বিজ্ঞাপন

তারকারা কেন বিয়ে গোপন করেন?

March 11, 2018 | 3:08 pm

জান্নাতুল মাওয়া।।

বিজ্ঞাপন

বিয়ে আর ঢাকঢোল এক চিরাচরিত যুগল। আমাদের দেশে যে কথাটি বহুল প্রচলিত সেটি হল ঢাক ঢোল বাজিয়ে বিয়ে করা। আজকালকার বিয়েগুলোতে আক্ষরিক অর্থে হয়তো ঢাকঢোল থাকেনা; তবে এর ভাবগত অর্থ হল সবাইকে জানিয়ে হইচই করে বিয়ে করা। সেই হইচই আজকাল তুলনামূলকভাবে অনেক বেশিই থাকে। বিয়ের মাধ্যমে মানুষ একেবারেই জীবনের একটা নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে। জীবনের অন্যতম এই ঘটনাটি তাই ঢাকঢোল বাজিয়ে সবাইকে জানানোই প্রচলিত সামাজিক প্রথার অংশ।

কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় ঢাক ঢোলের বদলে বিয়ের বর কনে ঢাক ঢাক গুড় গুড় করেন। তারা প্রাণপনে চেষ্টা করেন বিয়ের খবরটি লুকাতে। যারা বাড়ি থেকে পালিয়ে বিয়ে করছেন তাদের জন্যে ব্যাপারটি খুব স্বাভাবিক, তারা হয়তো সঠিক সময়ের অপেক্ষায় থাকেন। তবে কোনরকম পারিবারিক কারন ছাড়াই  বিয়ের খবর লুকান সাধারণত তারকারা। বেশ কিছুদিন আগে দেশজুড়ে হইচই ফেলে দিয়েছিলো চিত্রনায়িকা অপু বিশ্বাস আর শাকিব খানের বিয়ের খবরটি। প্রাক্তন এই তারকা জুটি বিয়ে করেছিলেন নয় বছর আগে এবং অসম্ভব দক্ষতার সাথে সেই খবরটি লুকিয়ে এতদিন সংসার করে এসেছেন। যদিও বিয়ের ঘটনা প্রকাশ্যে আসার প্রায় পরপরই তাদের বিচ্ছেদ হয়ে যায়।

 

বিজ্ঞাপন

আলোকচিত্র- আশীষ সেনগুপ্ত

 

বিয়ের ঘটনা লুকিয়ে রাখার এই সারিতে আছেন আরেক অভিনেতা ইমন। চলচ্চিত্র জগতে পা দেয়ার আগেই তিনি বিয়ে পর্বটি সেরে ফেলেছিলেন, কিন্তু কাউকে জানতে দেননি যে তিনি বিবাহিত। দীর্ঘদিন ধরে জনপ্রিয়তার শীর্ষে থাকা চিত্রনায়িকা শাবনুরও নিজের বিয়ের বিষয়টি লুকিয়ে রাখার ব্যাপারে অত্যন্ত যত্নবান ছিলেন। বিয়ে নিয়ে অনেক দিন জল ঘোলা করে, বিনোদন জগতের সাংবাদিকদেরকে অনেক দৌড় ঝাঁপ করিয়ে শেষ পর্যন্ত এই নায়িকা নিজের বিয়ের কথাটি স্বীকার করে নেন। এরও অনেক আগে একসময়ের চিত্রনায়ক শাকিল খান দাবি করেছিলেন যে তিনি এবং লাক্স তারকা খ্যাত চিত্রনায়িকা পপি বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন। অন্যদিকে পপি এই বিয়ের খবর অস্বীকার করে বসলে ঘটনা আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছিলো।

কিন্তু কেন বিয়ের মত এত আনন্দঘন বিষয়কে তারকারা লোকচক্ষুর আড়ালে লুকিয়ে রাখেন বা রাখতে চান। এর পেছনে ঠিক কোন মানসিকতা কাজ করে এই বিষয়ে জানতে চেয়েছিলাম জনপ্রিয় চিত্রনায়ক এবং বিবাহিত আরেফিন শুভর কাছে।

বিজ্ঞাপন

আরেফিন শুভ হেসে জানানলেন, তিনি যেহেতু তার বিয়ের খবরটি গোপন করেননি তাই তিনি আসলেই জানেন না ঠিক কী কারণে কোন কোন তারকা এই কাজটি করে থাকেন। তবে শুভর মতে, বিবাহিত হওয়া কিংবা সন্তানের পিতা মাতা হবার সাথে ক্যারিয়ারের কোন বিরোধ নেই। পৃথিবীর বিখ্যাত সব তারকারা ব্যাক্তিগত জীবনে বিবাহিত ছিলেন। এমন কি আমাদের দেশেও জনপ্রিয় অনেক তারকারাই বিবাহিত এবং সংসারী ছিলেন।

বিয়ের খবর লুকিয়ে রাখার পেছনে তারকাদের কোন মানসিকতা কাজ করে তা জানতে চেয়েছিলাম মনোচিকিৎসক হেলাল উদ্দিন আহমেদের কাছে। ড. হেলালের মতে, বিয়ের কথা গোপন করার ক্ষেত্রে তারকা এবং ভক্ত দুই পক্ষের মানসিক অবস্থাই অনুঘটক হিসেবে কাজ করে। প্রথমত, দর্শক ভক্তরা প্রিয় তারকাকে একদম নিজের আপনজন বলে মনে করে আনন্দ পান। বিয়ের মাধ্যমে যেহেতু প্রিয় তারকা নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেন, সেক্ষেত্রে ভক্তের মনে হতে পারে যে তিনি তার প্রিয় তারকার প্রতি মালিকানা হারিয়েছেন। অন্যদিকে তারকারাও মনে করেন বিয়ের খবর প্রকাশের মাধ্যমে তিনি ভক্তদের কাছে তার আগের যে আবেদন সেটি হারিয়ে ফেলবেন।

বিজ্ঞাপন

 

আমাদের সংস্কৃতিতে নায়কদের চেয়ে নায়িকাদের ক্ষেত্রেই এই আবেদন কমে যাবার বিষয়টি বেশি লক্ষ্য করা যায়। ড. হেলাল বলেন, এই অবস্থার পরিবর্তন আনতে হবে তারকাদেরকেই। তারা যদি ভক্তদের ইচ্ছার স্রোতে গা ভাসিয়ে না দিয়ে নিজেরাই নিজেদের কাজে সরবোচ্চ চেষ্টা প্রয়োগ করেন তবেই ভক্তদের মানসিকতার পরিবর্তন হবে।

ড. হেলালের এই কথাটির সত্যতা পাওয়া যায় বলিউডের দিকে তাকালে। যেখানে শাহরুখ খান আর আমির খানের মত নায়কেরা ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই প্রকাশ্যে বিবাহিত জীবন যাপন করার পরও দীর্ঘদিন ধরে খ্যাতির চূড়ায় বসে আছেন সেখানেই মাধুরী দীক্ষিত আর কাজলের মত জনপ্রিয় নায়িকারা বিয়ের পর হঠাত করেই ম্লান হয়ে গিয়েছেন বলে মনে হয়। যদিও তারা তাদের আগের মতই পারফরম্যান্স করে যাচ্ছেন, বরং অনেক ক্ষেত্রে আগের চেয়েও চৌকস হয়েছেন কিন্তু তাদেরকে নিয়ে ভক্তদের সেই পাগলামিটা কোথায় যেন থমকে গিয়েছে। অথচ সত্তরের দশকের পর্দাকাঁপানো তারকা জুটি উত্তম সুচিত্রা দুইজনই চলচ্চিত্রে আসার আগে থেকেই ব্যাক্তিগত জীবনে বিবাহিত ছিলেন। এই বৈবাহিক  অবস্থা তাদের জনপ্রিয়তায় কোন বাধা হতে পারেনি।

 

 

সেইসময়ে বাংলাদেশের জনপ্রিয় তারকারাও প্রায় সবাই ছিলেন বিবাহিত এবং এতে তাদের জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়েনি একটুও। এইযুগে এসে দেখা যাচ্ছে চিত্রনায়িকা মৌসুমি ছাড়া আর কেউ সেভাবে বিয়ের পরে জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে পারেননি। এমনকি রিয়াজ ফেরদৌসের মত জনপ্রিয় চিত্রনায়কদের জনপ্রিয়তায়ও ধ্বস নেমেছে বিয়ের পরে। তাহলে কি বর্তমানে আমাদের সমাজের মানুষের চিন্তাভাবনায় পরিবর্তন আসছে? হাস্যরসের ছলে হলেও আমাদের আশেপাশে বিয়ে নিয়ে প্রায়সময়ই একটি প্রচ্ছন্ন নেতিবাচকতা ছড়ায় প্রায় সবাই। যেমন বিবাহিত মানেই মৃত। অনেকেই বিয়ে করে বলে কুরবানি হয়ে গেলাম। বিয়ে নিয়ে এই বিচিত্র সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিই কি আমাদের তারকাদেরকে নিজেদের বিয়ের খবরটির গোপনীয়তা রক্ষায় উদ্বুদ্ধ করে?

কেন বর্তমান চলচ্চিত্র তারকারা তাদের বৈবাহিক অবস্থা লুকিয়ে রাখার প্রতি আগ্রহী হচ্ছেন এই বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক খায়রুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, এই বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক আকারে গবেষণা হলেই কেবল সঠিক কারণটি জানা সম্ভব। আমরা এখন শুধুমাত্র সম্ভাব্য কারণগুলো বলতে পারি। ড. চৌধুরীর  মতে, বর্তমানে দর্শকদের শ্রেণির পরিবর্তন হয়েছে। সকল শ্রেণির দর্শকদের কাছেই বিনোদনের সকল মাধ্যম পৌঁছে গিয়েছে। বিনোদনের ক্ষেত্রটি হয়েছে ডায়নামিক।  দর্শকদের হাতে এসেছে বিনোদনের নানান বিকল্প মাধ্যম। ফলে মানুষের চাহিদায়ও পরিবর্তন এসেছে। অন্যান্য সকল ক্ষেত্রের মতই বিনোদনের জায়গাটিতেও বিপুল বানিজ্যিকীকরণ হয়েছে। সমস্ত কিছুই এখন পন্যের মত বিকোয়। বিনোদন জগত হয়ে গিয়েছে প্রচন্ড প্রতিযোগিতামূলক। আর হতে পারে এসব কিছুই প্রভাব ফেলছে দর্শকের পছন্দে এবং তারকাদের আচরণে।

 

 

তবে চিত্রনায়িকা পূর্ণিমা বলেন, বিয়ের খবর লুকানোর ঘটনা কিন্তু খুব বেশি ঘটেনি। সবাই তো বেশ হইচই করেই বিয়ে করেছে। যে দুই একটা ঘটনা ঘটেছে সেগুলো সেইসব তারকাদের একান্ত ব্যাক্তিগত বিষয়। জনপ্রিয় এই তারকা আরো বলেন, একদম নতুন যে শিল্পীরা আসে তারা অনেকেই মনে করেন বিয়ের খবর জানলে হয়তো ক্যারিয়ার ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তাই তাদের মধ্যে হয়তো বিয়ের সংবাদ লুকানোর প্রবণতা থাকে। তিনি আরও বলেন, আমাদের দেশেই জনপ্রিয় তারকা সালমান শাহ তার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে ব্যস্ত সময়ে সবাইকে জানিয়েই বিয়ে করেছিলেন। এতে তার জনপ্রিয়তায় বিন্দুমাত্র আঁচ লাগেনি। তাই বিয়ের সাথে ক্যারিয়ার ক্ষতিগ্রস্ত হবার তেমন কোন সম্পর্ক নেই বলেই পূর্ণিমা মনে করেন।

হলিউডের দিকে তাকালে দেখতে পাই জগত কাঁপানো এই ঝলমলে তারকাদের কেউই বিয়ের কারনে জনপ্রিয়তার দিক থেকে পিছিয়ে পড়েননি। জনপ্রিয় অভিনেত্রী মেরিল স্ট্রিপ সেই ১৯৭৮ সালে বিয়ের পিঁড়িতে বসার পরেও জনপ্রিয়তার শীর্ষে থেকেছেন। ভক্তদের ভালোবাসাসহ তিনি  তার  ঝোলায় পুরেছেন একাডেমি, অ্যামি, গোল্ডেন গ্লোব, কানসহ নানান চলচ্চিত্র পুরষ্কার। বাংলাদেশেও ছোটপর্দা থেকে উঠে আসা তারকাদের ক্ষেত্রে বিয়ে তেমন বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। তারাও নিজেদের বিয়ের খবর গোপন রাখার কোন চেষ্টাই করেননি। এদের মধ্যে আছেন তিশা, চঞ্চল, জাহিদ হাসান, মোশাররফ করিমের মত তারকা অভিনেতারা। এই উদাহরগুলোর দিকে তাকালে মনে হয় বৈবাহিক অবস্থাও নারী-পুরুষ নির্বিশেষে অনেকের জনপ্রিয়তায় ভাটা ফেলতে পারেনা।

যদিও মানুষের চাহিদায় পরিবর্তন আসার কারণে বিনোদন তারকাদের অবস্থায় এবং অবস্থানে পরিবর্তন এসেছে তবুও দিনশেষে শুধুমাত্র গ্ল্যামার আর সৌন্দর্যভিত্তিক  জনপ্রিয়তার চেয়ে শিল্পের উৎকর্ষতাই এখনো তুলনামূলক  এগিয়ে আছে।

 

 

সারাবাংলা/এসএস

 

Tags: , , , , , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন