বিজ্ঞাপন

করোনা এখনও করুণা করেনি, হুট করে শেষ হয়ে যাওয়ার ভাবনা অবৈজ্ঞানিক

September 21, 2020 | 8:41 am

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: করোনাভাইরাস তথা কোভিড-১৯ এখনো আমাদের করুণা করেনি। ভাইরাসটি ক্রমাগত জিন পরিবর্তনের মাধ্যমে নিজেকে পরিবর্তন করছে। অসুর যেমন তার রক্ত থেকে আরেকটি অসুরের জন্ম দেয়, তেমনি ভাইরাসটিও ক্রমাগত বাড়ছে। ফলে করোনাভাইরাস হুট করেই যে একেবারেই শেষ হয়ে যাবে— সেই ভাবনাটি অবৈজ্ঞানিক। আর করোনার ভ্যাকসিন পেতেও বিশ্বকে আরও বেশকিছু সময় অপেক্ষা করতে হবে। তাই ভ্যাকসিনের জন্য অপেক্ষা না করে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলাই হবে উত্তম।

বিজ্ঞাপন

রোববার (২০ সেপ্টেম্বর) রাতে সেন্টার ফর সোস্যাল অ্যাডভোকেসি অ্যান্ড রিচার্স ফাউন্ডেশনের (সিসার্ফ) আয়োজনে ‘সারাবাংলা লাইটহাউজ’ অনুষ্ঠানে যুক্ত হয়ে বক্তারা এসব কথা বলেন। সমসাময়িক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে নিয়মিত এই আয়োজনের এ পর্বের বিষয় ছিল ‘করোনা আছে, করোনা নেই’। শবনম আযীমের উপস্থাপনায় আলোচনায় অংশ নেন প্রেস ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআইবি) চেয়ারম্যান ও দৈনিক জাগরণের সম্পাদক আবেদ খান এবং ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ডা. আশীষ কুমার চক্রবর্তী।

ভার্চুয়াল আলোচনায় ডা. আশীষ কুমার চক্রবর্তী বলেন, আমরা চিকিৎসকরা কিন্তু এখনো করোনা রোগীদের সামাল দিতে, কাজ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে যাই। একটু আগেও যেমন ফোন এসেছে— আমার করোনা ইউনিটে একটি বেডও খালি নেই। তার মানে করোনা রোগীর অস্তিত্ব আছে। করোনা এখনো আমাদের করুণা করেনি। কিন্তু আমরা যখন রাস্তায় বের হই, মুখে কারও মাস্ক থাকে না, অবাধে চলাফেরা করছে সবাই। সেই মহাখালী ফ্লাইওভারের ওপরে-নিচে যানজট। সবকিছু দেখলে মনে হয় যেন আমরা প্রিয় সেই ঢাকাকে ফিরে পেয়েছি।

ডা. আশীষ বলেন, কিন্তু আমরা এভাবে আমাদের প্রাণপ্রিয় ঢাকাকে ফিরে পেতে চাই না। আমরা তো যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছি, অদৃশ্য এক ভাইরাসের সঙ্গে আমরা যুদ্ধ করছি, যা লাখো মানুষকে প্রতিনিয়ত আঘাত করছে। প্রায় ৫ হাজার মৃত্যু ছুঁই ছুঁই, শতাধিক চিকিৎসক প্রাণ হারিয়েছেন। আমাদের সম্মুখযোদ্ধাদের মধ্যে চিকিৎসক, সাংবাদিক, পুলিশ, বিভিন্ন বাহিনীর লোকজন প্রাণ হারিয়েছেন। সুতরাং এমন একটি জীবাণুকে যেনতেনভাবে বুঝতে চাইলে হবে না।

বিজ্ঞাপন

এই চিকিৎসক আরও বলেন, করোনা অবশ্যই আছে। এটি কবে শেষ হবে, তা এখনই বলা যাবে না। করোনা ক্রমাগত এখনো জিন পরিবর্তনের মাধ্যমে নিজেকে পরিবর্তন করছে, ভাইরাল রেপ্লিকেশন হচ্ছে। একটি অসুরের রক্ত থেকে যেমন আরেকটি অসুরের জন্ম হয়, তেমনি ভাইরাসটি ক্রমাগতভাবে বাড়ছে। এটি একেবারেই হুট করে শেষ হয়ে যাবে— এটি ভাবা একেবারেই অবৈজ্ঞানিক। যেদিন থেকে স্বাস্থ্য অধিদফতর তাদের নিয়মিত বুলেটিন বন্ধ করেছে, সেদিন থেকে জনগণ মনে করলো করোনা হয়তো শেষ হয়ে গেছে। এটি হয়তো একটি কারণ। সরকার প্রায় পাঁচ মাস সময় ধরে নিয়মিত আড়াইটার সময় বুলেটিন প্রচার করেছে। মানুষ সেটি আগ্রহ নিয়ে শুনত। এর ফলে তখন তাদের কাছে করোনা নিয়ে কিছুটা হলেও আতঙ্ক ছিল। বুলেটিনে স্বাস্থ্য পরামর্শ দেওয়া হতো। অনেকে সেগুলো জেনে সতর্ক হওয়ারও চেষ্টা করত। এই পোগ্রামটি বন্ধ হওয়ার পর থেকে মানুষের মধ্যে উদাসীনতা চরম আকারে বেড়েছে। হাসপাতালে আমরা নোটিশ দিয়ে রেখেছিলাম এক রোগীর সঙ্গে একজনের বেশি অ্যাটেডেন্স আসবে না। সেটি অনেকেই মেনেছেন। এখন আবার সেই পুরোনো অবস্থা। একজন রোগীর সঙ্গে আট-দশ জন করে অ্যাটেনডেন্ট ঢুকছেন।

ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের এই এমডি বলেন, করেনায় মৃত্যুকে আসলেই মনে হচ্ছে যেন একটি সংখ্যা। একটি মৃত্যুর সঙ্গে তার পরিবার-স্বজনসহ আরও অনেকেই রয়েছেন। আমরা প্রতিটি মৃত্যুকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করতে চাই। একজন চিকিৎসক হিসেবে মৃতের পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানাই। চিকিৎসক হিসেবে রোগীর মৃত্যু মানেই আমাদের কাছে একটি পরাজয়। আজ (রোববার) ৩২ জনের মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু মৃত্যুর সংখ্যার পাশে আরেকটি কলাম থাকে, সেখানে দেখবেন লেখা থাকে— এছাড়াও জ্বর-সর্দি-কাশিতে আরও ১৫ জনের মৃত্যু। সেটাকেও আপনাকে ধরতে হবে। ওই ১০ থেকে ১৫ জন হয়তো করোনা টেস্ট করেননি। গ্রামে এখনো হয়তো কেউ করোনায় আক্রান্ত হলে একঘরে করে দেওয়া হবে। ঢাকাতে তো কিছু এলাকা ছাড়া বুঝাই যায় না যে করোনা আছে। মানুষ দিব্যি ক্যান্টিনে বসে চা খাচ্ছে, বলছে— করোনাকে দেখতে পাচ্ছি না। অনেক শিক্ষিত মানুষ মাস্ক পরেন না!

করোনার ভ্যাকসিন প্রসঙ্গে এই চিকিৎসক বলেন, ভ্যাকসিন একধরনের সেফটি দিতে পারে। এটি অনেকটা হেলমেটের মতো। এক ধরনের সুরক্ষা দেয়। কিন্তু ভ্যাকসিন কবে আসবে, সেই চিন্তা করে বসে থাকলে হবে না। আমাদের প্রতিদিন যেভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা প্রয়োজন, সেভাবে আমরা মেনে চলব। আমরা অবশ্যই বাসার বাইরে গেলে মাস্ক পরব। ভ্যাকসিন এত সহজেই পাব বলে আমি মনে করছি না।

বিজ্ঞাপন

দৈনিক জাগরণ সম্পাদক আবেদ খান বলেন, মানুষের গ্রহণ করার ক্ষেত্রে বা ধারণযোগ্যতার ক্ষেত্রে আমরা এখানে বলতে পরি করোনা নেই। বিশ্বের বিভিন্ন দেশেও একই অবস্থা। মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিজেই করেনাকে অবজ্ঞা করে বসেছিলেন। একসময় বাধ্যতামূলকভাবে মাস্ক ব্যবহার করলেন শুধু ভোটের কারণে। একটি বিষয় বুঝতে হবে— মানুষ কিন্তু সবসময় মুক্ত থাকতে পছন্দ করে। সরকার কখনো ঢালাওভাবে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, কোথাও কোথাও এলাকাভিত্তিক লকডাউন দিয়েছে, সেটা দিয়ে খুব একটা যে সুরাহা হয়, তা নয়। চিকিৎসকরা আক্রান্ত হয়েছেন। দেড় হাজার পুলিশ আক্রান্ত হয়েছেন, কত পুলিশ মারা গেছেন কে জানে। আমরা কিন্তু কোনো হিসাব পাচ্ছি না। মৃত্যুর তথ্য নিয়ে লুকোচুরি আছে। বিশেষ করে গ্রামে কেউ যদি করোনায় মারা যায়, সমাজ থেকে ওই পরিবারকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়।

তিনি বলেন, আমরা একটি ভ্রান্তি বিলাসের মধ্যে বিচরণ করছি। আমরা ধরে নিচ্ছি করোনা আছে কিংবা নেই। কিন্তু বাস্তবতায় দেখছি করোনা বিস্তৃত হচ্ছে। শুধু তাই নয়, গ্রাম পর্যায়ে সেটা আরও প্রকট আকার ধারণ করেছে। আমি সুন্দরবন এলাকার মানুষ। এলাকা থেকে যে খবর পাই, সেখানে প্রথম দিকে বলা হয়েছিল আমাদের এলাকায় কখনো করোনা আসবে না, কারও করোনা হবে না। অথচ গত পরশু দিনও আমরা জানলাম, একটা গ্রাম উজাড় হয়ে গেছে করোনার জন্য। উজাড় বলতে আমি বলছি না যে সব মারা গেছেন, প্রত্যেকেই কোনো না কোনোভাবে আক্রান্ত হয়েছে। এটি একটি ভয়ংকর চিত্র। করেনাকে আমরা অবজ্ঞা করার কারণে ক্ষতিগুলোকে বুঝতে পারছি না, অনুভব করতে পারছি না।

আবেদ খান বলেন, আমরা মনে করছি করোনার ওষুধ বা ভ্যাকসিন দ্রুত সময়ে চলে আসবে। আমরা এখন সচেতনতা বাদ দিয়ে ওষুধের দিকেই বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছি। ওষুধ চলে আসছে, ওমুক দেশে এসেছে, রাশিয়ায় এসেছে। হোমিওপ্যাথিক ওষুধ বের হয়েছে, টোটকা চলছে, এগুলো হচ্ছে আমাদের অজ্ঞতা। কিন্তু আমরা কোনো অবস্থাতেই বাস্তবতাকে অস্বীকার করতে পারব না। প্রকৃতপক্ষে ভ্যাকসিন আবিষ্কার করতে বিশ্বের আরও সময় লাগবে। এক প্লেগের জন্যই তো কত বছর সময় লেগেছিল! আমাদের কিন্তু এই জায়গাগুলো বুঝতে হবে। আমরা কিন্তু এত সহজেই পরিত্রাণ পাব না।

বিজ্ঞাপন

সারাবাংলা/ইএইচটি/টিআর

Tags: , , , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন