বিজ্ঞাপন

শিশুদের খেলার মাঠেই হবে থানার ভবন, ক্ষুব্ধ এলাকাবাসী

September 15, 2020 | 1:17 pm

সাদ্দাম হোসাইন, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: রাজধানীর কলাবাগান এলাকার তেঁতুলতলা মাঠ। মাঠের প্রান্ত থেকে ওই প্রান্তে সারাক্ষণই চলে শিশুদের ছুটোছুটি। শনিবার বিকেল মাঠে গিয়ে দেখা যায় নয়-দশ বছর বয়সী তিনজন শিশু পুরোনো একটি ফুটবল নিয়ে ছুটে বেড়াচ্ছে। এতেই যেন তাদের সব আনন্দ। কিন্তু ইট-পাথরের শহরে তেঁতুলতলার একটুকরো মাঠে শিশুদের এই আনন্দ আর বেশিদিন স্থায়ী হবে না। খুব শিগগিরই মাঠে গড়ে তোলা হবে কলাবাগান থানার নিজস্ব একটি বহুতল ভবন। এরইমধ্যে মাঠে ভবন তোলার জন্য যাবতীয় কার্যক্রম শুরু হয়েছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দা ও কলাবাগান থানা।

বিজ্ঞাপন

মাঠে নিয়মিত খেলতে আসে লেক সার্কাস স্কুলের তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী নাজমুল হাসান নাঈম। শিশু নাঈম সারাবাংলাকে বলে, ‘করোনায় স্কুল বন্ধ থাকায় আমরা সকাল এবং বিকেলে এ মাঠে খেলতে আসি প্রতিদিন। আমাদের মতো অনেকেই আসে। শুনছি এখানে বিল্ডিং তুলবে, যদি বিল্ডিং তোলে আমরা খেলবো কোথায়। আমাদের খেলার জায়গা কই?’

স্থানীয়রা জানান, মাঠের পশ্চিমাংশে স্থানীয়দের জন্য পানির পাম্প স্থাপন করা হয়েছে অনেক আগে। এতে মাঠের স্থান সংকুচিত হলেও স্থানীয়দের স্বার্থে কেউ প্রতিবাদ করেনি। কিন্তু এখন মাঠের একাংশে অস্থায়ী পার্কিং হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে বেশ কিছুদিন ধরে। এতে বাধা দিলেও কেউ কোনো কথা শুনছে না। উল্টো এ সমস্যার সমাধানের পথ খুঁজতে ব্যস্ত থাকা বাসিন্দাদের সামনে পুরো মাঠই দখল হয়ে যাওয়ার সমস্যা আর্বিভূত হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

তারা বলছেন, এ মাঠে এলাকার অনেক কিশোর-যৌবন কাটিয়ে বৃদ্ধ হয়েছেন। কিন্তু অর্ধশত বছর ধরে মাঠ হিসেবে পাওয়া এ তেঁতুলতলা মাঠটি রাতারাতি বেদখল হয়ে ভবন নির্মাণ কোনোভাবেই কাম্য নয়। সমস্যার সমাধানে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চেয়ে বাসিন্দারা প্রতিবাদ-মানববন্ধনও করেছেন।

তেঁতুলতলা মাঠেই নিজের শিশু-কিশোর বয়সের স্মৃতিচারণ করেন স্থানীয় বাসিন্দা সৈয়দা রত্না নামের একজন মাঝবয়সী নারী। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘এ মাঠে আমাদের ছোট বেলা কেটেছে। আমরা যখন ছোট ছিলাম তখন মাঠটি একেবারেই সবুজ ছিল। এ মাঠে আমাদের কত শৈশব স্মৃতি জড়িয়ে আছে। কত সুন্দর ছিল সেসব দিনগুলো। এ মাঠেই প্রতিবছর ঈদের জামাত হতো, এটি ঈদগাহ হিসেবেও পরিচিত। তাই আমাদের প্রাণের দাবি এ মাঠে যেন কোনো স্থাপনা তৈরি না হয়। আমাদের দাবি মাঠটি যেন খেলার উপযোগী করে গড়ে তোলা হয়। এজন্য আমরা প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ প্রত্যাশা করছি।’

পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) সভাপতি মো. আবু নাছের সারাবাংলাকে বলেন, ‘মাঠের জায়গায় স্থাপনা নির্মাণ হবে এটা অত্যন্ত দুঃখজনক। এটা কোনোভাবেই প্রত্যাশিত নয়। যেখানে মাঠের খোঁজে সরকার দিশেহারা, সেখানে বিদ্যমান থাকা মাঠেই ভবন নির্মাণ কিভাবে করতে পারে সেটাই বোধগম্য নয়। যারা একাজে জড়িত তাদের অবশ্যই বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করা উচিত।’

বিজ্ঞাপন

স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান এবং বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) যুগ্ম সম্পাদক অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার সারাবাংলাকে বলেন, শ্বাসপ্রশ্বাস নেওয়ার জন্য ফুসফুসে যেমন অনেক নালী থাকে, ঢাকা শহরের একটি মাঠ ঠিক তেমন। এসব ছোট ছোট নালী দিয়ে আমরা যেমন স্বাচ্ছন্দ্যে শ্বাস নিতে পারি, তেমনি এসব মাঠও বদ্ধ শহরে মুক্ত বাতাসের জন্য জরুরি। তাই এই মাঠ ধ্বংস করে দেওয়ার অর্থ ফুসফুসের ক্ষতি করা। খুব দুঃখজনক কথা হলো— প্রধানমন্ত্রী নিজে যেখানে মাঠ-পার্ক ও জলাশয় ধ্বংস না করবে নির্দেশ দিচ্ছেন, ঠিক তখনই এসব ধ্বংসের জন্য কতিপয় মহল উঠে পড়ে লেগেছে।

তিনি বলেন, আমরাও সর্বোচ্চটা দিয়ে চেষ্টা করবে এ শহরের বিদ্যমান মাঠগুলোকে রক্ষা করতে। বিশেষ করে তেতুলতলা মাঠটি যেকোনো মূল্যে, প্রয়োজনে আন্দোলন করে হলেও প্রতিরোধ করা হবে। এছাড়া আমরা সংগঠন থেকে প্রধানমন্ত্রীকে বিষয় অবহিত করব। তিনি বিজিএমইএ ভবন যেভাবে ভেঙে দিয়েছেন, আমাদের বিশ্বাস— ঠিক একইভাবে মাঠ দখলও ঠেকাবেন। কারণ হাতিরঝিলে বিজিএমইএ ভবন যখন গড়া হয়, তখন তারা কল্পনাও করেনি যে এটি ভাঙতে হবে। সুতরাং আজকে যারা বেদখল করে পরিবেশের ফুসফুস ধ্বংস করতে চায়, তাদেরও একদিন বিজিএমইএ’র মতো পরিস্থিতির শিকার হতে হবে।

কলাবাগান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) পরিতোষ চন্দ্র সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমি আজ এই থানার ওসি আছি, কাল হয়তো অন্য থানায় বদলি হবো। সুতরাং মাঠটিতে ভবন নির্মাণে স্থানীয়রা যদি মনে করে আমি জড়িত তাহলে ভুল ধারণা এটি। কারণ আমাদের থানার জন্য ভবন করা হলেও এতে আমাদের কোনো হাত নেই। জেলা প্রশাসন এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্টরাই বিষয়টির সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। স্থানীয় বাসিন্দাদের যদি কারো কোনো দাবি থাকে তা অবশ্যই জানাতে পারে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কেউ আমার কাছে এ বিষয়ে কোনো কিছুই জানায়নি।’

বিজ্ঞাপন

বাসিন্দারা মানববন্ধন করেছেন জানালে ওসি পরিতোষ চন্দ্র বলেন, ‘মানববন্ধন করার কথা শুনেছি, কিন্তু সেটি নাকি কোনো স্বার্থান্বেষী মহল জায়গাটি দখলের অপচেষ্টার উদ্দেশ্যে করেছে।’

মাঠে ভবন নির্মাণের বিষয়ে ঢাকা-১০ আসনের স্থানীয় সংসদ সদস্য মো. শফিকুল ইসলাম মহিউদ্দিন ও জেলা প্রশাসক মো. শহীদুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও এ বিষয়ে তাদের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

এ বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) স্থানীয় কাউন্সিলর মো. মাহবুবুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘মাঠটি জনগণের প্রয়োজন। আবার থানাও জনগণের প্রয়োজন। তাই জনগণের দাবির বিষয়ে আমরা সংশ্লিষ্টদের জানিয়েছি। এখন তারাই সিদ্ধান্ত নেবেন মাঠ কি মাঠের জায়গায় থাকবে নাকি মাঠের জায়গায় ভবন নির্মাণ হবে। কারণ দুটোর মালিকই কিন্তু সরকার।’

প্রায় একই কথা বলেন ঢাকা জেলা প্রশাসকের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট এম জামাল হোসেনও। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, যেহেতু জায়গাটি সরকারের, তাই সরকার জেলা প্রশাসনকে যেভাবে নির্দেশনা দেবে সেভাবেই কাজ করব আমরা।

মাঠে থানা করার বিষয়ে স্থানীয়দের বাধার বিষয়ে ক্ষুব্ধ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘জনগণ চাচ্ছে মাঠটা মাঠের জায়গায় থাকুক। আর থানা অন্য জায়গায় বসানো হোক। তো জনগণের দাবি অনুযায়ী থানাটা কি তাহলে রাস্তার ওপর বসিয়ে দেবো?’

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মাঠটি বিহারি কোনো এক ব্যক্তির। তিনি স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় দেশ ত্যাগ করেছিলেন। যে কারণে মাঠটি অর্পিত সম্পত্তি হিসেবে রাজউকে অন্তর্ভুক্ত। তবে মাঠের জায়গায় কলাবাগান থানার স্থাপনা নির্মাণ হবে কিনা এ বিষয়ে কিছুই জানেন না জাতীয় গৃহায়ণ ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী শরীফ আহমেদ। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘বিষয়টা আমি আগে শুনিনি, আপনার থেকেই শুনলাম। অবশ্যই খোঁজ নিয়ে দেখা হবে।’

সারাবাংলা/এসএইচ/এমও

Tags: , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন