বিজ্ঞাপন

বাবুলের শ্বশুরের ‘ভিন্ন সুর’ কেন, জানতে চাইবে পিবিআই

September 6, 2020 | 7:48 pm

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট

চট্টগ্রাম ব্যুরো: করোনভাইরাসের সংক্রমণ পরিস্থিতিতে সাত মাস স্তিমিত থাকার পর সাবেক পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতু হত্যা মামলার তদন্তে গতি এসেছে। পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) আদালতের নির্দেশে এই চাঞ্চল্যকর মামলার তদন্ত করছে। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, মিতুর বাবা কেন বাবুল আক্তারকেই খুনি হিসেবে দাবি করছেন— শুরুতেই এ বিষয়টিকে ‍গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত এগিয়ে নিতে চায় পিবিআই।

বিজ্ঞাপন

দৃশ্যমান তদন্ত কার্যক্রমের শুরুতে মিতু হত্যা মামলায় গ্রেফতার মো. শাহজাহান মিয়া, মোতালেব মিয়া ও আনোয়ারকে হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের আবেদন জানিয়েছিল পিবিআই। রোববার (৬ সেপ্টেম্বর) শুনানি শেষে চট্টগ্রামের মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট সফি উদ্দিন কারাগারে থাকা শাহজাহানকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য একদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন। বাকি ‍দু’জনকে কারাফটকে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি দিয়েছেন আদালত।

সূত্রমতে, রিমান্ডের আবেদনে শাহজাহানকে হত্যাকাণ্ডে অংশগ্রহণকারী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। মোতালেব মিতুকে লক্ষ্য করে গুলি করেছিল এবং আনোয়ার মিতু বাসা থেকে বের হওয়ার পর তাকে অনুসরণ করেছিল বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা পিবিআই, চট্টগ্রাম মহানগর শাখার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. মঈন উদ্দিন সারাবাংলাকে বলেন, ‘গত জানুয়ারিতে আমরা মামলাটির তদন্তভার পাই আদালতের নির্দেশে। এরপরই করোনা পরিস্থিতি শুরু হয়। আদালতের কার্যক্রমও বন্ধ ছিল। এসময়ের মধ্যে আমরা ফাইল ওয়ার্ক করে রেখেছি। এখন আনুষ্ঠানিক তদন্ত কার্যক্রম শুরু করেছি।’

বিজ্ঞাপন

আরও পড়ুন-

তদন্তের শুরুতেই দু’টি প্রশ্নের জবাব খোঁজা হবে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আপনারা জানেন, বাবুল আক্তারের শ্বশুর মোশাররফ হোসেন হত্যাকাণ্ডের পর প্রথমে তার জামাতার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ তোলেননি। এমনকি জামাতার প্রশংসাও করেছিলেন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে পত্রপত্রিকায় বক্তব্য দিয়ে তিনি বাবুল আক্তারকেই খুনি হিসেবে দায়ী করছেন। এটা তিনি কেন করছেন, তাকেই ক্লিয়ার করতে হবে। আমরা উনাকে জিজ্ঞাসাবাদ করব এবং এ সংক্রান্ত যত সাক্ষী আসবে, তাদের কাছে বিষয়গুলো জানতে চাইব।’

‘আরেকটি বিষয় হচ্ছে— এ পর্যন্ত তদন্তে যেটা পাওয়া গেছে, সেটা হচ্ছে কামরুল ইসলাম শিকদার ওরফে মুছা মিতু হত্যার প্রধান পরিকল্পনাকারী। কিন্তু সে কেন এই হত্যাকাণ্ডে জড়াল, নেপথ্যে কে কে আছে, মূল নির্দেশদাতা কে, তার ইনটেনশন কী ছিল— এগুলো আমাদের বের করতে হবে,’— বলেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মঈন।

বিজ্ঞাপন

ঘটনাক্রম

২০১৬ সালের ৫ জুন সকালে নগরীর পাঁচলাইশ থানার ও আর নিজাম রোডে ছেলেকে স্কুলবাসে তুলে দিতে যাওয়ার পথে বাসার অদূরে গুলি ও ছুরিকাঘাত করে খুন করা হয় মিতুকে। এই ঘটনায় বাবুল আক্তার বাদী হয়ে নগরীর পাঁচলাইশ থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন।

হত্যা মামলায় ওই বছরের ৮ জুন ও ১১ জুন নগর গোয়েন্দা পুলিশ হাটহাজারি উপজেলা থেকে আবু নসুর গুন্নু ও বায়েজিদ বোস্তামী থানার শীতল ঝর্ণা থেকে শাহ জামান ওরফে রবিন নামে দু’জনকে গ্রেফতারের খবর জানায়। পরে পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়, মিতু হত্যায় তাদের সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়নি। দীর্ঘদিন জেলে থাকার পর তারা জামিনে মুক্তি পান।

ওই বছরের ২৪ জুন রাতে ঢাকার বনশ্রীর শ্বশুরবাড়ি থেকে বাবুল আক্তারকে ঢাকা গোয়েন্দা পুলিশের কার্যালয়ে নিয়ে প্রায় ১৪ ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। এর ফলে সন্দেহের তীর যায় বাবুলের দিকে। হত্যায় বাবুল আক্তারের সম্পৃক্ততা নিয়ে বিভিন্ন সংবাদ প্রকাশিত হয়। এসময় পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়, বাবুল আক্তার স্বেচ্ছায় চাকরিতে ইস্তফা দিয়েছেন।

২৬ জুন মো. আনোয়ার ও মো. মোতালেব মিয়া ওরফে ওয়াসিম নামে দু’জনের গ্রেফতারের খবর প্রকাশ করে পুলিশ। তারা আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। তারা হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে জানান, মিতু হত্যায় ব্যবহৃত অস্ত্রটি তাদের ভোলা দিয়েছিল।

বিজ্ঞাপন

এরপর এহেতাশামুল হক ভোলা ও তার সহযোগী মো. মনিরকে গ্রেফতারকরা হয়। তাদের কাছ থেকে পয়েন্ট ৩২ বোরের একটি পিস্তল উদ্ধার করা হয়, যেটি মিতু হত্যায় ব্যবহৃত হয়েছে বলে পুলিশের ভাষ্য। এ ঘটনায় পুলিশের পক্ষ থেকে ভোলা ও মনিরকে আসামি করে একটি অস্ত্র মামলাদায়ের করা হয়।

এরপর ১ জুলাই মোটরসাইকেল সরবরাহ করার অভিযোগে মুছার ভাই সাইদুল আলম শিকদার ওরফে সাক্কু ও শাহজাহান নামে দুইজনকে গ্রেফতার করা হয়। ভোলা, সাইদুল ও রবিন ইতোমধ্যে জামিনে মুক্তি পেয়েছেন।

কিছুদিন নিশ্চুপ থাকার পর ২০১৬ সালের ৯ আগস্ট পদত্যাগপত্র প্রত্যাহারের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেন বাবুল আক্তার। নানা নাটকীয়তা শেষে ৬ সেপ্টেম্বর বাবুলকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

বাবুলের বিরুদ্ধে শ্বশুরের যত অভিযোগ

২০১৬ সালে হত্যাকাণ্ডের বছরখানেক পর থেকেই মিতুর বাবা সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা মোশাররফ হোসেন দাবি করে আসছিলেন, বাবুল আক্তারের পরিকল্পনায় ও নির্দেশে তার মেয়ে মিতুকে খুন করা হয়েছে। মিতু হত্যার চার বছরে চলতি বছরেও সারাবাংলার সঙ্গে আলাপে এই দাবিতে অনড় থেকে হত্যার নেপথ্যে আরও চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশ করেছেন তিনি।

মোশাররফ হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘২০১৩ সালে বাবুল আক্তার কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার থাকা অবস্থায় সেখানে কর্মরত ভারতের নাগরিক এক এনজিও কর্মকর্তার (নাম প্রকাশ করা হলো না) সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। মিতু বিষয়টি জানতে পেরে তার মাকে জানিয়েছিল। এটা নিয়ে তাদের মধ্যে যখন অশান্তি শুরু হয়, বাবুল আক্তার আমার মেয়েকে নির্যাতন করা শুরু করে। আমি বিষয়টি তার ঊর্ধ্বতন কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তাকে জানিয়েছিলাম। কিন্তু উনারা আমাকে পাত্তাই দেননি। উনারা বলেছিলেন, বাবুল আক্তার সৎ-ভালো অফিসার, সে এমন কাজ করতে পারে না। অথচ শেষ পর্যন্ত আমার মেয়েটা মারাই গেল। মেয়েটাকে যে বাবুল মেরেই ফেলবে, এটা আমি আর মিতুর মা কখনো ভাবিনি।’

তদন্তের শুরু থেকে নানা অসঙ্গতির তথ্য তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘আমি বলেছিলাম, চট্টগ্রামের হাটহাজারী সার্কেল থেকে কক্সবাজার জেলা পর্যন্ত চাকরিকালীন বাবুলের ঘনিষ্ঠ অধঃস্তন অফিসার, বডিগার্ড, অর্ডারলি যারা ছিল, তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য। কারণ তারা বাবুলের সংসারে অশান্তি এবং পরকীয়ার বিষয়টি জানত। কিন্তু তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে কি না, এমন প্রশ্ন তদন্তকারী কর্মকর্তাকে বারবার করেও আমি কোনো সদুত্তর পাইনি। মারা যাওয়ার পর আমার মেয়ের মোবাইলের ২৮টি এসএমএস তদন্তকারী কর্মকর্তার কাছে আমি জমা দিয়েছিলাম। সেগুলো নিয়ে বাবুল আক্তারকে জিজ্ঞাসাবাদ করার কথা বলেছিলাম। কিন্তু সেটাও করা হয়নি।’

হত্যাকাণ্ডের পরপরই বাবুলের জড়িত থাকার বিষয়ে অভিযোগ তোলেননি কেন— জানতে চাইলে সাবেক এই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ‘বাবুলের ঘনিষ্ঠ কিছু বন্ধুবান্ধব, এর মধ্যে পুলিশ আছে, সাংবাদিকও আছে, তারা শুরু থেকেই আমাদের বিভ্রান্ত করেছে। পরে আমরা বুঝতে পেরেছি যে তারা আমাদের সামনে ভালো সেজে আমাদের মুভমেন্টটা ফলো করেছে। পরে সেটা বাবুলকে গিয়ে জানিয়ে দিয়েছে। সেটা জানার পর আমি তাদের অ্যাভয়েড করা শুরু করি। তখন আমার সামনে অনেক বিষয় পরিষ্কার হয়ে যায়।’

সারাবাংলা/আরডি/টিআর

Tags: , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন