বিজ্ঞাপন

নির্বিচারে ধ্বংস হচ্ছে লাউয়াছড়া, সংকটে বিলুপ্তির পথে প্রাণীকূল

September 22, 2020 | 8:35 am

হৃদয় দেবনাথ, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট

মৌলভীবাজার: একহাজার ২৫০ হেক্টর আয়তনের লাউয়াছড়া বন নানা প্রজাতির দুর্লভ উদ্ভিদ এবং প্রাণির আবাসভূমি। এই জাতীয় উদ্যানে ৪৬০ প্রজাতির দুর্লভ উদ্ভিদ ও প্রাণী রয়েছে। এর মধ্যে ১৬৭ প্রজাতির উদ্ভিদ, ৪ প্রজাতির উভচর, ৬ প্রজাতির সরীসৃপ, ২৪৬ প্রজাতির পাখি এবং ২০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণি দেখা যায়। তবে দশকের পর দশক ধরে নির্বিচারে বন ধ্বংসের ফলে ক্রমশ সংকুচিত হয়েছে এর আয়তন। ফলে খাদ্যসংকটে বর্তমানে বিলুপ্তির পথে রয়েছে নানা প্রাণি।

বিজ্ঞাপন

জানা যায়, ১৯৯৬ সালে জাতীয় উদ্যান ঘোষণার পর এখন পর্যন্ত লাউয়াছড়ার প্রায় ৩০ শতাংশ গাছ কমেছে। এর বেশিরভাগ অংশই চোরাকারবারিরা কেটে নিয়ে গেছে। এছাড়া ঝড়েও উপড়ে পড়েছে কিছু। গাছপাচার রোধে কার্যকর পদক্ষেপের অভাব ও নতুন করে বনায়নের উদ্যোগ না নেওয়ায় কমছে গাছগাছালি, ফলে চরম সংকটে পড়ছে বন্যপ্রাণী।

বন্যপ্রাণি নিয়ে কাজ করা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ‘বন্যপ্রাণি সেবা ফাউন্ডেশনে’র সদস্যরা জানান, সম্প্রতি বনে চরম আকারে দেখা দিয়েছে খাদ্য সংকট। ফলে বন ছেড়ে খাদ্যের অভাবে প্রায়ই লোকালয়ে ঢুকে মানুষের হাতে ধরা পড়ছে বিশাল আকৃতির অজগর সাপসহ বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণি। বিরল প্রজাতির বন্যপ্রাণিগুলো মাঝে মধ্যে উদ্ধার করা সম্ভব হলেও বেশির ভাগ সময়ই তা সম্ভব হচ্ছে না। স্থানীয়দের হাতে মারা পড়ছে অসংখ্য বিরল বন্যপ্রাণি। তাছাড়াও লাউয়াছড়ার ভেতর দিয়ে বয়ে চলা রেল ও সড়ক পথে রেলে কাটা পড়ে এবং যানবাহনের চাকায় পিষ্ট হয়েও মারা যাচ্ছে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান থেকে লোকালয়ে চলে আসা অনেক প্রাণি।

তারা আরও জানান, সংকট নিরসনে কোনো মহাপরিকল্পনা কিংবা স্থায়ী উদ্যোগ না থাকায় এই উদ্যানটি এখন অনেকটাই ধ্বংসের প্রান্তে। দীর্ঘদিনের বয়ে চলা সংকটগুলো ঘনীভূত হয়ে এখন মহা হুমকিতে পড়েছে নানা দুর্লভ প্রজাতির বন্যপ্রাণীর বাসস্থান, জীবন জীবিকা ও পরিবেশ। প্রতিনিয়তই খাদ্য, নিরাপদে অবাধ বিচরণ ও বাসস্থানের আয়তন ছোট হচ্ছে। ফলে প্রতিনিয়তই কমছে বিরল প্রজাতির বন্যপ্রাণি, উদ্ভিদের সংখ্যা।

বিজ্ঞাপন

বন বিভাগের বন্যপ্রাণি ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ শাখার হিসাব বলছে, লাউয়াছড়া বনের ভেতর ও আশপাশ এলাকা থেকে চলতি বছরের প্রথম আট মাসে উদ্ধার করা হয়েছে ৫০টি বন্যপ্রাণি। এর মধ্যে সাতটি মৃত। ২০১৭ সালে উদ্ধার করা ১৮৭টি বন্যপ্রাণির মধ্যে মৃত পাওয়া যায় ১৬টি। তবে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে সবচেয়ে বেশি বন্যপ্রাণি মারা পড়ে ২০১৬ সালে। সে বছর মোট ২৩০টি বন্যপ্রাণি উদ্ধার করা হয়। এর মধ্যে ৪৭টিই ছিল মৃত। তবে বন বিভাগের হিসাবের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি বন্যপ্রাণি প্রতি বছর মারা পড়ছে বলে জানিয়েছে লাউয়াছড়া বন ও বন্যপ্রাণি নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংগঠনগুলো।

বন্যপ্রাণি সেবা ফাউন্ডেশনের হিসাবমতে, গত ছয় মাসে লাউয়াছড়ার আশপাশে অন্তত ২০টি বন্যপ্রাণি মারা গেছে। এর মধ্যে রয়েছে মায়া হরিণ, সজারু, বনরুই, গন্ধগোকুল, অজগরসহ বিভিন্ন প্রজাতির সাপ ও বানর।

বিজ্ঞাপন

প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের রেঞ্জ কর্মকর্তা মোনায়েম হোসেন সারাবাংলাকে জানান, বিভিন্ন প্রজাতির উদ্ভিদ ও প্রাণিবৈচিত্র্যে ভরপুর এ লাউয়াছড়া বনের ভেতর দিয়ে বয়ে গেছে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার রেলপথ। পাশাপাশি বনের ভেতর দিয়ে রয়েছে সড়কপথও। যা বন্যপ্রাণি মারা যাওয়ার অন্যতম কারণ। এছাড়া অতিমাত্রায় পর্যটকের আগমন, বনের ভেতরের সড়ক দিয়ে বেপরোয়া গাড়ি চলাচলের কারণে বন্যপ্রাণিরা আবাসস্থলকে অনিরাপদ ভাবছে। দিন দিন দখল বেড়ে যাওয়ায় বন্যপ্রাণির আবাস্থলও সংকুচিত হয়ে গেছে।

বাংলাদেশ পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (বাপা) পার মৌলভীবাজার জেলার সমন্বয়ক আ ন ম সালেহ সুহেল বলেন, ‘একটি সংঘবদ্ধ চোর চক্র নির্বিচারে বনের গাছ উজাড় করায় বন্যপ্রাণির খাদ্য সংকট চরম আকারে দেখা দিয়েছে। বনের ভেতরে পর্যটকদের গাড়ি চলাচল, উচ্চ শব্দে মাইক বাজানোসহ বনের গভীরে পর্যটকদের আনাগোনা বন্ধ করা প্রয়োজন। এছাড়া বনের গা ঘেঁষে জমি দখল করে লেবু বাগান, ঘরবাড়ি ও দোকানপাট নির্মাণ এখনই বন্ধ করা দরকার।’

লাউয়াছড়ায় বন্যপ্রাণির খাদ্য-আবাস সংকটের কথা স্বীকার করছে বন বিভাগও। সিলেট বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (বন্যপ্রাণি ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ) আ ন ম আব্দুল ওয়াদুদ বলেন, ‘খাদ্য ও আবাস সংকটে লোকালয়ে এসে অনেক বন্যপ্রাণি মারা পড়ছে। এ সংকট নিরসনে বনাঞ্চলে বিভিন্ন জাতের ফলমূলের গাছ লাগানোর পাশাপাশি বড় গাছ সংরক্ষণ করা হবে। এছাড়া উদ্যানের ভেতর বন্যপ্রাণির জন্য একটি রেসকিউ সেন্টার করা হয়েছিল। লোকবলের অভাবে সেটি বন্ধ আছে, এটিও চালু করা হবে।’ এছাড়া বন্যপ্রাণির নিরাপত্তায় বনের ভেতর দিয়ে যাওয়া রেললাইন ও সড়কপথের বিকল্প চিন্তা করাও প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।

বন বিভাগের হিসাবমতে, লাউয়াছড়া বনে ২০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ৫৯ প্রজাতির সরীসৃপ (৩৯ প্রজাতির সাপ, ১৮ প্রজাতির লিজার্ড ও দুই প্রজাতির কচ্ছপ), ২২ প্রজাতির উভচর, ২৪৬ প্রজাতির পাখি ও অসংখ্য কীটপতঙ্গ রয়েছে। বিরল প্রজাতির উল্লুক, মুখপোড়া হনুমান ও চশমাপরা হনুমানও দেখা যায় সংরক্ষিত এ বনে। এর বাইরে রয়েছে বানর, মেছোবাঘ, বন্য কুকুর, ভালুক, মায়া হরিণ, বনছাগল, কচ্ছপ, অজগরসহ নানা প্রজাতির প্রাণী। পাখির মধ্যে আছে সবুজ ঘুঘু, বনমোরগ, মথুরা, তুর্কি বাজ, সাদা ভ্রু সাতভায়ালা, ঈগল, হরিয়াল, কালো মাথা টিয়া, কালো ফর্কটেইল, ধূসর সাতশৈলী, পেঁচা, ফিঙে, লেজ কাটা টিয়া, কালোবাজ, হীরামন, কালো মাথা বুলবুল ও ধুমকল। সাধারণ দর্শনীয় পাখির মধ্যে উল্লেখযোগ্য টিয়া, ছোট হরিয়াল, সবুজ সুইচোরা, তোতা, ছোট ফিঙে, সবুজ কোকিল, পাঙ্গা ও কেশরাজ।

বিজ্ঞাপন

বিপন্ন ও বিরল প্রজাতির অনেকগুলোর অস্তিত্ব নিয়ে সন্দিহান বন্যপ্রাণি বিশেষজ্ঞ ও পরিবেশবাদীরা। বনের ভেতর দিয়ে যাওয়া রেলপথ ও সড়কপথকেই বন্যপ্রাণির জন্য মরণফাঁদ হিসেবে মনে করেন বন্যপ্রাণিপ্রেমীরা। দীর্ঘদিন ধরেই বনের মধ্য থেকে সড়ক ও রেলপথ স্থানান্তরের দাবি জানিয়ে আসছে সচেতন মহল। এগুলো স্থানান্তর না হলে কোনোভাবেই বন্যপ্রাণি রক্ষা করা যাবে না আশঙ্কা সংশ্লিষ্টদের।

সারাবাংলা/এমও

Tags: , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন