বিজ্ঞাপন

‘অনুপ্রবেশকারী’র ঠাঁই হলে দায় নেতার, কড়া হুাঁশিয়ারি আ.লীগে

September 3, 2020 | 12:35 am

নৃপেন রায়, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির বিষয়ভিত্তিক উপকমিটিগুলোর গঠন প্রক্রিয়া শেষ করার তাগাদা দিয়েছে আওয়ামী লীগ। প্রস্তাবিত উপকমিটিগুলো যাচাই-বাছাই করে দলীয় সভাপতির কার্যালয়ে ১৫ সেপ্টেম্বরের মধ্যে জমা দেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এই তালিকা থেকেই দলীয় প্রধান শেখ হাসিনার মতামতের ভিত্তিতে উপকমিটিগুলো চূড়ান্ত করা হবে। তবে এসব উপকমিটিতে যেন কোনোভাবেই ‘অনুপ্রবেশকারী’ বা ‘বিতর্কিত’দের স্থান না হয়, সেদিকে কড়া নজর রাখতে বলা হয়েছে নেতাদের। কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়ে বলা হয়েছে, উপকমিটিগুলোতে ‘অনুপ্রবেশকারী’ বা ‘বিতর্কিত’দের স্থান হলে এর জন্য কমিটির সংশ্লিষ্ট নেতাকে দায়ভার নিতে হবে।

বিজ্ঞাপন

বুধবার(২ সেপ্টেম্বর) দুপুরে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সম্পাদকমণ্ডলীর সভা থেকে এ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সভায় উপস্থিত একাধিক সূত্র সারাবাংলাকে এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শনাক্ত হওয়ার পর এই প্রথম দলের সম্পাদকমণ্ডলীর কোনো সভা অনুষ্ঠিত হলো। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সরকারের সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের সভাপতিত্বে সভায় দলের সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। সভা শেষে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সে যুক্ত হন। তিনি করোনাভাইরাস পরিস্থিতির মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি মেনে সারাদেশে সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডের গতিশীলতা জোরদার করার নির্দেশনা দেন।

আরও পড়ুন- ‘প্রণব মুখার্জি ১/১১’র সময় আমার মুক্তির জন্য অনেক কাজ করেছেন’

বিজ্ঞাপন

দলের নেতাকর্মীরা জানিয়েছেন, বিভিন্ন সময়ে বেশকিছু বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে দলের বাইরে-ভেতরে সমালোচনার জন্ম দেন উপকমিটির নেতারা। বিভিন্ন অপকর্মে তাদের ব্যক্তি সমালোচনার পাশাপাশি আওয়ামী লীগ সংশ্লিষ্টতার কারণে বিতর্কের ঝড় ওঠে। দলের বিভিন্ন উপকমিটিতে বেশকিছু ‘অনুপ্রবেশকারী’ স্থান পেয়েছে বলেও অভিযোগ ওঠে।

জানা যায়, দলের ২০০৯ সালের জাতীয় সম্মেলনে দলীয় গঠনতন্ত্রে সংশোধনীর মাধ্যমে কেন্দ্রীয় উপকমিটি গঠনের বিধান সংযুক্ত হয়। প্রতিটি সম্পাদকীয় পদের সঙ্গে সহসম্পাদকদের নিয়ে সে বিষয়ে একটি উপকমিটি গঠন করার কথা বলা হয়। বিধানে সহসম্পাদকদের পদ সংখ্যা নির্দিষ্ট না থাকায় অনেককে উপকমিটিগুলোতে স্থান দেওয়া হয় সহসম্পাদক হিসেবে। পরে ২০১২ সালের কেন্দ্রীয় সম্মেলনে আরেক দফা সংশোধনীর মাধ্যমে একেকটি উপকমিটিতে পাঁচ জন করে সহসম্পাদক রাখার বিধান করে দেওয়া হয়। তাতে ১৯টি কেন্দ্রীয় উপকমিটিতে মোট ৯৫ জন সহসম্পাদকের পদ তৈরি হয়।

ওই বছর পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনের পর এক সংবাদ সম্মেলনে ওই সময়কার সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ৬৩ জন সহসম্পাদকের নাম ঘোষণা করেন। এর পরে যাদের উপকমিটিতে সহসম্পাদক পদে স্থান দেওয়া হয়, তাদের অনেককে নিয়েই বিতর্ক তৈরি হয়। উপকমিটি গঠনের প্রক্রিয়া, সহসম্পাদকদের যোগ্যতার মতো বিষয়গুলো নিয়ে বিতর্ক দেখা দেয়। যেমন— ২০১২ সালে সৈয়দ আশরাফ ৬৩ জনের নাম ঘোষণা করার বেশকিছু দিন পর তৎকালীন এক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের ব্যবসায়িক কার্যালয় থেকে এ পদে প্রায় ৭০ জনের নাম ঘোষণা করা হয়। দলীয় কার্যালয় থেকে এ প্রক্রিয়া না হওয়ায় সমালোচনার ঝড় বয়ে যায়।

বিজ্ঞাপন

এরপর ২০১৬ সালে সহসম্পাদক পদ নিয়ে সমালোচনা তুঙ্গে ওঠে। ওই সময় কেন্দ্রীয় সম্মেলনের পর দলের তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত দফতর সম্পাদকের সইয়ে কাগজে-কলমে প্রায় ৪১৬ জনকে সহসম্পাদক পদ দেওয়া হয়। এতে অসংখ্য বিতর্কিত ব্যক্তি প্রথমবারের মতো আওয়ামী লীগের কেন্দ্রের সংশ্লিষ্টতা পায়। এ নিয়ে সাবেক ছাত্রনেতাদের ক্ষোভের মুখেও পড়েন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। তবে ২১তম জাতীয় সম্মেলনে উপকমিটির সহসম্পাদক পদটি বাতিল করে উপকমিটির সদস্য পদ অন্তর্ভুক্ত করে গঠনতন্ত্রে সংশোধনী আনে আওয়ামী লীগ। এসব উপকমিটিতেও যারা স্থান পেয়েছিলেন, তাদের নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। সবশেষ করোনা পরীক্ষা কেলেঙ্কারিতে জড়িত রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান মো. সাহেদ ও সরকারি হাসপাতালে নকল মাস্ক সরবরাহ করা অপরাজিতা ইন্টারন্যাশনালের মালিক শারমিন জাহান আওয়ামী লীগের দুই উপকমিটির সদস্য ছিলেন বলে তথ্য প্রকাশ পেলে উপকমিটি নিয়ে বিতর্কের ষোলকলা পূর্ণতা পায়।

করোনা সংকটের মধ্যে দলের প্রথম এই সম্পাদকমণ্ডলীর সভায় উপস্থিত কয়েকজন নেতা জানান, দলের শীর্ষ নেতৃত্ব আগেও একবার এসব বিষয়ে সতর্ক করে দিয়েছিল। আজকের বৈঠকে সবাইকে সুনির্দিষ্ট করে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে— যদি কোনো বিতর্কিত, হাইব্রিড বা অনুপ্রবেশকারী এসব কমিটিতে স্থান পায়, তাহলে তার দায়-দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট কমিটির নেতাদের বহন করতে হবে। আর এবার কমিটি জমা দিলেই অনুমোদন পাবে না, দলীয় সভাপতি যাছাই-বাছাই করে এসব কমিটি অনুমোদন দেবেন। তার কাছে যাওয়া তালিকাতেও অনুপ্রবেশকারীদের নাম থাকলে সংশ্লিষ্ট নেতাকে জবাবদিহি করতে হবে। দলে অনুপ্রবেশকারীদের প্রবেশ বন্ধ করতেই দলীয় সভাপতি পর্যন্ত উপকমিটি চূড়ান্ত করার প্রক্রিয়াটি গড়াচ্ছে বলে জানিয়েছেন তারা।

বৈঠকে উপস্থিত সূত্র সারাবাংলাকে জানিয়েছে, সভায় আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাকে সম্পাদকমণ্ডলীর বৈঠকে গৃহীত সাংগঠনিক প্রস্তাবনাগুলো অবহিত করেন বৈঠকের সভাপতি ওবায়দুল কাদের। এর মধ্যে শেখ হাসিনার জন্মদিন উদযাপন সংক্রান্ত একটি প্রস্তাবও ছিল। শেখ হাসিনা শুরুতেই সেই প্রস্তাবটি নাকচ করে দেন। প্রস্তাবনাগুলোর মধ্যে উপকমিটি সংক্রান্ত প্রস্তাবটি গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করেন তিনি।

বিজ্ঞাপন

শেখ হাসিনা বলেন, উপকমিটিগুলো পূর্ণাঙ্গ করে ফেলা খুব গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত। এটা তাড়াতাড়ি করা উচিত। কারণ উপকমিটিগুলো যেন বসতে পারে, বিভিন্ন বিষয়ভিত্তিক আলোচনা, সেমিনার আয়োজন বা নীতিমালা প্রণয়ন, দলের ভবিষ্যৎ কর্মসূচিগুলো নির্ধারণ— এসব বিষয়ে উপকমিটিগুলো যথাযথ ব্যবস্থা নিতে পারবে।

দলের সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্যদের উদ্দেশে তিনি আরও বলেন, প্রত্যেকের যার যার বিষয়ভিত্তিক দায়িত্বটা পালন করা দরকার। আমাদের নির্বাচনি ইশতেহারে আমরা যে ঘোষণা দিয়েছি, পাশাপাশি আমাদের এখন যে পলিসি আছে— সেই পলিসিগুলো থেকে শুরু করে আমাদের প্রতিশ্রুতিগুলো কতটা রক্ষা করতে পেরেছি, ভবিষ্যতে কতটুকু করব— এর সবকিছু আলোচনা করতে হবে। আমরা কিছু দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়েছি। প্রেক্ষিত প্রেক্ষিত পরিকল্পনাটা আমরা নতুনভাবে গ্রহণ করেছি। এসব নিয়ে কাজ করতে হবে। তার জন্য সংগঠনটাকে সুসংগঠিত করতে হবে।

সংগঠনকে গতিশীল করার তাগাদা দিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের অনেক জেলার কমিটি করোনাভাইরাসের কারণে সম্পূর্ণ করা যায়নি। যেহেতু কাউন্সিল হয়ে গেছে, সেই কমিটিগুলো যেন তাড়াতাড়ি হয়, সেই ব্যবস্থা নিতে হবে। আর এটাও মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশের জনগণ বারবার আমাদের ভোট দিয়েছে। আমরা তাদের ভোটে নির্বাচিত হয়ে এসেছি। তাই তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা আমাদের পূরণ করতে হবে। এর জন্য যা কিছু করা দরকার, তার সবকিছু করতে হবে। করোনার মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি মেনে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড করতে হবে। আওয়ামী লীগ যেন মানুষের চাওয়া-পাওয়া পূরণ করতে পারে, সেজন্য দলের সবাইকে আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করে যাবে— সেটাই আমি চাই। আমাদের সামনে আদর্শ জাতির পিতা। সেই আদর্শ নিয়ে আমাদের চলতে হবে। তিনি যে স্বপ্ন দেখতেন বাংলাদেশকে নিয়ে, আমরা সেটা পূরণ করতে চাই।

এই বৈঠকে ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে যুক্ত হলেও শারীরিকভাবে উপস্থিত হয়ে বৈঠক আয়োজনের কথা জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, করোনার মধ্যে সবার সঙ্গে আমার দেখা হচ্ছে না। তবে সিদ্ধান্ত নিয়েছি— সীমিত আকারে বারবার মিটিং করব। প্রথমে একটা প্রেসিডিয়াম মিটিং করব, এরপরে কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী পরিষদের মিটিং করব, তারপরে উপদেষ্টা পরিষদের মিটিং করব। সংসদ অধিবেশন শেষ করে আলাদা আলাদা করে এই মিটিংগুলো করব।

এর আগে দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনার উদ্দেশে ওবায়দুল কাদের বলেন, আমরা নিজেরা আলোচনা করেছি। কিছু বিষয়ে প্রস্তাবনা তৈরি করেছি। আমাদের সবার ইচ্ছা, আপনার একটা গাইডলাইন আমরা চাই। আমাদের যেসব জেলা, মহানগর ও সহযোগী সংগঠনের সম্মেলন হয়েছে, তাদের ১৫ সেপেম্বরের মধ্যে আপনার অফিসে পূর্ণাঙ্গ কমিটি জমা দেওয়ার একটা নির্দেশনা দিয়েছি। আরেকটি হলো এই সময়ের মধ্যে প্রত্যেক সম্পাদককে চেয়ারম্যানের সঙ্গে পরামর্শ করে ৩৫ সদস্যের উপকমিটি গঠনের জন্য আমরা একটা রিকমেন্ডেশন তৈরি করেছি। সিদ্ধান্ত নেওয়ার মালিক আপনি। আর সীমিত আকারে সাংগঠনিক কর্মসূচি এখন থেকে পালন করার জন্য তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত নির্দেশনা দিচ্ছি।

সারাবাংলা/এনআর/টিআর

Tags: , , , , , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন