না। এমনকি আমাদের আর্কিটেকচারাল জায়গাটা দেখুন, ঢাকাকে কখনো বোম্বের মতো লাগছে, আমি যখন বাড়ি ফিরি হঠাৎ করে দেখি বুর্জ খলিফার মতো একটা কিছু তৈরি হয়ে গেছে, তাজমহলের মতো একটা কিছু তৈরি হয়ে গেছে, আমাদের ঢাকার না কোন বৈশিষ্ট্য আমি পাই না। স্থাপত্যশৈলীও যদি বলি, আমাদের চারুকলা, আমাদের জাদুঘর এগুলা হলো ঢাকার আর্কিটেকচার। আমরা এখন ওই জায়গা থেকে অনেক সরে আসছি। খুবই কনট্রাস্ট! কলকাতায় এই জিনিসগুলো আছে, ওরা মূলে থাকে। আমার নিজের ব্যক্তিগতভাবে পছন্দ এটা।
এমদম না। দেখেন, আমি আজকে যে এখানে ক্যামেরার সামনে রঙচঙ মেখে স্পটলাইটে আছি, এটা হলো জয়া আহসানের ইমেজ! এটা কিন্তু ব্যক্তি জয়া না, ব্যক্তি জয়া অনেক সহজ, সাধারণ। অভিনয় আমার কাজ, আপনার কাজ যেমন লেখালেখি করা। আমার কাজ ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে অভিনয় করা। আমি ব্যক্তিগতভাবে সেলিব্রেটিশিপটাকে পছন্দ করি না। সেলিব্রেটি পূজা যে হয় বা নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে থাকা এটা আমার পছন্দ নয়। আর যদি আপনি শিল্পী হতে চান, আমি মনে করি যে যতোটা সাধারণ ভাবে বাঁচতে পারে, জীবন যাপন করতে পারে সেই শিল্পী হয়।
যখন আমি যে চরিত্রে অভিনয় করি ওটার হ্যাংওভার আমার ভেতর থাকে। আমি যখন কলকাতায় ঢাকুরিয়া ব্রিজের ওপরে দাঁড়িয়ে থাকি, নীচে দেখি যে রান্নার মাসিরা যারা নাকি রান্না করে প্রতিদিন সকাল বেলায় টিফিন ক্যারিয়ারে করে খাবার দেয়, এদের দেখে আমার মনে হয় এদের জীবনটা কতো সুন্দর! আমার মনে হয় আমি সারাজীবনই রান্না করে কাটিয়ে দিতে পারবো, তরকারি কেটেই কাটিয়ে দিতে পারবো কিন্তু ওটা মনে হয় আসলে, আমরাতো লোভী, না? আমরা আসলে শিল্পী তো, আমাদের এই ধরণের জিনিসগুলো হয়, এইসব ফ্যান্টাসি আমরা করি। হ্যাঁ, এখন মাঝে মাঝে মনে হয়, আমি একটু শপিংয়ে যাই, নরমাল মানুষের মতো একটু মিশি। মানুষ যতো আসলে স্পটলাইটে থাকে, পাহাড়ের উপরে উঠে তখনই মানুষ একা হয়ে যায়। আর উপর থেকে নিচের মানুষগুলোতে দেখে মনে হয় কতই না সুখী।
একা না হলেও মাঝে মাঝে তো অবশ্যই একা! অবশ্যই একা!
আমার তো গোল্ডফিশ মেমরী, আমি কিছু মনে রাখি না। আমি যখন যেটা করি সেটা নিয়ে খুব খুশি থাকি। তবে যখন সময় হয় একা বসার, তখন একটা সেল্ফ এসেসমেন্ট হয়, এর বেশি কিছু হয় না। কি পেলাম, কি হারালাম, এই হিসেবটা আসলে হয় না কখনো, তবে একটা জিনিস ঠিক, আমার মনে হয় মানুষ যখন মৃত্যুর কাছাকাছি এগিয়ে যায়, জীবনের শেষ ভাগে পৌঁছে যায়, আমার মনে হয় মানুষ সেই হিসেবটা কষে, আমিও হয়তো কষবো। শিল্পী হিসেবে না, মানুষ হিসেবে কি দিলাম, কি পেলাম, কি হারালাম সেগুলো হয়তো ভেবে দেখবো।
আমি আসলে এই সফরটাতেই থাকতে চাই, গন্তব্যে পৌঁছুতে চাই না। গন্তব্যে পৌঁছে গেলেই শেষ। আমি জার্নিতেই থাকতে চাই। আমি কখনোই শিক্ষক হতে চাই না, সারা জীবন ছাত্র থাকতে চাই।
ছবি: আশীষ সেনগুপ্ত
সারাবাংলা/টিএস/পিএম