বিজ্ঞাপন

‘চিকিৎসক না হয়ে হলাম না কেন মালেক!’

September 18, 2020 | 10:20 pm

সৈকত ভৌমিক, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: পেশায় তিনি একজন গাড়িচালক। স্বাস্থ্য অধিদফতরের ডিজির (শিক্ষা) গাড়ি চালানোর দায়িত্ব ছিল তার। কিন্তু তিনি গাড়িটি ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করতেন। এছাড়াও দুটো গাড়ি অবৈধভাবে নিজের কাজে লাগাতেন মো. আবদুল মালেক ওরফে বাদল। অধিদফতরে তার ক্ষমতা শুধু ড্রাইভারদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং কর্মকর্তারাও তাকে সমীহ করে চলতেন। শুধুমাত্র গাড়িচালকদের নিয়োগই নয়, চিকিৎসক বদলি, পদোন্নতি ও নিয়োগ বাণিজ্যের হোতা ছিলেন তিনি। তার ক্ষমতার এতই দাপট যে, প্রশাসনের কর্মকর্তারা মুখ খুলতে পারছেন না। তাদেরই একজনের মন্তব্য, ‘চিকিৎসক না হয়ে হলাম না কেন মালেক!’

বিজ্ঞাপন

অনুসন্ধানে জানা যায়, মো. আবদুল মালেকের বর্তমান বেতন বেসিক ২৬ হাজার ১০০ টাকা হলেও রাজধানীতে তার রয়েছে একাধিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। পেশায় একজন গাড়ি চালক হলেও রাজধানীর হাতিরপুলে তার সাড়ে চার কাঠা জমির উপরে দশতলা ভবন নির্মানাধীন। তুরাগ থানা এলাকায় ছয় কাঠা জমির ওপর সাততলা দুটি ভবনে রয়েছে ২৪টি ফ্ল্যাট। এছাড়াও একই এলাকায় আছে প্রায় ১০ থেকে ১২ কাঠার প্লট। সেইসঙ্গে দক্ষিণ কামারপাড়ার ১৫ কাঠা জমিতে একটি ডেইরি ফার্ম আছে আবদুল মালেকের।

আবদুল মালেক স্বাস্থ্য অধিদফতরে গাড়ি চালক হিসেবে যোগ দেন ১৯৮২ সালের দিকে। বর্তমানে কাগজে-কলমে তিনি স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক ডা. এ এইচ এম এনায়েত হোসেনের গাড়িচালক হিসেবে কর্মরত। কিন্তু ডা. এনায়েত হোসেন যে টয়োটা ভিগো (ঢাকা মেট্রো ঘ-১৮-৩৯৫১) গাড়ি ব্যবহার করেন সেটির চালক হারুন নামে একজন। এর আগে এনায়েত হোসেন যখন অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পরিকল্পনা ও গবেষণা) ছিলেন তখন তার গাড়ির চালক ছিলেন আবদুল মালেক। সেই সময় ডা. এনায়েত হোসেনের জন্য বরাদ্দ ছিল একটি সাদা পাজেরো জিপ (ঢাকা মেট্রো ঘ-১৩-২৯৭৯)। পরবর্তী সময়ে তিনি মহাপরিচালক হিসেবে পদোন্নতি পাওয়ায় নতুন গাড়ি ব্যবহার করলেও পুরনো গাড়িটি ব্যবহার করতে থাকেন আবদুল মালেক। ব্যক্তিগতভাবেই তিনি গাড়িটি বাসায় যাতায়াতের জন্য ব্যবহার করতেন বলে জানা গেছে। এসব বিষয়ে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক ডা. এ এইচ এম এনায়েত হোসেনকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘পাজেরো গাড়িটি দিয়ে মালেক নিজের ডেইরি ফার্মের দুধ নিয়ে আসতো। অফিসে ঢুকানোর আগে গাড়ি থেকে মালামাল নামিয়ে পরে অফিসে আসতো সে। এই ঘটনা অফিসের প্রায় সবাই জানে। কিন্তু কেউ মুখ খোলে না। কারণ বড় কর্মকর্তাদের খুব কাছের মানুষ মালেক।’

বিজ্ঞাপন

অনুসন্ধানে জানা যায়, শুধুমাত্র মহাপরিচালকের গাড়িই নয়, আবদুল মালেক স্বাস্থ্য অধিদফতরের একটি পিকআপ (ঢাকা মেট্রো- ঠ- ১৩-৭০০১) নিজের গরুর খামারের দুধ বিক্রির কাজে ব্যবহার করে থাকেন। এই গাড়িটি চালায় মাহবুব নামে একজন চালক। এছাড়াও স্বাস্থ্য অধিদফতরের একটি মাইক্রো (ঢাকা মেট্রো-চ-৫৩-৬৭৪১) পরিবারের সদস্যদের জন্য ব্যবহার করতেন আবদুল মালেক। এই গাড়িটিও কামরুল নামে একজন চালককে দিয়ে ব্যবহার করাতেন তিনি।

শুধুমাত্র স্বাস্থ্য অধিদফতরের গাড়ি ব্যবহারই নয় বরং প্রশাসনের নিয়োগেও ছিল আবদুল মালেক ক্ষমতা প্রয়োগ করতো। অধিদফতরে ড্রাইভার্স অ্যাসোসিয়েশন নামে একটি সংগঠন তৈরি করে নিজেই সেই সংগঠনের সভাপতি পদে দায়িত্ব নেন আবদুল মালেক। সেই ক্ষমতাবলে অধিদফতরের গাড়ি চালকদের মাঝে নিজের ক্ষমতার বলয় তৈরি করেন মালেক।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্বাস্থ্য অধিদফতরের এক কর্মকর্তা সারাবাংলাকে বলেন, ‘এই ক্ষমতা নিয়েই অধিদফতরের চিকিৎসকদের বদলি, পদোন্নতি ও তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী নিয়োগ বাণিজ্যে জড়িত ছিল আবদুল মালেক। একজন পরিচালক তার বিরুদ্ধে অডিটের চেষ্টা করলে সেটিও তিনি করতে পারেননি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কারণে। যে কারণে আবদুল মালেক কোন গাড়ি ব্যবহার করতো, কীভাবে তেল খরচ করতো তা নিয়ে খুব একটা ভাবার অবকাশ ছিল না।’

বিজ্ঞাপন

তিনি বলেন, ‘আবদুল মালেক ক্ষমতা ব্যবহার করে নিজের মেয়ে নৌরিন সুলতানা বেলি, ভাতিজা আবদুল হাকিমকে অফিস সহকারী পদে চাকরি নিয়ে দেন। এছাড়াও নিজের ভাই আবদুল খালেককে অফিস সহায়ক পদে নিয়োগ দেওয়ার ব্যবস্থা করেন তিনি। স্বাস্থ্য অধিদফতরে যে ক্যান্টিন আছে তাতেও আছে আবদুল মালেকের আধিপত্য। নিজের বড় মেয়ের জামাইকে তিনি ক্যান্টিনের ম্যানেজার হিসেবে নিয়োগ দিয়ে রেখেছেন। এছাড়াও ভাগ্নে সোহেল শিকারি, ভায়রা মাহবুব ও নিকট আত্মীয় কামাল পাশাকে অফিস সহায়ক পদে চাকরি নিয়ে দিয়েছেন মালেক।’

তিনি আরও বলেন, ‘চিকিৎসকদের একটা বিশাল অংশ যারা এই স্বাস্থ্য অধিদফতরে কাজ করেন, তারা মূলত এই আবদুল মালেকদের সমীহ করেই চলে। কারণ শুধু শুধু ভেজালে পড়ার কোনো মানে হয় না। উনাদের কারো সঙ্গে যদি কোনো সমস্যা হয় তবে দেখা যায় যে, কিছুদিনের মধ্যে চিকিৎসকের বদলির আদেশ চলে আসে। এজন্যেই এই স্বাস্থ্য অধিদফতরে চিকিৎসকদের মাঝে একটা মজার গল্প প্রচলিত আছে। সেখানে আমরা বলি- চিকিৎসক না হয়ে হলাম না কেন মালেক! কারণ এখানে আসলে তাদেরই ক্ষমতাতেই সব চলে।’

এসব কথার প্রমাণ মেলে আবদুল মালেকের বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের বিভিন্ন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে। আবদুল মালেক কোন গাড়ি ব্যবহার করতো? গত ছয় মাসে গাড়ি কোথায় ছিল? গাড়ির লগবুক কার কাছে থাকে? কত টাকার তেল ব্যবহার করেছে গত ছয় মাসে? এই সব প্রশ্নের উত্তর জানতে চাওয়া হয় স্বাস্থ্য অধিদফতরের একাধিক পরিচালকের কাছে। কিন্তু কেউই উত্তর দিতে চাননি। স্বাস্থ্য অধিদফতরের মিডিয়া সেলের কাছ থেকে তথ্য নিতে বলে এই প্রতিবেদককে।

পরে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মিডিয়া সেল থেকে জানানো হয়, তথ্য দিতে সময় লাগতে পারে। কারণ তথ্য পরিবহন কর্মকর্তা মো.আলাউদ্দিন খানের কাছ থেকে নিয়ে দিতে হবে।

বিজ্ঞাপন

এদিকে মো. আলাউদ্দিন সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমি পুলে থাকা ১৭টি গাড়ির বিষয়ে জানি, কিন্তু বাকি গাড়িগুলো বিষয়ে জানি না। এর বাইরের গাড়িগুলো প্রকল্পের হয়ে থাকলে সেগুলো তাদের কর্মকর্তারাই বলতে পারবেন। আবদুল মালেক আমার আওতাধীন পুলে থাকা কোনো গাড়ি ব্যবহার করতেন না।’

এ বিষয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান সারাবাংলাকে বলেন, ‘শুধুমাত্র একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের গাড়িচালকই না, যেকোনো প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারী, এমনকি সর্বোচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তারাও যদি রাজধানীতে একাধিক বাড়িসহ অঢেল সম্পদের মালিক হতে দেখা যায় তবে সেটি নিয়ে প্রশ্ন ওঠাই স্বাভাবিক। এই সম্পদ বৈধ কিনা তা নিয়েও প্রশ্ন উঠবে। স্বাভাবিকভাবেই ধরে নেওয়া যায় যে, বৈধ আয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়ার কোনো সুযোগ নেই এসব ক্ষেত্রে। এখানে দুটি বিষয় আছে। প্রথমটি হলো- বৈধ আয়ের সঙ্গে অসামঞ্জস্য সম্পদ আহরণ হলে সেটি খতিয়ে দেখতে হবে। এই কাজটি দুর্নীতি দমন কমিশন খুব সহজভাবেই করতে পারে। ব্যক্তির আয়ের সঙ্গে সম্পদের হিসেব নিলেই পরিষ্কারভাবে বের হয়ে আসবে যে, তিনি কীভাবে এই সম্পদের মালিক হয়েছেন। যদি সেক্ষেত্রে অবৈধ কিছু পাওয়া যায় তবে তাকে বিচারের আওতায় আনতে হবে ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।’

তিনি বলেন, ‘এক্ষেত্রে আরও একটি দিক রয়েছে। একজন গাড়িচালক এই সম্পদের মালিক এককভাবে হয়েছেন এমনটা ভাবার কোনো সুযোগ নেই। এখানে তার সঙ্গে যোগসাজশকারী আরও অনেকেই রয়েছেন। যারা গাড়িগুলো ব্যবহার করেছেন তাদের কেউ কেউ থাকতে পারেন। এছাড়াও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের ঠিকাদার থেকে শুরু করে অন্যান্য কর্মকর্তাদের যোগসাজশ থাকতে পারে। একইভাবে বিভিন্ন প্রভাবশালী মহলের যোগসাজশ থাকতে পারে। অতএব সেটিও খতিয়ে দেখতে হবে। শুধুমাত্র কান টানলে হবে না, মাথাও টানতে হবে। চুনোপুটিরা অবশ্যই প্রচুর সম্পত্তির মালিক হয়েছেন। কিন্তু রুই কাতলারা কী করেছেন সেটিও দেখার বিষয় রয়েছে। সেটি করতে পারলেই সত্যিকার অর্থে একটি নিয়ন্ত্রণের জায়গায় যাওয়া যাবে। অন্যথায় এমন অন্যায়-দুর্নীতির বিকাশ আরও ঘটতে থাকবে।’

সারাবাংলা/এসবি/পিটিএম

Tags: , , , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন